হুদায়বিয়ার সন্ধির ইতিহাস
আজকে আলোচনা করবো হুদায়বিয়ার সন্ধি ও খায়বারের যুদ্ধ নিয়ে।
মহানবী (সা.)কে অত্যাচার-নির্যাতনের মাধ্যমে কুরাইশরা এক পর্যায়ে তাঁকে মদিনায় হিজর করতে বাধ্য করেছিল।
হিজরতের পরেও মহানবী (সা.) ও ইসলামকে নিশ্চিহ্ন করার জন্য তারা আপ্রাণ চেষ্টা করেছে।
বদর, ওহুদ, খন্দকের মতো যুদ্ধ রাসূল (সা.) ও ইসলামকে নিশ্চিহ্ন করার অভিপ্রায়েই কুরাইশরা সংঘটিত করেছিল।
আর এ উদ্দেশ্যে ইহুদি-খ্রিস্টানদের সহযোগিতা পেয়েও মুসলমানদের অগ্রযাত্রাকে রুখতে পরেনি, এক সময় তাদের সাথেই হুদায়বিয়ার সন্ধিতে বসতে হয়েছে।
আর সন্ধির সুযোগে মহানবী (সা.) দেশে-বিদেশে ইসলামের আহ্বান পৌঁছিয়ে ইসলামের দ্রুত বিস্তার ঘটাতে সক্ষম হন।
হুদায়বিয়ার সন্ধির পটভূমি
দীর্ঘদিন মাতৃভূমি মক্কা ছেড়ে এসে মহানবী (সা.)-এর প্রাণ চঞ্চল হয়ে উঠেছিল। কাবা শরীফ জিয়ারত করবার মহান আল্লাহ তায়ালার প্রচ্ছন্ন ইঙ্গিত পেয়ে মহানবী (সা.) ৬ষ্ঠ হিজরীতে জিলকদ মাসে পবিত্র উমরাহ পালনের সিদ্ধান্ত নেন।
এ উদ্দেশ্যে মহানবী (সা.) তাঁর চৌদ্দশত সাহাবীসহ শান্তিপূর্ণভাবে উমরাহ সম্পন্ন করার জন্য মদিনা থেকে মক্কার উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করলেন।
মুসলমানদের বিরুদ্ধে মক্কার কুরাইশদের শত্রুতা তখনো শেষ হয়নি। তারা মুসলমানদের প্রতিরোধ করার জন্য প্রস্তুত হয়ে রইল।
খুযায়া গোত্রের সর্দার বুদাইলের মাধ্যমে কুরাইশদের এই মনোভাবের কথা মহানবী (সা.) জানতে পারলেন।
মহানবী (সা.) বুদাইলের মাধ্যমে কুরাইশদের এই মর্মে সংবাদ দিলেন যে, মুসলমানরা কোনো যুদ্ধের জন্য নয়, বরং শান্তিপূর্ণভাবে কাবা শরীফে উমরাহ পালনের উদ্দেশ্যে যাচ্ছে।
কিন্তু মুসলমানদের বাধা দেবার জন্য কুরাইশরা ছিল সংকল্পবদ্ধ। মহানবী (সা.) হুদায়বিয়া নামক স্থানে যাত্রাবিরতি করে তাঁর পাঠানো সংবাদের উত্তর জানার জন্য অপেক্ষা করতে লাগলেন।
কুরাইশদের মধ্যে কিছু বিজ্ঞ ব্যক্তি মহানবী (সা.)-এর শান্তিপূর্ণ প্রস্তাব গ্রহণ করতে চাইল। তারা জানতো যে, মুহম্মদ (সা.)কে যদি উমরাহ পালন করতে দেয়া না হয় তাহলে এর ফলে যুদ্ধ বেঁধে যেতে পারে।
তাছাড়া মহানবী (সা.) এর সাথে একটি শান্তিচুক্তি স্বাক্ষরিত হলে মক্কার কুরাইশরা সিরিয়ার সাথে তাদের বাণিজ্য সম্পর্ক পুনঃচালু করতে পারবে।
কারণ মদিনার উপর দিয়ে যাওয়া এই বাণিজ্য পথটি মুসলমানদের দখলে রয়েছে। অতএব, কুরাইশরা তাদের মুখপাত্র হিসেবে উরওয়া ইবনে মাসউদকে মহানবী (সা.) এর নিকট এই সন্ধিচুক্তির শর্ত নির্ধারণের জন্য প্রেরণ করলেন।
উরওয়া মহানবী (সা.) এর নিকট আসলো, কিন্তু উভয় পক্ষের আলোচনাকালে মহানবী (সা.)-এর অনুসারীদের সম্পর্কে তার অপ্রীতিকর ও শত্রুভাবাপন্ন মনোভাবের কারণে চুক্তি সম্পন্ন সফল হননি।
তবে উরওয়া মহানবী (সা.) এর উপর সাহাবীদের প্রগাঢ় ভক্তি, ভালোবাসা ও আস্থা লক্ষ্য করে এবং মক্কায় ফিরে গিয়ে কুরাইশদের তা অবহিত করে।
মহানবী (সা.) দ্বিতীয়বার কুরাইশদের নিকট খিরাস ইবনে উমাইয়া নামক একজন দূতকে প্রেরণ করলেন, কিন্তু কুরাইশরা তার সাথে দুর্ব্যবহার করে এবং তার উটের পায়ের রগ কেটে দেয়।
কুরাইশরা মহানবী (সা.) ও মুসলমানদের বিরুদ্ধে খুবই শত্রুতামূলক আচরণ করে। তারা মুসলমানদের হত্যা করার জন্য একটি ক্ষুদ্র দলকেও পাঠায়।
কুরাইশদের এ সমস্ত লোক আক্রমণ করতে এসে নিজেরাই মুসলমানদের হাতে বন্দী হয়, কিন্তু মহানবী (সা.) তাদের সবাইকে ক্ষমা করে দেন এবং মক্কার পবিত্র কাবা ঘরের আওতার মধ্যে রক্তপাত করতে নিষেধ করেন।
অতপর মহানবী (সা.) হজরত ওসমান (রা.)কে শান্তির জন্য কুরাইশদের নিকট প্রেরণ করেন, হজরত ওসমান (রা.) মক্কায় পৌঁছলে কুরাইশরা তাঁকে বন্দী করে।
মুসলিম শিবিরে এরূপ গুজব রটে যে, কুরাইশরা হজরত ওসমান (রা.)কে হত্যা করেছে।
মহানবী (সা.) এই খবরে খুবই মর্মাহত হলেন, পবিত্র কাবা শরীফের এলাকার মধ্যে পবিত্র মাসে কোনো আরব গোত্র প্রধানকে হত্যা করা ইসলামপূর্ব আমলেও আরবদের জন্য জঘন্য অপরাধ বলে বিবেচিত হতো।
মহানবী (সা.) তাঁর সাহাবীদের ডেকে নতুন করে শপথ নেয়ার জন্য বললেন যে, তাদের ধর্ম ও ঈমানের জন্য শেষ পর্যন্ত তাঁরা যুদ্ধ করবে। একটি গাছের নিচে এই শপথ নেয় হয়।
Read more: বদর যুদ্ধের কাহিনী
ইতিহাসে এই শপথকে ‘বাইয়াতুর রিদওয়ান’ বলা হয়, পবিত্র কুরআনে এ সম্পর্কে বলা হয়েছে- ‘মু’মিনরা যখন বৃক্ষতলে তোমার নিকট বাইয়াত গ্রহণ করলো তখন আল্লাহ তাদের প্রতি সন্তুষ্ট হলেন।
তাদের অন্তরে যা ছিল, তা তিনি অবগত ছিলেন, তাদেরকে তিনি দান করলেন প্রশান্তি এবং তাদেরকে পুরস্কার দিলেন আসন্ন বিজয়।
সকল সাহাবীর শপথ গ্রহণ শেষ হলে রাসূল (সা.) তাঁর ডান হাত বাম হাতের উপর দিয়ে হজরত ওসমানের প্রতিশোধ গ্রহণ কল্পে নিজে শপথ নিলেন, পরে অবশ্য হজরত ওসমান (রা.) নিরাপদে মুসলিম শিবিরে ফিরে আসেন।
কুরাইশরা বুঝতে পারলো যে, এই অপ্রতিদ্বন্দ্বী ও বিস্ময়করভাবে একান্ত অনুগত ভক্ত সমন্বয়ে গঠিত এই দলের বিরুদ্ধে যুদ্ধে তারা সফলকাম হতে পারবে না।
তাদের অবিস্মরণীয় অতীত ও শোচনীয় পরাজয়ের স্মৃতি তখনো তাদের মনে স্পষ্ট হয়ে আছে, তাই তারা সুহাইল ইবনে আমরকে মুসলমানদের নিকট সন্ধি করার জন্য দূত করে পাঠালো।
তার সাথে আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে উভয় পক্ষে একটি যুদ্ধ বিরতিতে পৌঁছানো সম্ভব হয়। ইতিহাসে এটিই - হুদায়বিয়ার সন্ধি নামে খ্যাত, কি আছে হুদায়বিয়ার সন্ধিতে ।
হুদায়বিয়ার সন্ধির শর্তগুলো ছিল নিম্নরূপ
★ এ বছর পবিত্র কাবায় ওমরা পালন না করেই মুসলমানগণ মদিনায় ফিরে যাবে।
★ মুসলমানরা পরের বছর উমরা করতে পারবে। কিন্তু তিনদিনের বেশি মক্কায় অবস্থান করতে পারবে না।
★ অস্ত্রশস্ত্র ছাড়াই তারা পরবর্তী বছর পবিত্র নগরীতে আসবে, এ সময় কেবলমাত্র কোষবদ্ধ তরবারী সঙ্গে আনা যাবে।
★ মক্কায় বসবাসরত কোনো মুসলমানদের তারা সাথে করে মদিনায় নিয়ে যেতে পারবে না, আবার কোনো মুসলমান যদি মক্কায় যেতে চায় তাকেও তারা বাধা দিতে পারবে না।
★ যদি কোনো মক্কাবাসী মদিনায় চলে যায় তবে তাদেরকে হস্তান্তর করতে হবে, আর যদি কোনো মুসলমান মক্কায় আসে তবে মক্কাবাসীরা তাকে হস্তান্তর করবে না।
★ আরবের অন্যান্য গোত্র স্বাধীনভাবে যে কোনো পক্ষের মৈত্রী চুক্তিতে আবদ্ধ হতে পারবে।
* এই চুক্তির মেয়াদ হবে দশ বছর।
যদিও সাধারণভাবে মুসলমানগণ শর্তাবলীতে খুশি হতে পারেনি। চুক্তির শর্তগুলো ছিল বড় বেশি একতরফা।
সন্ধিচুক্তির শর্তাবলী নিয়ে আলাপ-আলোচনাকালে কুরাইশদের একগুঁয়ে আচরণ মুসলমানদেরকে ভেতরে ভেতরে ক্রোধান্বিত করে তোলে, কিন্তু মহানবী (সা.) এর মনঃতুষ্টির জন্য তারা শান্ত থাকে।
ইসলামের ইতিহাসে হুদাইবিয়ার সন্ধি
একটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা। ষষ্ঠ হিজরিতে মুসলমানরা হজ করতে গেলে মক্কার কোরাইশরা তাতে বাধা দেয়। এ অবস্থায় যুদ্ধের প্রস্তুতি নেয় মুসলমানরা।
এ পরিস্থিতিতে কোরাইশরা সন্ধি করতে প্রস্তুত হলো এবং এ সম্পর্কে আলোচনা করার জন্য সুহাইল বিন আমরকে দূত বানিয়ে পাঠাল। তার সঙ্গে দীর্ঘ সময়ব্যাপী আলোচনা হলো এবং শেষ পর্যন্ত সন্ধির শর্তাবলি স্থিরিকৃত হলো। সন্ধিপত্র লেখার জন্য হজরত আলী (রা)-কে ডাকা হলো।
সন্ধিপত্রে যখন লেখা হলো ‘এই সন্ধি আল্লাহর রাসুল মুহাম্মদ (সা.)-এর তরফ থেকে তখন কোরাইশ প্রতিনিধি সুহাইল প্রতিবাদ জানিয়ে বলল : ‘আল্লাহর রসুল’ কথাটি লেখা যাবে না; এ ব্যাপারে আমাদের আপত্তি আছে।’
এ কথায় সাহাবিদের মধ্যে প্রচণ্ড ক্ষোভের সৃষ্টি হলো। সন্ধিপত্র লেখক হজরত আলী (রা.) কিছুতেই এটা মানতে রাজি হলেন না।
কিন্তু হযরত (সা.) নানাদিক বিবেচনা করে সুহাইলের দাবি মেনে নিলেন এবং নিজের পবিত্র হাতে ‘আল্লাহর রসুল’ কথাটি কেটে দিয়ে বললেন : ‘তোমরা না মানো, তাতে কি ? কিন্তু খোদার কসম, আমি তাঁর রসুল।’
রাসূল (সা.) এর রিসালাত ও বিশাল রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের মধ্যে হুদায়বিয়ার সন্ধি সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ।
কেননা এটা ছিল মক্কার নেতৃস্থানীয় কাফিরগণ কর্তৃক মদিনায় প্রতিষ্ঠিত প্রজাতন্ত্রের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব এবং মহানবী (সা.) এর নেতৃত্বের স্বীকৃতির দৃষ্টান্ত।
এতকাল যারা ছিল প্রাণের শত্রু, আজ তারই সন্ধির মাধ্যমে ভবিষ্যতে দশ বছর যুদ্ধ বিগ্রহ না করার জন্য চুক্তিবদ্ধ হয়েছে। এই চুক্তির মাধ্যমেই মুসলিম উম্মাহর জন্য আল্লাহর ঘর কাবা ঘর জিয়ারত করার অধিকার প্রতিষ্ঠিত হয়।
এই চুক্তির ফলেই মহানবী (সা.) ইসলামের আহ্বান দিকে দিকে ছড়িয়ে দেয়ার সুযোগ পান। এই সন্ধির পরেই খালিদ বিন ওয়ালিদ, আমর ইবনুল আস ও উসমান বিন তালহাসহ বড় বড় যোদ্ধা ও বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গ ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেন।
এই মহান চুক্তির ধারাগুলো আপাত দৃষ্টিতে মুসলমানদের জন্য অসম্মাজনক মনে হলেও প্রকৃতপক্ষে এর ফলাফল ছিল সুদূরপ্রসারী। অল্প সময়ের মধ্যে মদিনার বাইরের বিভিন্ন গোত্রর বহুসংখ্যক লোক ইসলাম গ্রহণ করেছিলেন।
এই সন্ধির একটি শর্ত অনুযায়ী মক্কা হতে প্রত্যাগত নবদীক্ষিত মুসলমানদের মহানবী (সা.) মক্কায় পাঠিয়ে দিতেন, আবু জান্দাল যার জ্বলন্ত প্রমাণ।
পরবর্তীতে এই রকম নবদীক্ষিত মুসলমানদের সংখ্যা বেড়ে গেলে তাঁরা সন্ধিশর্ত বজায় রেখে মদিনা না গিয়ে সমুদ্র তীরবর্তী ‘ইস’ নামক এক জঙ্গলে বসবাস করতে শুরু করেন।
সিরিয়া হতে প্রত্যাগত মক্কার ব্যবসায়ীদের সেই পথ দিয়ে আসতে হতো, ফলে তারা এই সমস্ত নবদীক্ষিত মুসলমানদের হুমকিস্বরূপ মনে করে নিজেরাই শর্তটি সংশোধনের অনুরোধ জানায়।
ফলে এই সমস্ত মক্কার নবদীক্ষিত মুসলমানরা মদিনায় মহানবী (সা.) এর সাথে মিলিত হবার সুযোগ পান। এইভাবে দেখা গেল, শর্ত যেমনই হোক না কেন, এর সুফলগুলো ছিল মুসলমানদের পক্ষে।
মুসলমানদের বিজয়
হুদায়বিয়ার সন্ধি ইসলামের জন্য একটি সুমহান বিজয়। রাজনৈতিক প্রজ্ঞা ও দূরদর্শিতার পরিচালক মহানবী (সা.) এর এ হুদায়বিয়া সন্ধি স্বাক্ষরের মাধ্যমেই মূলত মক্কা বিজয়ের পথ পরিষ্কার হয়ে যায়।
হুদায়বিয়ার চুক্তির ফলেই মুসলিম মিল্লাত আরব বিশ্বে একটি শক্তিধর জাতির সম্মান লাভ করে। আল্লাহ তায়ালা কুরআনুল করীমে হুদায়বিয়ার সন্ধিকে তাই ‘ফাতহুম মুবীন’ বা সুস্পষ্ট বিজয় হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন।
এই মহান সন্ধির ধারাবাহিকতায় ইসলামের উত্তরোত্তর প্রসার এবং সর্বোপরি ৮ম হিজরীতে মক্কা বিজয় সম্পন্ন হয়েছে। যা বিশ্বজয়েরও সূচনা করে।
হুদায়বিয়ার সন্ধি দুই বছর স্থায়ী হয়। এই দুই বছরে ইসলাম অনেকটাই শক্তিশালী হয়। সন্ধি কার্যকর হওয়ার পর খুযায়া গোত্র মুসলমানদের সাথে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক স্থাপন করে। পক্ষান্তরে মুসলমানদের শত্রু বনু বকর কুরাইশদের সাথে মৈত্রী বন্ধনে আবদ্ধ হয়।
মুসলমানদের জনপ্রিয়তা উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পাওয়ায় কুরাইশদের অন্তর্জ্বালা যেমন বাড়তে থাকে, তেমনি তাদের মধ্যে জন্ম নিতে থাকে এক প্রচণ্ড ক্রোধের।
খুযায়া গোত্র মহানবীর (সা.) সাথে মৈত্রী বন্ধনে আবদ্ধ হওয়ায় কুরাইশরা তাদের মিত্র বনু বকরকে খুযায়া গোত্র আক্রমণের জন্য প্ররোচনা দিতে থাকে।
এই গুপ্ত চক্রান্তের ফলে বনু খুযায়াবাসী যখন ‘ওয়াতির’ নামক জলাশয়ের নিকট এক রাত্রে নিদ্রামগ্ন ছিল, তখন অতর্কিতভাবে বনু বকর তাদের উপর আক্রমণ চালিয়ে বনু খুযায়ার অনেক লোককে হত্যা ও তাদের ধন-সম্পদ লুট কর নিয়ে যায়। কুরাইশরা এই আক্রমণে তাদের প্রকাশ্যে সাহায্য করে।
বনু খুযায়া গোত্র এই নৃশংসতার বিরুদ্ধে কুরাইশদের নিকট অভিযোগ করেও কোনো প্রতিকার না পেয়ে তারা মহানবী (সা.) এর নিকট তাদেরকে রক্ষা করার জন্য একটি প্রতিনিধি দল প্রেরণ করে।
মহানবী (সা.) সাহাবীদের সাথে পরামর্শ করে কুরাইশদের তিনটি শর্ত দিয়ে এর যে কোনো একটি বেছে নেয়ার জন্য বার্তা প্রেরণ করেন :
১. খুযায়া গোত্রের যেসব লোককে হত্যা করা হয়েছে, কুরাইশদের তার রক্তপণ প্রদান করতে হবে, অথবা
২. বনু বকরের সাথে তাদের সম্পর্ক ছিন্ন করতে হবে, অথবা
৩. কুরাইশদেরকে হুদাইবিয়া সন্ধি বাতিল বলে ঘোষণা করতে হবে।
কুরাইশ পক্ষ প্রথম দু’টি শর্ত মেনে নিতে অস্বীকার করে কুরত ইবন উমারের মাধ্যমে মহানবীর (সা.) নিকট সংবাদ পাঠায় এবং এই সংবাদে তারা জানিয়ে দেয় যে, তারা তৃতীয় শর্তটি গ্রহণ করেছে। কুরাইশদের পক্ষে এটা ছিল একটি অবিবেচনাপ্রসূত পদক্ষেপ।
হুদায়বিয়ার সন্ধি চুক্তি বিলুপ্তির অনিবার্য ভয়াবহ পরিণতি উপলব্ধি করতে পেরে পরবর্তীতে আবু সুফিয়ান চুক্তিটি নবায়নের উদ্দেশ্যে নিজেই মদিনায় মহানবী (সা.) এর সাথে সাক্ষাতের জন্য গমন করেন।
কিন্তু তার প্রস্তাবের পাশাপাশি মুসলমানদের দাবির প্রতি তিনি কর্ণপাত করেননি। এটি ছিল নিতান্তই অযৌক্তিক। ফলে মহানবী (সা.) তার চুক্তি নবায়নের প্রস্তাবে সম্মত হননি।
খায়বারের যুদ্ধ
মুসা বিন উকবা বলেন- হুদায়বিয়া থেকে ফেরত এসে নবী (সাঃ) ২০ দিন বা এর চেয়ে কম সময় মদ্বীনায় অবস্থান করলেন। অতঃপর তিনি খায়বারের উদ্দেশ্যে বের হলেন।
বের হওয়ার সময় তিনি সিবা বিন উরফুযাকে মদ্বীনায় তাঁর স্থলাভিষিক্ত করলেন।
এ সময় আবু হুরায়রা (রাঃ) মদ্বীনায় আগমণ করে ফজরের সলাতে সিবা বিন উরফুযার সাথে সাক্ষাত করলেন।
সিবা বিন উরফুযাকে তিনি প্রথম রাকআতে كهيعص তথা সূরা মারইয়াম এবং দ্বিতীয় রাকআতে ويل للمطففين তথা সূরা মুতাফফিফীন তিলাওয়াত করতে শুনলেন।
তিনি সলাতেই বলতে শুরু করলেন। উমুক ব্যক্তির জন্য সর্বনাশ হোক !
তার নিকট রয়েছে দু’টি দাঁড়িপাল্লা, সে যখন মানুষকে কোন কিছু মেপে দেয়, তখন ছোট পাল্লা দিয়ে মেপে দেয়।
আর যখন মেপে নেয় তখন বড়টি দিয়ে নেয়, সলাত শেষে তিনি সিবা-এর সাথে সাক্ষাত করলেন, অতঃপর আবু হুরায়রা (রাঃ) খায়বারে গিয়ে নবী (সাঃ)এর সাথে মিলিত হলেন।
নবী (সাঃ) তাঁর সাহাবীদের সাথে কথা বলায় তারা আবু হুরায়রা ও তাঁর সাথীদেরকে মালে গণীমতের অংশ দিতে রাজী হয়ে গেলেন, সুতরাং তিনিও গণীমতের অংশ পেলেন।
নবী (সাঃ) খায়বারে গিয়ে ফজরের সলাত পড়লেন। সলাতের পর মুসলমানগণ আরোহন করে অগ্রসর হচ্ছিলেন।
নবী (সাঃ) এর আক্রমণের খবর যেহেতু তাদের জানা ছিল না, তাই তারা সকাল বেলা তাদের চাষাবাদের জমির দিকে বের হচ্ছিল, তারা মুসলিম বাহিনীকে দেখে বলল- আল্লাহর শপথ !
এই তো মুহাম্মাদ এবং তাঁর বাহিনী এসে গেছে, এই বলে তারা নিজেদের দূর্গের মধ্যে আশ্রয় নিল। নবী (সাঃ) তখন বললেন- আল্লাহু আকবার !
খায়বার বরবাদ হয়ে গিয়েছে। আমরা যখন সকাল বেলা কোন সম্প্রদায়ের আঙ্গিনায় অবতরণ করি, তখন যাদেরকে সতর্ক করা হয়েছিল, তাদের সকাল বেলাটি হবে খুবই মন্দ।
অতঃপর নবী (সাঃ) আলীকে যুদ্ধের পতাকা দিলেন, হাদীছের কিতাবসমূহে এই ঘটনা বর্ণিত হয়েছে।
এরপর লেখক মারহাব নামক ইহুদীর সাথে আলী (রাঃ) এর লড়াইয়ের বর্ণনা এবং আমের বিন আকওয়ার ঘটনা বর্ণনা করেছেন। সহীহ মুসলিমের বর্ণনা থেকে জানা যায় আলী (রাঃ) মারহাবকে হত্যা করেছেন।
অতঃপর মুসলিম বাহিনী খায়বারবাসীদেরকে ঘেরাও করলেন, অবরোধ দীর্ঘ হওয়ায় মুসলিমগণ ক্লান্ত হয়ে পড়লেন।
এ সময় যখন তারা খাওয়ার জন্য গৃহপালিত গাধা যবেহ করল তখন রসূল (সাঃ) তাদেরকে গৃহপালিত গাধার গোশত খেতে নিষেধ করলেন।
পরিশেষে তাদের সাথে এই শর্তে মীমাংসার চুক্তি করলেন যে, তারা খায়বার ছেড়ে চলে যাবে এবং যুদ্ধের হাতিয়ার ব্যতীত যত ইচ্ছা সম্পদ নিয়ে যেতে পারবে,
তবে স্বর্ণ ও রেŠপ্য রাসূল (সাঃ) এর জন্য রেখে যেতে হবে।
আর শর্ত করা হল যে, কেউ যদি কোন কিছু গোপন করে কিংবা লুকিয়ে ফেলে, তবে তার জন্য নিরাপত্তার চুক্তি কার্যকর হবেনা।
অতঃপর তারা একটি মশক (কলসী) লুকিয়ে ফেলল। তাতে হুআই বিন আখতাবের সম্পদ লুকায়িত ছিল।
বনী নযীর কবীলাকে উচ্ছেদ করার সময় সে তা খায়বারে নিয়ে এসেছিল, নাবী (সাঃ) হুআই বিন আখতাবের চাচাকে মশকটির ব্যাপারে জিজ্ঞেস করলেন।
সে বলল- যুদ্ধ এবং অন্যান্য খরচে তা শেষ হয়ে গেছে। নবী (সাঃ) বললেন- দিন তো বেশী হয়নি, সম্পদ ছিল বিপুল পরিমাণ, এত দ্রুত সম্পদগুলো শেষ হয়ে গেল কিভাবে ?
অতঃপর নাবী (সাঃ) হুআইয়ের চাচার খোঁজ-খবর রাখার জন্য যুবাইর (রাঃ) কে নিযুক্ত করে দিলেন।
যুবাইর (রাঃ) যখন তার উপর চাপ প্রয়োগ করলেন, তখন সে বলল- আমি হুআইকে এই অঞ্চলের বিরানভূমির আশেপাশে ঘুরাফেরা করতে দেখেছি, সাহাবীগণ সেখানে গিয়ে তালাশ করে তা পেয়ে গেলেন।
অতঃপর রাসূল (সাঃ) যখন উপরোক্ত শর্তে তাদেরকে বহিষ্কারের ইচ্ছা করলেন, তখন তারা বলল- এই শর্তে আমাদেরকে এখানেই থাকতে দিন যে, আমরা এখানের যমীন চাষাবাদ করব এবং উৎপাদিত ফল ও ফসল থেকে আমরা অর্ধেক নিব আর আপনি বাকী অর্ধেক নিবেন।
ঐ দিকে রাসূল (সাঃ) এর কাছে কাজ করার মত কোন লোক ছিলনা, তাই তিনি তাদের প্রস্তাব মেনে নিলেন।
ইহুদীরা খায়বারে কত দিন থাকতে পারবে ?
চুক্তিতে এটি নির্দিষ্ট করে উল্লেখ ছিলনা; বরং বিষয়টি রাসূল (সাঃ) এর ইচ্ছার উপর দেয়া হয়েছিল। যত দিন ইচ্ছা তিনি তাদেরকে সেখানে থাকতে দিবেন।
চুক্তি সম্পাদিত হওয়ার পর তিনি তাদের কাউকেই হত্যা করেন নি, তবে চুক্তি ভঙ্গ করার অপরাধে তিনি আবুল হুকাইকের দুই পুত্রকে হত্যা করলেন, তাদের একজন ছিল হুয়াইয়ের কন্যা সাফিয়ার স্বামী।
রাসূল (সাঃ) সাফিয়া বিনতে হুয়াই ইবনে আখতাবকে বন্ধী করলেন, তিনি আবুল হুকাইকের এক পুত্রের বিবাহধীন ছিলেন।
নবী (সাঃ) তাঁকে ইসলামের দাওয়াত দিলে তিনি ইসলাম গ্রহণ করলেন, এরপর তিনি তাঁকে মুক্ত করে দিয়ে বিয়ে করলেন, মুক্ত করে দেয়াটাই বিয়ের মোহরানা নির্ধারণ করলেন।
খায়বারের ভূমিকে নাবী (সাঃ) ৩৬ ভাগে বিভক্ত করলেন।
প্রত্যেক ভাগকে আবার ১০০ ভাগে ভাগ করে মোট ৩৬০০ অংশে ভাগ করলেন। এখান থেকে রসূল (সাঃ) এবং মুসলমানগণ অর্ধেক অর্থাৎ ১৮০০ অংশ নিলেন।
আর বাকী অংশগুলো তথা ১৮০০ অংশ সেখানকার যমীন দেখা-শুনাকারী এবং বসবাসকারী মুসলমানদের জন্য রেখে দিলেন।
ইমাম বায়হাকী (রহঃ) বলেন- খায়বারের যমীন মুসলমানদের মধ্যে ভাগ করে দেয়ার কারণ হল সেখানকার এক অংশ জয় করা হয়েছিল যুদ্ধ করে আরেক অংশ জয় করা হয়েছিল সন্ধি ও চুক্তির মাধ্যমে।
যেই অংশ লড়াইয়ের মাধ্যমে জয় করা হয়েছিল, তা মুজাহিদদের মাঝে বণ্টন করে দেয়া হয়েছিল।
আর যেই অংশ চুক্তির মাধ্যমে বিজিত হয়েছিল, তা খায়বারের যমীন দেখা-শুনাকারীদের জন্য এবং মুসলমানদের স্বার্থে রেখে দেয়া হয়েছিল।
তবে সঠিক কথা হচ্ছে খায়বারের সকল অংশই যুদ্ধের মাধ্যমে জয় করা হয়েছিল, এটিই সঠিক ও সন্দেহাতীত কথা।
যুদ্ধের মাধ্যমে হস্তগত ভূমির ব্যাপারে মুসলমানদের ইমাম সম্পূর্ণ স্বাধীন। তিনি ইচ্ছা করলে সম্পূর্ণ যমীন মুসলমানদের মাঝে ভাগ করে দিতে পারেন। ইচ্ছা করলে মুসলমানদের জন্য ওয়াক্ফ হিসাবে রেখেও দিতে পারেন।
অথবা তিনি ইচ্ছা করলে সৈনিকদের মাঝে ভাগ করতে পারেন এবং ইচ্ছা করলে তা থেকে কিছু অংশ মুসলমানদের প্রয়োজনে রেখে দিতে পারেন। নাবী (সাঃ) এই তিনটিই করেছেন।
বনী কুরয়যা ও বনী নযীরের যমীন তিনি মুসলমানদের মধ্যে ভাগ করে দিয়েছেন। মক্কার যমীনকে তিনি ভাগ করেন নি, খায়বারের অর্ধেক ভাগ করেছেন, আর বাকী অর্ধেক রেখে দিয়েছেন।
হুদায়বিয়ার সন্ধিতে যারাই অংশ গ্রহণ করেছিলেন
তাদের সকলেই খায়বারে শরীক ছিলেন, শুধু জাবের বিন আব্দুল্লাহ্ (রাঃ) অনুপস্থিত ছিলেন। তারপর রসূল (সাঃ) তাঁকে অংশ দিয়েছিলেন।
এই যুদ্ধের সময় নবী (সাঃ) এর চাচাতো ভাই জাফর বিন আবী তালেব এবং তাঁর সাথীগণ ও আবু মুসা আশআরী (রাঃ) স্বগোত্রীয় লোকদেরকে নিয়ে উপস্থিত হলেন।
এ যুদ্ধেই একজন ইহুদী মহিলা নাবী (সাঃ) এর জন্য বিষ মিশ্রিত ছাগলের গোশত হাদীয়া (উপহার) দিল।
তিনি এবং তাঁর কয়েকজন সাহাবী সেটি খেলেন। এক বর্ণনায় আছে, তিনি সেই মহিলাকে কোন শাস্তি দেন নি। অন্য বর্ণনায় আছে তিনি মহিলাটিকে হত্যা করার আদেশ দিয়েছিলেন।
আবু হুরায়রা (রাঃ) এর বর্ণনা আছে, যারা সেই খাদ্য খেয়েছিলেন, তাদের মধ্যে হতে যখন বিশর বিন বারা মৃত্যু বরণ করলেন, তখন নাবী (সাঃ) সেই মহিলাকে হত্যা করেছেন।
মক্কায় যখন খায়বারের যুদ্ধের খবর পৌঁছল, তখন কুরাইশরা দুইভাগে বিভক্ত হয়ে গেল এবং তারা পরস্পর বাজি ধরল।
একদল বলল- মুহাম্মাদ (সাঃ) এবং তাঁর সাহাবীগণ জয়লাভ করবে, আরেক দল বলল- দু’টি বন্ধুগোত্র এবং খায়বারের ইহুদীরা জয়লাভ করবে।
অতঃপর আল্লামা ইবনুল কাইয়্যিম (রহঃ) হাজ্জাজ বিন ইলাতের ঘটনা বর্ণনা করেছেন, তিনি খায়বার বিজয়ের পর ইসলাম গ্রহণ করেন। হাজ্জাজের প্রচুর সম্পদ ছিল।
খায়বার বিজয়ের পর তিনি রাসূল (সাঃ) কে বললেন- মক্কায় আমার স্ত্রীর নিকট স্বর্ণ ও অন্যান্য সম্পদ গচ্ছিত রয়েছে, সে এবং তার পরিবারের লোকেরা যদি আমার ইসলাম গ্রহণ সম্পর্কে জানতে পারে, তাহলে আমার সমস্ত সম্পদ হাত ছাড়া হবে।
আমাকে অনুমতি দিন, খায়বার বিজয়ের খবর তাদের কাছে যাওয়ার পূর্বেই আমি দ্রুত মক্কায় পৌঁছে যাই এবং আমার সম্পদগুলো হস্তগত করে নেই।
তবে আমি মক্কায় গিয়ে এমন কিছু বলতে চাই, যার মাধ্যমে আমি আমার জান ও মালকে হেফাজত করতে পারব। রসূল (সাঃ) তাঁকে কিছু (মিথ্যা) বলার অনুমতি দিলেন।
মক্কায় গিয়ে হাজ্জাজ বিন ইলাত (রাঃ) স্বীয় স্ত্রীকে বললেন- আমার ব্যাপারটি গোপন রাখ এবং তোমার নিকট আমার যে সমস্ত মাল রয়েছে, তা একত্রিত কর।
কেননা আমি মুহাম্মাদ এবং তার সাথীদের গণীমত ক্রয় করব। কারণ তারা মদ্বীনায় পরাজিত হয়েছে।
মুহাম্মাদ বন্দী হয়েছে এবং তার সাথীরা তার থেকে আলাদা হয়ে গেছে। ইহুদীরা শপথ করে বলছে যে, তারা মুহাম্মাদকে মক্কায় পাঠাবে, যাতে তারা তাকে হত্যা করতে পারে।
খবরটি মক্কায় দ্রুত ছড়িয়ে পড়ল। মক্কার মুসলিমগণ খবরটি শুনে ব্যথিত হলেন। অপর পক্ষে মক্কার মুশরিকরা আনন্দ-উল্লাস প্রকাশ করল।
রাসূল (সাঃ) এর চাচা আববাস বিন আব্দুল মুত্তালিবের কাছে খবরটি পৌঁছলে তিনি চিন্তায় পড়ে গেলেন। খবর শুনে তিনি এতই দুর্বল হয়ে পড়লেন যে, উঠে দাঁড়ানোর শক্তিটুকুও আর অবশিষ্ট রইলনা।
তার গৃহের দরজায় মুসলিম ও মুশরিকদের অগণিত লোকের সমাবেশ ঘটল।
তাদের কেউ আনন্দ প্রকাশ করছিল আবার কেউ দুঃখ প্রকাশ করছিল।
পরক্ষণেই আববাস দৃঢ়তার সাথে একটি কবিতা আবৃত্তি করলেন। এতে তিনি এমন ভাব প্রকাশ করলেন যে, তাতে মনে হয় মুহাম্মাদ (সাঃ) এর পরাজয় বরণ করার খবর সঠিক হতে পারেনা।
কারণ আববাসের জানা ছিল যে, আল্লাহ্ তাঁর রসূলকে বিজয়ী করার ওয়াদা করেছেন। আর আল্লাহর ওয়াদা কখনও মিথ্যা হতে পারেনা।
কবিতার ভাষায় আববাসের দৃঢ়তা দেখে মুহাম্মাদ (সাঃ) এর অনুসারী এবং তার শুভাকাঙ্খীদের মনে সাহসের সঞ্চার হল।
মুশরিকরা মনে করল, আববাসের কাছে হয়ত অন্য কোন খবর থাকতে পারে।
অতঃপর আববাস খবরটির সত্যতা যাচাই করার জন্য হাজ্জাজ বিন ইলাতের কাছে স্বীয় খাদেমকে পাঠালেন।
পাঠানোর সময় খাদেমকে বলে দিলেনঃ তুমি গোপনে হাজ্জাজের সাথে মিলিত হও এবং বলঃ মরণ হোক তোমার! এ কি সংবাদ শুনালে ?
মুহাম্মাদ (সাঃ) এর সাথে আল্লাহ্ তা‘আলা যে ওয়াদা করেছেন, তা তোমার এই খবরের চেয়ে অনেক ভাল।
খাদেম যখন হাজ্জাজের সাথে কথা শেষ করল তখন হাজ্জাজ বলল- তুমি গিয়ে আবুল ফজল তথা আববাসকে আমার সালাম দাও এবং এ কথা জানিয়ে দাও সে যেন, তাঁর কোন একটি ঘরে একাকী অবস্থান করে।
আমি অচিরেই তার সাথে দেখা করে এমন খবর দিব, যা তাকে খুশী করবে। খাদেম ঘরের দরজায় এসে বলল- হে আবুল ফজল (আববাস)!
সুসংবাদ গ্রহণ করুন
এই কথা শুনে আববাস (রাঃ) খুশীতে লাফিয়ে উঠলেন। মনে হচ্ছিল, তিনি বিপদজনক কোন খবরই শুনেন নি, তিনি এগিয়ে এসে খাদেমের দু’চোখের মাঝখানে চুম্বন করলেন।
অতঃপর খাদেম হাজ্জাজের কথা জনিয়ে দিল, এতে খুশী হয়ে তিনি সেই দাসকে মুক্ত করে দিলেন। অতঃপর তিনি সেই খাদেমকে বললেন- হাজ্জাজ তোমাকে যা বলেছে, এবার আমাকে তা শুনাও।
খাদেম বলল- তার সাথে একামেত্ম সাক্ষাত করার জন্য একটি ঘরে একাকী প্রবেশ করুন। তিনি আজ দুপুরে আপনার কাছে আসবেন এবং কথা বলবেন।
সুতরাং হাজ্জাজ আসলেন এবং আববাসের সাথে নির্জনে সাক্ষাৎ করলেন।
হাজ্জাজ তাঁর কাছে এসে প্রথমে অঙ্গিকার নিলেন যে, অবশ্যই এই খবর মক্কাবাসী থেকে গোপন রাখতে হবে। আববাস নির্দ্বিধায় রাজী হয়ে গেলেন।
খায়বারবাসীর উপর জয়লাভ করেছে
এবার হাজ্জাজ আসল ঘটনা খুলে বলতে লাগলেন। তিনি বলেন- আমি দেখে আসলাম, আপনার ভাতিজা খায়বারবাসীর উপর জয়লাভ করেছে, তাদের সমস্ত সম্পদ গণীমত হিসাবে তাঁর হস্তগত হয়েছে এবং আল্লাহর বিধান অনুসারে মুসলিমগণ তা ভাগাভাগি করে নিয়েছেন।
আর সেখানকার রাজার কন্যা সাফিয়া বিনতে হুআইকে নিজের স্ত্রী বানিয়ে ফেলেছেন এবং তার সাথে বাসরও করে ফেলেছেন।
আর আমি এখানে এসেছি, যাতে আমার সম্পদগুলো একত্রিত করে নিয়ে যেতে পারি।
আমি রসূল (সাঃ) থেকে অনুমতি নিয়েই সেচ্ছায় এ ব্যাপারে মূল সত্যটি গোপন করছি।
সুতরাং আপনি তিন দিন পর্যন্ত আমার এই খবর গোপন রাখুন। তিন দিন পর আপনি যা ইচ্ছা বলতে পারেন।
যাই হোক হাজ্জাজের স্ত্রী তার সমস্ত সম্পদ একত্রিত করল। সম্পদগুলো নিয়ে হাজ্জাজ দ্রুত গতিতে মদ্বীনার উদ্দেশ্যে বের হয়ে পড়লেন।
তিন দিন পার হওয়ার পর আববাস (রাঃ) হাজ্জাজের স্ত্রীর নিকট গিয়ে বললেন- তোমার স্বামীর খবর কি ?
সে বলল- তিনি তো মদ্বীনায় গমণ করেছেন। হে আবুল ফজল ! আল্লাহ্ আপনাকে চিন্তামুক্ত রাখুন। আপনার ভাতিজার খবর শুনে আমরাও দুশ্চিন্তাগ্রস্ত। তিনি বললেন- হ্যাঁ, ঠিক আছে।
আল্লাহ্ আমাকে দুশ্চিন্তাগ্রস্ত করবেন না। আমি যা পছন্দ করি, আল্লাহর মেহেরবানীতে তাই হবে, আল্লাহ্ তা‘আলা তাঁর রসূলকে খায়বারের বিজয় দান করেছেন।
তাতে আল্লাহর ফয়সালা কার্যকর হয়েছে। সেই সাথে আমার ভাতিজা খায়বারের রাজার মেয়েকে বিয়েও করে ফেলেছেন।
এখন যদি তোমার স্বামীর প্রতি তোমার দরদ থাকে, তাহলে মদ্বীনায় গিয়ে তাড়াতাড়ি তাঁর সাথে মিলিত হও।
হাজ্জাজের স্ত্রী বলল- আমার ধারণা আপনি ঠিকই বলেছেন। আববাস বললেন- আল্লাহর শপথ! আমি সত্য বলছি। আমি যা বলছি, বাস্তবেও তাই।
এবার হাজ্জাজের স্ত্রী বলল- আপনাকে এ বিষয়ে কে খবর দিয়েছে ?
আববাস (রাঃ) বললেন- তোমাকে যে ব্যক্তি এ বিষয়ে খবর দিয়েছেন, আমাকেও তিনি খবর দিয়েছেন।
অর্থাৎ তোমার স্বামীই আমাকে তা জানিয়েছেন। এরপর আববাস কুরাইশদের মজলিসের দিকে গেলেন।
কুরাইশরা আববাসকে দেখেই বলতে লাগল- আল্লাহর শপথ ! হে আবুল ফজল ! আপনাকে খুশী খুশী মনে হচ্ছে !
মনে হচ্ছে আপনার কল্যাণ ছাড়া অন্য কিছু হয়নি। তিনি বললেন- হ্যাঁ, আমার কোন অকল্যাণ হয়নি। আলহামদুলিল্লাহ। হাজ্জাজ আমাকে এই এই খবর দিয়েছেন।
অর্থাৎ খায়বারবাসীর উপর আমার ভাতিজা মুহাম্মাদের জয়লাভের খবর দিয়েছেন, বিশেষ প্রয়োজনে তিনি আমাকে এই খবরটি তিন দিন গোপন রাখতে বলেছেন।
তাই তিন দিন অতিবাহিত হওয়ার পর আজ আমি তোমাদেরকে সেই সুখবরটি দিচ্ছি। মক্কাতে খবরটি ছড়িয়ে পড়লে মুসলিমগণ দ্রুত বের হয়ে আববাস (রাঃ) এর কাছে গেলেন।
তিনি তাদেরকে সংবাদটি শুনালেন। এই খবরের মাধ্যমে আল্লাহ্ তা‘আলা মুসলিমদের দুশ্চিন্তা ও পেরেশানী দূর করে দিলেন এবং তাদের চেহারা আনন্দে উজ্জ্বল হয়ে উঠল
Read More: উহুদ যুদ্ধের কাহিনী
ভূমিকা : লিখতে গিয়ে যদি ভূল হয়ে থাকে তাহলে ক্ষমা সুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন।
এবং কোন সাজেশন এর প্রয়োজন হলে আমাকে ইমেইল এর মধ্যেমে জানিয়ে দিবেন !
ভালো লাগলে শেয়ার করবেন,
সাথে থাকার জন্য ধন্যবাদ ।