নবীর দাওয়াতী জীবন কাহিনী
দাওয়াতী জীবনঃ
নবীদের দাওয়াতকে গোপনে ও প্রকাশ্যে দু’ভাগে ভাগ করার কোন সুযোগ নেই। কেননা তাঁরা নিজ সম্প্রদায়ের নিকট প্রকাশ্যভাবেই নবুঅতের দাবী নিয়ে দাওয়াত শুরু করেন।
প্রত্যেক নবীই তার কওমকে বলেছেন, يَا قَوْمِ اعْبُدُوا اللهَ مَا لَكُمْ مِنْ إِلَهٍ غَيْرُهُ ‘হে আমার কওম! তোমরা আল্লাহর ইবাদত কর। তিনি ব্যতীত তোমাদের কোন উপাস্য নেই।
[1] আমাদের নবীও বলেছেন, يَا أَيُّهَا النَّاسُ إِنِّي رَسُولُ اللهِ إِلَيْكُمْ جَمِيعًا ‘হে মানবজাতি! আমি তোমাদের সকলের প্রতি আল্লাহর প্রেরিত রাসূল..’ (আ‘রাফ ৭/১৫৮)।
তবে এটাই স্বাভাবিক যে, আপনজনদের নিকটেই প্রথমে দাওয়াত দেওয়া হয়। আর এই দাওয়াত স্থান-কাল-পাত্রভেদে কখনো গোপনে কখনো প্রকাশ্যে কখনো সর্বসমক্ষে হয়ে থাকে।
ইবনু ইসহাক বিনা সনদে উল্লেখ করেন, তার নিকটে এই মর্মে খবর
পৌঁছেছে যে, আল্লাহ তাকে প্রকাশ্যে দাওয়াত দেওয়ার নির্দেশ দানের আগ পর্যন্ত রাসূল (সঃ) তিন বছর গোপনে দাওয়াত দিয়েছেন (ইবনু হিশাম ১/২৬২)।
ইবনু সা‘দ এবং ওয়াক্বেদীও সে কথা বলেছেন। বালাযুরী এটাকে চার বছর বলেছেন।
অনেক জীবনীকার এই মেয়াদের উপর ভিত্তি করে শেষ নবী হযরত মুহাম্মদ (সঃ)-এর দাওয়াতের মেয়াদ নির্দিষ্ট করেছেন।
অথচ দাওয়াতের এইরূপ সীমা নির্ধারণ করার কোন দলীল নেই’ (মা শা-‘আ ২৯ পৃঃ)।
যেকোন সংস্কার আন্দোলন শুরু করতে গেলে প্রথমে তা গোপনেই শুরু করতে হয়।
পুরা সমাজ যেখানে ভোগবাদিতায় ডুবে আছে, সেখানে ভোগলিপ্সাহীন আখেরাতভিত্তিক সমাজ প্রতিষ্ঠার দাওয়াত নিয়ে অগ্রসর হওয়া সাগরের স্রোত পরিবর্তনের ন্যায় কঠিন কাজ।
এ পথের দিশা দেওয়া এবং এ পথে মানুষকে ফিরিয়ে আনা দু’টিই কঠিন বিষয়। রাসূলুল্লাহ (সঃ) সেকাজের জন্যই আদিষ্ট হয়েছিলেন। অহী প্রাপ্ত হওয়ার পরেই খাদীজার সাথে তিনি সে সময়ে মক্কার বয়োবৃদ্ধ সেরা বিদ্বান অরাক্বা বিন নওফাল-এর কাছে যান।
তিনি সবকিছু অবগত হওয়ার পর তাঁকে ভবিষ্যৎ বিরোধিতা ও আসন্ন বিপদ সম্পর্কে সাবধান করে দেন। ফলে তিনি প্রথমে গোপনে দাওয়াত শুরু করেন।
যদিও হযরত খাদীজা, হযরত আলী, হযরত আবুবকর, হযরত ওসমান প্রমুখদের মত মক্কার সেরা ও প্রসিদ্ধ ব্যক্তিগণের ইসলাম কবুলের পর এই দাওয়াত আদৌ গোপন থাকেনি।
[1]. আ‘রাফ ৭/৫৯, ৬৫, ৭৩, ৮৫; হূদ ১১/৫০, ৬১, ৮৪; মুমিনূন ২৩/২৩; আনকাবূত ২৯/৩৬।
প্রাথমিক মুসলমানগণ
প্রথমেই তাঁর দাওয়াত কবুল করেন মহিলাদের মধ্যে তাঁর পুণ্যশীলা স্ত্রী খাদীজা বিনতে খুওয়াইলিদ (রাঃ)। অতঃপর গোলামদের মধ্যে তাঁর মুক্তদাস যায়েদ বিন হারেছাহ, শিশু-কিশোরদের মধ্যে আলী ইবনু আবী তালিব এবং বয়স্কদের মধ্যে নিকটতম বন্ধু আবুবকর ইবনু আবী কুহাফাহ (রাযিয়াল্লাহু ‘আনহুম)।
অতঃপর আবুবকর (রাঃ)-এর দাওয়াতে ইসলাম কবুল করেন একে একে ওছমান, যুবায়ের, আব্দুর রহমান বিন ‘আওফ, সা‘দ বিন আবু ওয়াক্কাছ ও তালহা বিন ওবায়দুল্লাহ (রাযিয়াল্লাহু ‘আনহুম)।
এছাড়া হযরত আবুবকরের স্ত্রী উম্মে রূমান ও মা বার্রাহ এবং দুই মেয়ে হযরত আসমা (রা:) ও হযরত আয়েশা (রা:) । এছাড়া আবুবকর (রাঃ) কর্তৃক ৭ জন মুক্তদাস-দাসী হ’লেন, ‘আমের বিন ফুহাইরা, উম্মে উবাইস, যিন্নীরাহ, নাহদিয়াহ ও তার মেয়ে এবং বনু মুআম্মাল-এর জনৈকা দাসী এবং বেলাল বিন রাবাহ।
[1] অতঃপর একে একে ইসলাম কবুল করেন-
আবু ওবায়দাহ ইবনুল জার্রাহ,
আবু সালামাহ,
আরক্বাম,
ওছমান বিন মায‘ঊন ও তাঁর দুই ভাই কুদামাহ ও আব্দুল্লাহ,
ওবায়দুল্লাহ বিন হারেছ,
সাঈদ বিন যায়েদ ও তাঁর স্ত্রী ফাতেমা বিন খাত্ত্বাব (ওমরের বোন)।
খাববাব ইবনুল আরাত,
ওমায়ের বিন আবু ওয়াক্কাছ,
আব্দুল্লাহ বিন মাসঊদ,
মাসঊদ বিন রাবী‘আহ আল-ক্বারী,
সালীত্ব বিন আমর ও তাঁর ভাই হাতেব বিন আমর,
আইয়াশ বিন আবু রাবী‘আহ ও তাঁর স্ত্রী আসমা বিনতে সালামাহ।
খুনাইস বিন হুযাফাহ,
আমের বিন রবী‘আহ, আব্দুল্লাহ বিন জাহশ,
জাফর বিন আবু তালিব ও তাঁর স্ত্রী আসমা বিনতে উমায়েস,
নু‘আইম বিন আব্দুল্লাহ,
খালেদ বিন সাঈদ ইবনুল ‘আছ ও তাঁর স্ত্রী উমাইনাহ বিনতে খালাফ।
হাতেব বিন আমর,
আবু হুযায়ফা বিন উৎবা,
ওয়াক্বিদ বিন আব্দুল্লাহ,
খালেদ বিন বুকায়ের ও তার ভাইগণ আমের,
আক্বিল ও ইয়াস,
আম্মার,
পিতা ইয়াসির ও মাতা সুমাইয়া,
ছুহায়েব রূমী,
আমর বিন আবাসাহ,
মিক্বদাদ ইবনুল আসওয়াদ,
আফীফ বিন ক্বায়েস।
হযরত খাদীজা (রাঃ)-এর পরে রাসূল (সঃ)-এর চাচা আববাস-এর স্ত্রী উম্মুল ফযল ও তাঁর গোলাম আবু রাফে‘ ইসলাম কবুল করেন। ইবনু ইসহাকের বর্ণনা মতে প্রথম তিন বছরে উপরোক্ত ব্যক্তিগণ ইসলাম গ্রহণের পর মক্কায় ইসলাম প্রকাশ্য হয়ে পড়ে ও তা নিয়ে লোকদের মধ্যে আলোচনা হতে থাকে।
[2] উপরে যাদের নামের তালিকা দেওয়া হ’ল, তারা কুরায়েশ বংশের প্রায় সকল শাখা-প্রশাখার সাথে সরাসরি কিংবা আত্মীয়তাসূত্রে যুক্ত ছিলেন। কুরায়েশ নেতাদের কাছে এঁদের খবর পৌঁছে গিয়েছিল। কিন্তু তারা এটাকে স্রেফ ব্যক্তিগত ধর্মাচার মনে করেছিলেন।
[3] ফলে তাদের অনেকেই কুরায়েশ নেতাদের হাতে চরমভাবে নির্যাতিত হন।
[1]. হাকেম হা/৫২৪১, হাদীছ ছহীহ; ইবনু হিশাম ১/৩১৭-১৯।
[2]. ইবনু হিশাম ১/২৪৫-৬২; আল-বিদায়াহ ৩/২৪-৩২; আর-রাহীক্ব ৭৬ পৃঃ।
প্রসিদ্ধ আছে যে, আলীকে রাসূল (সঃ) নিজে লালন-পালন করার কারণেই তিনি প্রথম ইসলাম কবুল করেন। কারণ আবু ত্বালিব ছিলেন বহু পোষ্য বিশিষ্ট একটি বড় পরিবারের অধিকারী।
এটা দেখে রাসূল (সঃ) তাঁর চাচা আববাসকে বললেন, যিনি ছিলেন বনু হাশিমের মধ্যে অধিকতর সচ্ছল ব্যক্তি। হে আববাস! আপনার ভাই আবু ত্বালিব বড় পরিবারের অধিকারী।
তার উপরে কি বিপদ নাযিল হয়েছে তা তো আপনি দেখছেন। অতএব চলুন! আমরা গিয়ে তাঁর পরিবারের বোঝা কিছুটা হালকা করি। অতঃপর তারা গেলেন এবং রাসূল (সঃ) আলীকে ও আববাস জা‘ফরকে স্ব স্ব দায়িত্বে গ্রহণ করলেন’ (ইবনু হিশাম ১/২৪৬)।
ঘটনাটি বিশুদ্ধভাবে প্রমাণিত নয় (মা শা-‘আ ২১ পৃঃ)। ইবনু আববাস বলেন, খাদীজার পরে আল্লাহর উপর প্রথম ঈমান আনেন আলী’ (আল-ইস্তী‘আব, আলী বিন আবী ত্বালিব ক্রমিক ১৮৫৫; মা শা-‘আ ২২ পৃঃ)।
[3]. ইবনু হিশাম ১/২৪৭, আর-রাহীক্ব ৭৭ পৃঃ।
ছালাতের নির্দেশনা
যেকোন সংস্কার আন্দোলনের জন্য সর্বাগ্রে প্রয়োজন আক্বীদার মযবুতী। আর এই মযবুতীর জন্য চাই নিয়মিত আধ্যাত্মিক প্রশিক্ষণ। যা সর্বদা সংস্কারককে তার আদর্শমূলে দৃঢ়ভাবে ধরে রাখে।
সেকারণ অধ্যাত্ম সাধনার প্রাথমিক কাজ হিসাবে মুহাম্মাদ (সঃ)-কে নবুঅতের শুরু থেকেই সকাল ও সন্ধ্যায় দু’বার ছালাত আদায়ের নির্দেশনা দান করা হয়। যেমন আল্লাহ বলেন, وَسَبِّحْ بِحَمْدِ رَبِّكَ بِالْعَشِيِّ وَالْإِبْكَارِ ‘তুমি তোমার প্রভুর প্রশংসা জ্ঞাপন কর সন্ধ্যায় ও সকালে’ (মুমিন/গাফের ৪০/৫৫)।
প্রথম কুরআন নাযিলের পর জিব্রীলের মাধ্যমে তিনি ওযূ ও ছালাত শিখেন।
[1] হিজরতের স্বল্পকাল পূর্বে মে‘রাজ সংঘটিত হবার আগ পর্যন্ত ফজরের দু’রাক‘আত ও আছরের দু’রাক‘আত করে ছালাত আদায়ের নিয়ম জারী থাকে। আয়েশা (রাঃ) বলেন, শুরুতে ছালাত বাড়ীতে ও সফরে ছিল দু’ দু’ রাক‘আত করে।
[2] এছাড়া রাসূল (সঃ)-এর জন্য ‘অতিরিক্ত’ (نَافِلَةً) ছিল তাহাজ্জুদের ছালাত (ইসরা/বনু ইস্রাঈল ১৭/৭৯)। সেই সাথে ছাহাবীগণও নিয়মিতভাবে রাত্রির নফল ছালাত আদায় করতেন।
[3] অতঃপর মি‘রাজের রাত্রিতে নিয়মিতভাবে দৈনিক পাঁচ ওয়াক্ত ছালাত ফরয করা হয়।
[4] উল্লেখ্য যে, পূর্বেকার সকল নবীর সময়ে ছালাত, ছিয়াম ও যাকাত ফরয ছিল। তবে সেসবের ধরন ও পদ্ধতি ছিল কিছুটা পৃথক।
রাসূলুল্লাহ (সঃ) ও তাঁর সাথীগণ প্রথম দিকে গোপনে এই ছালাত আদায় করতেন এবং লোকদেরকে গাছ, পাথর, চন্দ্র, সূর্য ইত্যাদির উপাসনা পরিত্যাগ করে আল্লাহর ইবাদত শিক্ষা দিতেন।
তিনি কখনো কখনো সাথীদের নিয়ে পাহাড়ের গুহাতে গোপনে ছালাত আদায় করতেন। একদিন আবু ত্বালিব স্বীয় পুত্র আলী ও ভাতিজা মুহাম্মাদকে এটা আদায় করতে দেখে কারণ জিজ্ঞেস করেন। সবকিছু শুনে বিষয়টির আধ্যাত্মিক গুরুত্ব উপলব্ধি করে তিনি তাদেরকে উৎসাহিত করেন।
[5] উর্দূ কবি বলেন,
ہوا كو پهرانا دشور ، موج كو الٹانا دشور
ليكن اتنا نہ جتنا، بهٹكى ہوئى قوم كو راه پر لانا دشور
‘বায়ু প্রবাহ ফিরানো কঠিন, স্রোতকে উল্টানো কঠিন। কিন্তু অত কঠিন নয়, যত না কঠিন একটা পথভ্রষ্ট জাতিকে সুপথে ফিরিয়ে আনা।
[1]. আহমাদ হা/১৭৫১৫, দারাকুৎনী হা/৩৯৯, মিশকাত হা/৩৬৬ ‘পবিত্রতা’ অধ্যায় ৩ অনুচ্ছেদ; ছহীহাহ হা/৮৪১।
[2]. মুসলিম হা/৬৮৫; আবুদাঊদ হা/১১৯৮; ফিক্বহুস সুন্নাহ ১/২১১।
[3]. মুযযাম্মিল ৭৩/২০; তাফসীরে কুরতুবী।
[4]. বুখারী হা/৩২০৭; মুসলিম হা/১৬২; মিশকাত হা/৫৮৬২-৬৫ ‘ফাযায়েল ও শামায়েল’ অধ্যায়-২৯, ‘মি‘রাজ’ অনুচ্ছেদ-৬।
[5]. ইবনু হিশাম ১/২৪৬-৪৭। তবে বর্ণনাটির সূত্র যঈফ; মাজদী ফাৎহী সাইয়িদ, তাহকীক ইবনু হিশাম (দারুছ ছাহাবা লিত তুরাছ, তান্তা, কায়রো, ১ম সংস্করণ ১৪১৬ হিঃ/১৯৯৫ খৃঃ) ক্রমিক ২৪৫।
দাওয়াতের সারবস্ত্তঃ
এই সময় দাওয়াতের সারবস্ত্ত ছিল পাঁচটি।
(১) তাওহীদ
(২) রিসালাত
(৩) আখেরাত বিশ্বাস
(৪) তাওয়াক্কুল তথা আল্লাহর উপরে ভরসা এবং উক্ত বিশ্বাসসমূহের আলোকে
(৫) তাযকিয়াহ বা আত্মশুদ্ধি অর্জন করা।
বস্ত্ততঃ রাসূল (সঃ)-এর সরাসরি নির্দেশনায় এই প্রশিক্ষণ পরিচালিত হ’ত। এভাবে তিনি আত্মিক শক্তিতে বলীয়ান একদল নিবেদিতপ্রাণ মানুষ গড়ে তুলতে সমর্থ হন। যাঁদের হাতেই পরবর্তীকালে ইসলামের বস্ত্তগত বিজয় সাধিত হয়।
কয়েক বছর যাবৎ সীমিতভাবে দাওয়াত দেওয়ার পর এবার আল্লাহর হুকুম হল বৃহত্তর পরিসরে প্রকাশ্য দাওয়াত দেওয়ার জন্য।
নাযিল হ’ল, فَاصْدَعْ بِمَا تُؤْمَرُ وَأَعْرِضْ عَنِ الْمُشْرِكِينَ- إِنَّا كَفَيْنَاكَ الْمُسْتَهْزِئِينَ ‘অতএব তুমি যে বিষয়ে আদিষ্ট হয়েছ, তা প্রকাশ্যে ব্যক্ত কর এবং মুশরিকদের উপেক্ষা কর।
বিদ্রুপকারীদের বিরুদ্ধে আমরাই তোমার জন্য যথেষ্ট’ (হিজর ১৫/৯৪-৯৫)। আরও নাযিল হ’ল, وَأَنْذِرْ عَشِيرَتَكَ الْأَقْرَبِينَ ‘তুমি তোমার নিকটাত্মীয়দের সতর্ক কর’ (শো‘আরা ২৬/২১৪)।
কিন্তু এতে কুরায়েশ নেতাদের প্রতিক্রিয়া যে অত্যন্ত কষ্টদায়ক হবে, সে বিষয়ে আগেভাগেই স্বীয় নবীর মন-মানসিকতাকে প্রস্ত্তত করে নেন সূরা শো‘আরা নাযিল করে।
২২৭ আয়াত বিশিষ্ট এই বিরাট সূরার শুরুতেই আল্লাহ স্বীয় নবীকে বলেন, لَعَلَّكَ بَاخِعٌ نَّفْسَكَ أَلاَّ يَكُونُوا مُؤْمِنِينَ، إِنْ نَشَأْ نُنَزِّلْ عَلَيْهِم مِّنَ السَّمَاء آيَةً فَظَلَّتْ أَعْنَاقُهُمْ لَهَا خَاضِعِينَ- (الشعراء ৩-৪) ‘লোকেরা এতে বিশ্বাস স্থাপন করছে না দেখে তুমি হয়ত মর্মবেদনায় নিজেকে শেষ করে ফেলবে।
আমরা চাইলে আকাশ থেকে তাদের উপরে এমন নিদর্শন (শাস্তি) নাযিল করতাম, যার সামনে তাদের গর্দান অবনত হয়ে যেত’ (শো‘আরা ২৬/৩-৪)।
এর দ্বারা বুঝানো হয়েছে যে, অহংকারী সমাজনেতাদের আচরণে বেদনাহত হয়ে তাওহীদের দাওয়াত থেকে পিছিয়ে আসা যাবে না। বরং আল্লাহর উপরে ভরসা রেখে বুকে বল নিয়ে সামনে এগিয়ে যেতে হবে।
এরপর আল্লাহ অতীতের সাতজন শ্রেষ্ঠ নবীর দাওয়াতী জীবন ও তাদের স্ব স্ব কওমের অবাধ্যাচরণ ও তাদের মন্দ পরিণতি সংক্ষেপে আবেগময় ভাষায় বর্ণনা করেছেন। যাতে আগামীতে বৃহত্তর দাওয়াতের রূঢ় প্রতিক্রিয়া সহ্য করতে শেষনবীর কোনরূপ মনোকষ্ট না হয়।
শুরুতেই হযরত মূসা (আঃ)-এর জীবনালেখ্য ১০-৬৮ আয়াত পর্যন্ত, অতঃপর ইবরাহীম (আঃ) ৬৯-১০৪, তারপর নূহ (আঃ) ১০৫-১২২, অতঃপর হূদ (আঃ)-এর কওমে ‘আদ ১২৩-১২৪, তারপর হযরত ছালেহ (আঃ)-এর কওমে ছামূদ ১৪১-১৫৯, তারপর লূত্ব (আঃ)-এর কওম ১৬০-১৭৫,
অতঃপর হযরত শু‘আয়েব (আঃ)-এর কওম আছহাবুল আইকাহ ১৭৬-১৯১ পর্যন্ত তাদের স্ব স্ব কওমের উপর আসমানী গযবসমূহ নাযিল হওয়ার ঘটনাবলী বর্ণনা করার পর সবশেষে আল্লাহ স্বীয় রাসূলকে উদ্দেশ্য করে বলেন,
فَلاَ تَدْعُ مَعَ اللهِ إِلَهاً آخَرَ فَتَكُوْنَ مِنَ الْمُعَذَّبِيْنَ- وَأَنذِرْ عَشِيْرَتَكَ الْأَقْرَبِيْنَ- وَاخْفِضْ جَنَاحَكَ لِمَنِ اتَّبَعَكَ مِنَ الْمُؤْمِنِيْنَ- فَإِنْ عَصَوْكَ فَقُلْ إِنِّيْ بَرِيءٌ مِّمَّا تَعْمَلُوْنَ- وَتَوَكَّلْ عَلَى الْعَزِيْزِ الرَّحِيْمِ- (الشعراء ২১৩-২১৭)-
অতএব তুমি আল্লাহর সাথে অন্য কোন উপাস্যকে আহবান করো না। তাতে তুমি শাস্তিপ্রাপ্তদের অন্তর্ভুক্ত হবে। তুমি তোমার নিকটাত্মীয়দের সতর্ক কর।
এবং তোমার অনুসারী মুমিনদের প্রতি সদয় হও। ‘অতঃপর যদি তারা তোমার অবাধ্যতা করে, তবে বলে দাও, তোমরা যা কর, তা থেকে আমি মুক্ত’। আর তুমি ভরসা কর মহাপরাক্রমশালী দয়ালু সত্তার উপরে’ (শো‘আরা ২৬/২১৩-১৭)।
উল্লেখ্য যে, কুরআনে বর্ণিত নবীগণের উপরোক্ত ক্রমধারায় আগপিছ রয়েছে। প্রকৃত ক্রমধারা হবে প্রথমে নূহ (আঃ), অতঃপর হূদ, অতঃপর ছালেহ, অতঃপর ইবরাহীম, লূত্ব, শু‘আয়েব ও মূসা (‘আলাইহিমুস সালাম)।
কুরআনের বর্ণনাভঙ্গি অনুযায়ী বিভিন্ন স্থানে এরূপ আগপিছ হয়েছে। কেননা ধারাবাহিক ইতিহাস বর্ণনা করা নয়, বরং বিষয়বস্ত্ত পেশ করাই হল কুরআনের মূল উদ্দেশ্য।
এলাহী নির্দেশের সারকথা
বর্ণিত পাঁচটি আয়াতের প্রথমটিতে (২১৩) রাসূল (সঃ)-কে তাওহীদের উপরে দৃঢ় থাকার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে এবং সম্প্রদায়ের ভয়ে শিরকের সাথে আপোষ করলে এলাহী গযবের ধমকি প্রদান করা হয়েছে।
দ্বিতীয় আয়াতে (২১৪) নিজ নিকটাত্মীয়দেরকে জাহান্নাম হতে সতর্ক করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। এতে অবশ্যই একদল তাঁর পক্ষে আসবে, একদল তার বিপক্ষে যাবে।
এটা নিশ্চিত জেনেই বলা হয়েছে, তোমার অনুসারী মুমিনদের প্রতি তুমি সদয় হও এবং বিরোধীদের বলে দাও যে, তোমাদের কর্মের ব্যাপারে আমি দায়মুক্ত। কেননা আমার দায়িত্ব ছিল তোমাদেরকে আল্লাহর পথে ডাকা।
সে দায়িত্ব আমি পালন করেছি। না মানলে তার ফল ভোগ করবে তোমরাই। শেষে বলা হয়েছে, তাদের বিরোধিতায় তুমি মোটেই ঘাবড়াবেনা। বরং সর্বাবস্থায় আল্লাহর উপরে ভরসা করবে।
ছাফা পাহাড়ের দাওয়াত
নিকটাত্মীয়দের প্রতি প্রকাশ্যে দাওয়াত দেওয়ার জন্য রাসূলুল্লাহ (সঃ) কুরায়েশ বংশের সকল গোত্রকে একত্রিত করে তাদের সামনে দাওয়াত দেবার মনস্থ করলেন।
তৎকালীন সময়ে নিয়ম ছিল যে, বিপদসূচক কোন খবর থাকলে পাহাড়ের চূড়ায় উঠে চিৎকার দিয়ে আহবান করতে হ’ত। আসন্ন কোন বিপদের আশংকা করে তখন সবাই সেখানে ছুটে আসত।
রাসূলুল্লাহ (সঃ) সেমতে একদিন ছাফা পাহাড়ের চূড়ায় উঠে চিৎকার দিয়ে ডাক দিলেন, يَا صَبَاحَاه (প্রত্যুষে সবাই সমবেত হও!)। কুরায়েশ বংশের সকল গোত্রের লোক দ্রুত সেখানে জমা হয়ে গেল।
অতঃপর তিনি বললেন, হে কুরায়েশগণ !
আমি যদি বলি, এই পাহাড়ের অপর পার্শ্বে একদল শক্তিশালী শত্রুসৈন্য তোমাদের উপরে হামলার জন্য অপেক্ষা করছে, তাহ’লে কি তোমরা সে কথা বিশ্বাস করবে? সকলে সমস্বরে বলে উঠল, অবশ্যই করব।
কেননা مَا جَرَّبْنَا عَلَيْكَ إِلاَّ صِدْقًا ‘আমরা এযাবৎ তোমার কাছ থেকে সত্য ব্যতীত কিছুই পাইনি’। তখন রাসূল (সঃ) বললেন, فَإِنِّىْ نَذِيْرٌ لَكُمْ بَيْنَ يَدَىْ عَذَابٍ شَدِيْدٍ ‘আমি ক্বিয়ামতের কঠিন আযাবের প্রাক্কালে তোমাদের নিকটে সতর্ককারী রূপে আগমন করেছি।
অতঃপর তিনি আবেগময় কণ্ঠে এক একটি গোত্রের নাম ধরে ধরে ডেকে বলতে থাকলেন, يَامَعْشَرَ قُرَيْشٍ! أَنْقِذُوْا أَنْفُسَكُمْ مِنَ النَّارِ ‘হে কুরায়েশগণ !
তোমরা নিজেদেরকে জাহান্নামের আগুন থেকে বাঁচাও! হে বনু কা‘ব বিন লুওয়াই ! হে বনু ‘আব্দে মানাফ!... হে বনু ‘আব্দে শাম্স!.. হে বনু হাশেম!... হে বনু আব্দিল মুত্ত্বালিব! তোমরা নিজেদেরকে জাহান্নামের আগুন থেকে বাঁচাও।
অতঃপর ব্যক্তির নাম ধরে ধরে বলেন, হে (চাচা) আববাস বিন আব্দুল মুত্ত্বালিব! তুমি নিজেকে জাহান্নামের আগুন থেকে বাঁচাও! হে (ফুফু) ছাফিইয়াহ !
তুমি নিজেকে জাহান্নামের আগুন থেকে বাঁচাও। অবশেষে يَا فَاطِمَةَ بِنْتَ مُحَمَّدٍ! أَنْقِذِىْ نَفْسَكِ مِنَ النَّارِ، سَلِيْنِىْ مَا شِئْتِ مِنْ مَالِىْ، وَاللهِ لاَ أُغْنِيْ عَنْكِ مِنَ اللهِ شَيْئًا ‘হে মুহাম্মাদের কন্যা ফাতেমা !
তুমি নিজেকে জাহান্নামের আগুন থেকে বাঁচাও ! তুমি আমার মাল-সম্পদ থেকে যা খুশী নাও! কিন্তু আল্লাহর কসম! আমি তোমাকে আল্লাহর পাকড়াও হ’তে রক্ষা করতে পারব না।
এই মর্মস্পর্শী আবেদন গর্বোদ্ধত চাচা আবু লাহাবের অন্তরে দাগ কাটেনি। তিনি মুখের উপর বলে দিলেন- تَبًّا لَكَ سَائِرَ الْيَوْمِ، أَلِهَذَا جَمَعْتَنَا؟ ‘সকল দিনে তোমার উপরে ধ্বংস আপতিত হৌক !
এজন্য তুমি আমাদের জমা করেছ?’ অতঃপর সূরা লাহাব নাযিল হয় تَبَّتْ يَدَا أَبِي لَهَبٍ وَتَبَّ ‘ধ্বংস হৌক আবু লাহাবের দু’হাত এবং ধ্বংস হৌক সে নিজে।
[2] এভাবে নিজ সম্প্রদায়কে এবং বাজারে-ঘাটে সর্বত্র বিশেষ করে হজ্জের মৌসুমে সকলকে উদ্দেশ্য করে তিনি প্রকাশ্যে দাওয়াত দিতে থাকেন এই মর্মে যে, قُوْلُوْا لآ إِلَهَ إِلاَّ اللهُ تُفْلِحُوْا ‘তোমরা বল আল্লাহ ছাড়া কোন উপাস্য নেই, তাহ’লে তোমরা সফলকাম হবে’।
[1]. বুখারী হা/৪৭৭০; মুসলিম হা/২০৮; মিশকাত হা/৫৩৭২, ৫৮৪৬।
[2]. বুখারী হা/২৭৫৩, মুসলিম হা/২০৮; মিশকাত হা/৫৩৭২-৭৩।
[3]. আহমাদ হা/১৬০৬৬, সনদ হাসান; হাকেম হা/৩৯, ৪২১৯ সনদ ছহীহ।
উল্লেখ্য যে, নিকটাত্মীয়দের দাওয়াত দেওয়ার আদেশ পালন করতে গিয়ে রাসূল (সঃ) প্রথমে বনু হাশেম ও বনু আব্দুল মুত্ত্বালিবের ৪৫জন নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিকে বাড়িতে দাওয়াত দেন।
কিন্তু আবু লাহাবের বিরোধিতার কারণে উক্ত দাওয়াত ব্যর্থ হ’লে পুনরায় দ্বিতীয়বার তাদেরকে দাওয়াত দেন।
তখন আবু লাহাব প্রকাশ্যে বিরোধিতা করেন এবং আবু ত্বালেব তাঁকে আমৃত্যু সাহায্য করার দৃঢ় প্রত্যয় ব্যক্ত করেন (আর-রাহীক্ব ৭৮-৭৯ পৃঃ) মর্মে বক্তব্যগুলির কোন বিশুদ্ধ ভিত্তি নেই (সীরাহ ছহীহাহ ১/১৪২-৪৩)।
আবু লাহাবের পরিচয়
(১) আবু লাহাব ছিলেন আব্দুল মুত্ত্বালিবের অন্যতম পুত্র। তার নাম ছিল আব্দুল ‘উযযা। গৌর-লাল বর্ণ ও সুন্দর চেহারার অধিকারী হওয়ার কারণে তাকে ‘আবু লাহাব’ অর্থাৎ ‘অগ্নিস্ফুলিঙ্গ ওয়ালা’ বলা হ’ত। আল্লাহ তার জন্য এই নামই পসন্দ করেছেন।
কেননা এর মধ্যে তার জাহান্নামী হওয়ার দুঃসংবাদটিও লুকিয়ে ছিল। তাছাড়া আব্দুল ‘উযযা নাম কুরআনে থাকাটা তাওহীদের সাথে সাংঘর্ষিক। আবু লাহাব ছিলেন রাসূল (ছাঃ)-এর আপন চাচা এবং নিকটতম প্রতিবেশী।
(২) তার দুই ছেলে উৎবা ও উতাইবার সাথে নবুঅত-পূর্বকালে রাসূল (সঃ)-এর দুই মেয়ে রুক্বাইয়া ও উম্মে কুলছূমের বিবাহ হয়।
কিন্তু নবী হওয়ার পরে তিনি তার ছেলেদেরকে তাদের স্ত্রীদের তালাক দিতে বাধ্য করেন। এই দুই মেয়েই পরবর্তীতে একের পর এক হযরত ওছমান (রাঃ)-এর সাথে বিবাহিতা হন।
(৩) নবুঅত লাভের পর দ্বিতীয় পুত্র আব্দুল্লাহ (যার লকব ছিল ত্বাইয়েব ও ত্বাহের) মারা গেলে তিনি খুশীতে বাগবাগ হয়ে সবার কাছে গিয়ে বলেন, মুহাম্মাদ এখন লেজকাটা নির্বংশ (الْأَبْتَرُ) হয়ে গেল।
যার প্রেক্ষিতে সূরা কাওছার নাযিল হয়। কেননা সেযুগে কারু ছেলে সন্তান না থাকলে তাকে উক্ত নামে অভিহিত করা হত।
(৪) হজ্জের মৌসুমে তিনি রাসূল (সঃ)-এর পিছে লেগে থাকতেন। যেখানেই রাসূল (সঃ) দাওয়াত দিতেন,
সেখানেই তিনি তাঁকে গালি দিয়ে লোকদের ভাগিয়ে দিতেন।[2]
[1]. কুরতুবী, তাফসীর সূরা কাওছার ৩ আয়াত।
[2]. আহমাদ হা/১৬০৬৬; ছহীহ ইবনু খুযায়মাহ হা/১৫৯, হাকেম হা/৪২১৯, ২/৬১১।
আবু লাহাবের স্ত্রী
তার স্ত্রী ছিলেন আবু সুফিয়ানের বোন আরওয়া (أروى) অথবা ‘আওরা’ (العوراء) ওরফে উম্মে জামীল বা ‘সুন্দরের উৎস’।
তবে একচক্ষু দৃষ্টিহীন হওয়ায় ইবনুল ‘আরাবী উক্ত মহিলাকে ‘আওরা উম্মে ক্বাবীহ’ (عوراء ام قبيح) ‘এক চক্ষু সকল নষ্টের মূল’ বলেন’ (কুরতুবী)। তিনিও স্বামীর অকপট সহযোগী ছিলেন এবং সর্বদা রাসূল (সঃ)-এর বিরুদ্ধে গীবত-তোহমত ও নিন্দাবাদে মুখর থাকতেন।
চোগলখুরী ও মিথ্যাচারের মাধ্যমে সংসারে বা সমাজে অশান্তির আগুন ধরিয়ে দেওয়া ব্যক্তিকে আরবদের পরিভাষায় حَمَّالَةُ الْحَطَبِ ইন্ধন বহনকারী বা ‘খড়িবাহক’ বলা হত।
অর্থাৎ ঐ শুষ্ককাঠ যাতে আগুন লাগালে দ্রুত আগুন ছড়িয়ে পড়ে। আবু লাহাবের স্ত্রী একাজটিই করতেন পিছনে থেকে। সেকারণ আল্লাহ তাকেও স্বামীর সাথে জাহান্নামে প্রেরণ করবেন।
রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর বিরুদ্ধে হেন অপপ্রচার নেই, যা আবু লাহাব ও তার স্ত্রী করতেন না।
তার স্ত্রী উম্মে জামীল রাসূল (সঃ)-এর বিরুদ্ধে নানাবিধ দুষ্কর্মে পটু ছিলেন।
তিনি রাসূল (সঃ)-এর যাতায়াতের পথে বা তাঁর বাড়ীর দরজার মুখে কাঁটা বিছিয়ে বা পুঁতে রাখতেন। যাতে রাসূল (সঃ) কষ্ট পান। তিনি ছিলেন কবি। ফলে নানা ব্যঙ্গ কবিতা পাঠ করে তিনি লোকদের ক্ষেপিয়ে তুলতেন।
সূরা লাহাব নাযিল হলে রাগে অগ্নিশর্মা হয়ে উক্ত মহিলা হাতে প্রস্তরখন্ড নিয়ে রাসূল (সঃ)-কে মারার উদ্দেশ্যে কা‘বা চত্বরে গমন করেন।
কিন্তু আল্লাহর ইচ্ছায় রাসূল (সঃ) সামনে থাকা সত্ত্বেও তিনি তাঁকে দেখতে পাননি।
[1] তাই পাশে দাঁড়ানো আবুবকরের কাছে তার মনের ঝাল মিটিয়ে কুৎসাপূর্ণ কবিতা বলে ফিরে আসেন। উক্ত কবিতায় তিনি ‘মুহাম্মাদ’ (প্রশংসিত) নামকে বিকৃত করে ‘মুযাম্মাম’ (নিন্দিত) বলেন।
যেমন- مُذَمَّمًا عَصَيْنَا + وَأَمْرَهُ أَبَيْنَا + وَدِيْنَهُ قَلَيْنَا ‘নিন্দিতের আমরা অবাধ্যতা করি’। ‘তার নির্দেশ আমরা অমান্য করি’। ‘তার দ্বীনকে আমরা ঘৃণাভরে প্রত্যাখ্যান করি’।
[1]. মুসনাদে বাযযার হা/১৫; বাযযার বলেন, এর চাইতে উত্তম সনদে বিষয়টি বর্ণিত হয়েছে বলে আমরা জানতে পারিনি; মাজমা‘উয যাওয়ায়েদ হা/১১৫২৯।
[2]. ইবনু হিশাম ১/৩৫৬; হাকেম হা/৩৩৭৬, ২/৩৬১ সনদ ছহীহ; আলবানী, ছহীহ সীরাহ নববিইয়াহ ১৩৭ পৃঃ; তাফসীর কুরতুবী, ইবনু কাছীর; সীরাহ ছহীহাহ ১/১৪৭।
আবু লাহাবের পরিণতি
বদর যুদ্ধের এক সপ্তাহ পরে আবু লাহাবের গলায় প্লেগ মহামারীর ফোঁড়া দেখা দেয়।
আজকের ভাষায় যাকে ‘গুটি বসন্ত’ (Small Pox) বলা যায়। যার প্রভাবে তার সারা দেহে পচন ধরে ও তাতেই তিনি মারা যান। সংক্রামক ব্যাধি হওয়ার কারণে তার পরিবারের লোকেরা তাকে ছেড়ে চলে যায়।
তিনদিন সেখানে লাশ পড়ে থাকার পর দুর্গন্ধের হাত থেকে বাঁচার জন্য কুরায়েশ-এর এক ব্যক্তির সহায়তায় আবু লাহাবের দুই ছেলে লাশটি মক্কার উচ্চ ভূমিতে নিয়ে যায় এবং সেখানেই একটি গর্তে লাঠি দিয়ে ঠেলে ফেলে দেয়।
অতঃপর দূর থেকে পাথর ছুঁড়ে গর্ত বন্ধ করে দেয়।
[1] যিনি একদিন রাসূল (সঃ)-কে পাথর ছুঁড়ে মারতে উদ্যত হয়েছিলেন, তাকেই আজ মরণের পর তার ছেলেরাই পাথর ছুঁড়ে মেরে অনাদরে পুঁতে দিল।
তার বিপুল ধন-সম্পদ ও সন্তান- সন্ততি তার কোনই কাজে আসল না। অহংকারের পরিণাম চিরদিন এরূপই হয়ে থাকে।
[1]. ইবনু হিশাম ১/৬৪৬; বায়হাক্বী দালায়েলুন নবুঅত ৩/১৪৫-১৪৬; আল-বিদায়াহ ৩/৩০৯; আর-রাহীক্ব পৃঃ ২২৫-২৬; কুরতুবী, তাফসীর সূরা লাহাব।
আবু লাহাবের স্ত্রীর পরিণতি
মুররাহ আল-হামদানী বলেন, আবু লাহাবের স্ত্রী উম্মে জামীল প্রতিদিন কাঁটাযুক্ত ঝোপের বোঝা এনে মুসলমানদের চলার পথে ছড়িয়ে দিতেন। ইবনু যায়েদ ও যাহহাক বলেন, তিনি রাতের বেলায় একাজ করতেন।
একদিন তিনি গলায় বোঝা বহন করে আনতে অপারগ হয়ে একটা পাথরের উপরে বসে পড়েন। তখন ফেরেশতা এসে তাকে পিছন থেকে টেনে ধরে হালাক করে দেয়’ (কুরতুবী, তাফসীর সূরা লাহাব)।
আবু লাহাবের সন্তানাদি
আবু লাহাবের উৎবা, উতাইবা ও মু‘আত্তাব নামে তিন পুত্র এবং দুর্রাহ, খালেদা ও ইযযাহ নামে তিন কন্যা ছিল।
তন্মধ্যে উৎবা ও উতাইবা রাসূল (সঃ) দুই কন্যা রুক্বাইয়া ও উম্মে কুলছূমের
স্বামী ছিল। সূরা লাহাব নাযিলের পর আবু লাহাবের নির্দেশে ছেলেরা তাদের স্ত্রীদের তালাক দেয়।
পরবর্তীতে তাঁরা ওছমান (রাঃ)-এর সাথে পরপর বিবাহিতা হন। উম্মে কুলছূমের স্বামী উতাইবা রাসূল (সঃ)-এর বদদো‘আ প্রাপ্ত হয়ে আবু লাহাবের জীবদ্দশায় কুফরী হালতে বাঘের হামলায় নিহত হয়।
বাকী দু’জন পুত্র ও তিন কন্যা মক্কা বিজয়ের পর মুসলমান হন। পুত্রদ্বয় হোনায়েন ও ত্বায়েফ যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন।
হোনায়েন যুদ্ধে সংকটকালে তারা রাসূল (সঃ)-এর নিরাপত্তায় দৃঢ় ছিলেন। মু‘আত্তাব এই যুদ্ধে একটি চোখ হারান। মক্কা বিজয়ের পরে অন্যেরা মদীনায় হিজরত করলেও তারা দু’ভাই আমৃত্যু মক্কায় অবস্থান করেন।
[1]. ইবনু সা‘দ, ত্বাবাক্বাতুল কুবরা ক্রমিক ৩৫৫, ৩৫৬ (৪/৪৪-৪৫ পৃঃ), ৪০৯৯-৪১০০ (৮/২৯-৩১ পৃঃ), ৪১২১-২৩ (৮/৪০ পৃঃ), হাকেম হা/৩৯৮৪; মুহিববুদ্দীন ত্বাবারী (মৃ. ৬৯৪ হি.), যাখায়েরুল ‘উক্ববা (কায়রো : ১৩৫৬ হি.) ২৪৯ পৃঃ।
সর্বস্তরের লোকদের নিকট দাওয়াত
ছাফা পাহাড়ের চূড়ায় দাঁড়িয়ে কুরায়েশদের নিকটে দাওয়াত পৌঁছানোর পর রাসূল (সঃ) এবার সর্বস্তরের মানুষের নিকটে দাওয়াত পৌঁছানোর সিদ্ধান্ত নিলেন।
উল্লেখ্য যে, ঐ সময় মক্কায় বিদ্রূপকারীদের নেতা ছিল পাঁচ জন: বনু সাহম গোত্রের ‘আছ বিন ওয়ায়েল, বনু আসাদ গোত্রের আসওয়াদ বিন মুত্ত্বালিব, বনু যোহরা গোত্রের আসওয়াদ বিন ‘আব্দে ইয়াগূছ, বনু মাখযূম গোত্রের অলীদ বিন মুগীরাহ এবং বনু খুযা‘আহ গোত্রের হারিছ বিন তুলাত্বিলা।
এই পাঁচ জনই আল্লাহর হুকুমে একই সময়ে মৃত্যুবরণ করে। এভাবেই আল্লাহর ওয়াদা সত্যে পরিণত হয় (ইবনু হিশাম ১/৪০৯-১০)।
কেননা আল্লাহ আগেই স্বীয় নবীকে সান্ত্বনা দিয়ে বলেছিলেন, إِنَّا كَفَيْنَاكَ الْمُسْتَهْزِئِينَ ‘তোমাকে বিদ্রুপকারীদের জন্য আমরাই যথেষ্ট’ (হিজর ১৫/৯৫)।
রাসূল (সঃ) মক্কার হাটে-মাঠে-ঘাটে, বাজারে ও বস্তিতে সর্বত্র দাওয়াত ছড়িয়ে দিতে থাকলেন।
তিনি ও তাঁর সাথীরা নিরন্তর প্রচেষ্টা চালাতে থাকেন। এ সময় তাঁরা মূর্তিপূজার অসারতা, শিরকী আক্বীদার অনিষ্টকারিতা এবং তাওহীদের উপকারিতা বুঝাতে থাকেন।
সাথে সাথে মানুষকে আখেরাতে জবাবদিহিতার বিষয়ে সজাগ করতে থাকেন।
স্মর্তব্য যে, মাক্কী জীবনে যে ৮৬টি সূরা নাযিল হয়েছে, তার প্রায় সবই ছিল আখেরাত ভিত্তিক।
এর মাধ্যমে দুনিয়াপূজারী ভোগবাদী মানুষকে আখেরাতমুখী করার চেষ্টা করা হয়েছে। আর এটাই হ’ল যুগে যুগে ইসলামী সমাজ গঠনের প্রধান মাধ্যম।
সেই সাথে আরবদের পারস্পরিক গোত্রীয় হিংসা, দলাদলি ও হানাহানির অবসানকল্পে এবং দাস-মনিব ও সাদা-কালোর উঁচু-নীচু ভেদাভেদ চূর্ণ করার লক্ষ্যে তিনি এক আল্লাহর দাসত্বের অধীনে সকল মানুষের সমানাধিকার ঘোষণা করেন।
দু’টি দাওয়াত দু’টি আনুগত্যের প্রতি
মুহাম্মাদ (সঃ) ও তাঁর চাচা কুরায়েশ নেতা আবু লাহাবের দু’টি দাওয়াত ছিল দু’টি আনুগত্যের প্রতি ও দু’টি সার্বভৌমত্বের প্রতি দাওয়াত।
দু’টি ছিল সম্পূর্ণ পরস্পর বিরোধী দাওয়াত। একটিতে ছিল আল্লাহর সার্বভৌমত্বের অধীনে সকল মানুষের অধিকার সমান। অন্যটিতে ছিল মানুষের সার্বভৌমত্বের অধীনে মানুষ মানুষের গোলাম। নিম্নের হাদীছ দু’টি তার জাজ্বল্যমান প্রমাণ।-
عَنْ مُحَمَّدِ بْنِ الْمُنْكَدِرِ أَنَّهُ سَمِعَ رَبِيعَةَ بْنَ عِبَادٍ الدُّؤَلِيَّ يَقُولُ: رَأَيْتُ رَسُولَ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ بِمِنًى فِي مَنَازِلِهِمْ قَبْلَ أَنْ يُهَاجِرَ إِلَى الْمَدِينَةِ يَقُولُ: يَا أَيُّهَا النَّاسُ، إِنَّ اللهَ يَأْمُرُكُمْ أَنْ تَعْبُدُوهُ وَلاَ تُشْرِكُوا بِهِ شَيْئًا. قَالَ: وَوَرَاءَهُ رَجُلٌ يَقُولُ: يَا أَيُّهَا النَّاسُ، إِنَّ هَذَا يَأْمُرُكُمْ أَنْ تَتْرُكُوا دَيْنَ آبَائِكُمْ، فَسَأَلْتُ مَنْ هَذَا الرَّجُلُ؟ قِيلَ: أَبُو لَهَبٍ-
وفى رواية عنه قَالَ: رَأَيْتُ رَسُولَ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ فِي الْجَاهِلِيَّةِ بِسُوقِ ذِي الْمَجَازِ وَهُوَ يَقُولُ: يَا أَيُّهَا النَّاسُ، قُولُوا لاَ إِلَهَ إِلاَّ اللهُ تُفْلِحُوا قَالَ: يُرَدِّدُهَا مِرَارًا وَالنَّاسُ مُجْتَمِعُونَ عَلَيْهِ يَتَّبِعُونَهُ، وَإِذَا وَرَاءَهُ رَجُلٌ أَحْوَلُ ذُو غَدِيرَتَيْنِ وَضِيءُ الْوَجْهِ يَقُولُ: إِنَّهُ صَابِئٌ كَاذِبٌ، فَسَأَلْتُ: مَنْ هَذَا؟ فَقَالُوا: عَمُّهُ أَبُو لَهَبٍ-
‘মুহাম্মাদ ইবনুল মুনকাদির বলেন, তিনি রাবী‘আহ বিন এবাদ আদ-দুআলী-কে বলতে শুনেছেন তিনি বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ (সঃ)-কে মদীনায় হিজরতের পূর্বে মিনাতে লোকদের তাঁবু সমূহে গিয়ে বলতে শুনেছি, হে লোকসকল !
আল্লাহ তোমাদেরকে নির্দেশ দিয়েছেন যে, তোমরা তাঁর ইবাদত কর এবং তাঁর সাথে কোন কিছুকে শরীক করো না’। রাবী বলেন, এ সময় তাঁর পিছনে আর একজন ব্যক্তিকে বলতে শুনলাম, হে লোকসকল !
নিশ্চয় এই ব্যক্তি তোমাদেরকে নির্দেশ দিচ্ছেন যাতে তোমরা তোমাদের বাপ-দাদার ধর্ম পরিত্যাগ কর’। রাবী বলেন, আমি লোকদের জিজ্ঞেস করলাম এ ব্যক্তিটি কে ? তারা বলল, আবু লাহাব’ (হাকেম হা/৩৮, হাদীছ ছহীহ)।
একই রাবী কর্তৃক অন্য বর্ণনায় এসেছে, জাহেলী যুগে আমি রাসূল (সঃ)-কে যুল-মাজায বাজারে লোকদের উদ্দেশ্যে বার বার বলতে শুনেছি, قُولُوا لآ إِلَهَ إِلاَّ اللهُ تُفْلِحُوا ‘তোমরা বল ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’ আল্লাহ ব্যতীত কোন উপাস্য নেই। তাহ’লে তোমরা সফলকাম হবে ।
তাঁর পিছে পিছে আর একজন চোখ ট্যারা, দুই ঝুটি চুল ওয়ালা উজ্জ্বল গৌর বর্ণের ব্যক্তি বলছেন, إِنَّهُ صَابِئٌ كَاذِبٌ ‘লোকটি ধর্মত্যাগী ও মিথ্যাবাদী’। আমি লোকদের জিজ্ঞেস করলাম, এই ব্যক্তিটি কে? লোকেরা বলল, উনার চাচা আবু লাহাব’।
[1] ত্বারেক আল-মাহারেবী বলেন, আমি জাহেলী যুগে যুল-মাজায বাজারে লাল জুববা পরিহিত অবস্থায় রাসূল (সঃ)-কে দাওয়াত দিতে শুনেছি যে, يَا أَيُّهَا النَّاسُ، قُولُوا: لاَ إِلَهَ إِلاَّ اللهُ تُفْلِحُوا ‘হে জনগণ !
তোমরা বল ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’ আল্লাহ ব্যতীত কোন উপাস্য নেই। তাহ’লে তোমরা সফলকাম হবে’। তাঁর পিছে পিছে একজন লোককে তাঁর পায়ে পাথর ছুঁড়ে মারতে দেখলাম।
যা তাঁর দুই গোঁড়ালী ও গোঁড়ালীর উপরাংশ রক্তাক্ত করে দিচ্ছে। আর সে বলছে, يَا أَيُّهَا النَّاسُ لَا تُطِيعُوهُ فَإِنَّهُ كَذَّابٌ ‘হে জনগণ! তোমরা এর আনুগত্য করো না। কারণ সে মহা মিথ্যাবাদী’ (ছহীহ ইবনু খুযায়মাহ হা/১৫৯)।
[2] ভাতিজা ও চাচার দ্বিমুখী দাওয়াত, দ্বিমুখী সার্বভৌমত্বের ও দ্বিমুখী আনুগত্যের প্রতি দাওয়াত। যা সদা সাংঘর্ষিক। ক্বিয়ামত পর্যন্ত সত্য ও মিথ্যার এই দ্বন্দ্ব চলবে। জান্নাত পিয়াসী মানুষ সর্বদা সত্যের উপাসী হবে ও পরকালে জান্নাত লাভে ধন্য হবে।
আর প্রকৃত প্রস্তাবে তারাই হ’ল ইহকালে ও পরকালে সফলকাম।
বর্তমান যুগে মুসলমানদের মধ্যে কুরায়েশদের ন্যায় তাওহীদের দাবী আছে। কিন্তু বাস্তবে নেই।
যাকে ‘তাওহীদে রুবূবিয়াত’ বলা হয়। অর্থাৎ রব হিসাবে আল্লাহকে স্বীকার করা। পক্ষান্তরে রাসূল (সঃ)-এর দাওয়াত ছিল জীবনের সর্বক্ষেত্রে আল্লাহর আনুগত্য করা।
যাকে ‘তাওহীদে ইবাদাত’ বা ‘উলূহিয়াত’ বলা হয়। আল্লাহ বলেন, ‘আমি জিন ও ইনসানকে সৃষ্টি করেছি কেবলমাত্র আমার ইবাদত করার জন্য’ (যারিয়াত ৫১/৫৬)।
কুরায়েশদের মধ্যে আল্লাহর স্বীকৃতি ছিল। কিন্তু আল্লাহর ইবাদত ছিল না এবং তাদের সার্বিক জীবনে আল্লাহর আনুগত্য ছিল না। এ যুগের মুসলমানদের মধ্যেও একই অবস্থা কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া।
অতএব জান্নাত পিয়াসী মুমিনগণ সাবধান !
[1]. হাকেম হা/৩৯, ১/১৫ পৃঃ, হাদীছ ছহীহ, আহমাদ হা/১৬০৬৬।
[2]. হাকেম হা/৪২১৯, ২/৬১১; ছহীহ ইবনু হিববান হা/৬৫৬২; ছহীহ ইবনু খুযায়মাহ হা/১৫৯,; দারাকুৎনী হা/২৯৫৭, সনদ ছহীহ।
জনগণের প্রতিক্রিয়া
প্রথমে ছাফা পর্বতচূড়ার আহবান মক্কা নগরী ও তার আশপাশ এলাকার আবাল-বৃদ্ধ-বণিতার মধ্যে এক নতুনের শিহরণ জাগিয়ে তুলেছিল।
অতঃপর সর্বত্র প্রকাশ্য দাওয়াতের প্রতিক্রিয়ায় সকলের মুখে মুখে একই কথার অনুবৃত্তি হ’তে থাকে, কি শুনছি আজ আব্দুল্লাহ্র পুত্রের মুখে।
এ যে নির্যাতিত মানবতার প্রাণের কথা। এ যে মযলূমের হৃদয়ের ভাষা।
যে ক্রীতদাস ভাবত এটাই তার নিয়তি, সে এখন নিজেকে স্বাধীন মানুষ ভাবতে লাগল।
যে নারী ভাবত, সবলের শয্যাসঙ্গিনী হওয়াই তার নিয়তি, সে এখন নিজেকে অধিকার সচেতন সাহসী নারী হিসাবে ভাবতে লাগল।
যে গরীব ভাবত সূদখোর মহাজনের করাল গ্রাস হ’তে মুক্তির কোন পথ নেই, সে এখন মুক্তির দিশা পেল। সর্বত্র একটা জাগরণের ঢেউ। একটা নতুনের শিহরণ। এ যেন নিদ্রাভঙ্গের পূর্বে জাগৃতির অনুরণন।
সমাজনেতাদের প্রতিক্রিয়াঃ
রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর আহবানের সত্যতা ও যথার্থতার বিষয়ে সমাজনেতাদের মধ্যে কোনরূপ দ্বিমত ছিল না।
কিন্তু ধুরন্ধর নেতারা তাওহীদের এ অমর আহবানের মধ্যে তাদের দুনিয়াবী স্বার্থের নিশ্চিত অপমৃত্যু দেখতে পেয়েছিল।
এক আল্লাহকে মেনে নিলে শিরক বিলুপ্ত হবে। দেব-দেবীর পূজা বন্ধ হয়ে যাবে। ফলে সারা আরবের উপর তাদের ধর্মীয় নেতৃত্ব ও পৌরহিত্যের মর্যাদা শেষ হয়ে যাবে।
এছাড়া লোকেরা যে পূজার অর্ঘ্য সেখানে নিবেদন করে, তা ভোগ করা থেকে তারা বঞ্চিত হবে। আল্লাহর বিধানকে মানতে গেলে তাদের মনগড়া সামাজিক ও অর্থনৈতিক বিধানসমূহ বাতিল হয়ে যাবে।
ঘরে বসে দাদন ব্যবসার মাধ্যমে চক্রবৃদ্ধি হারে সূদ নিয়ে তারা যেভাবে জোঁকের মত গরীবের রক্ত শোষণ করছিল, তা বন্ধ হয়ে যাবে।
যে নারীকে তারা কেবল ভোগের সামগ্রী হিসাবে মনে করে, তাকে পূর্ণ সম্মানে অধিষ্ঠিত করতে হবে। এমনকি তাকে নিজ কষ্টার্জিত সম্পত্তির উত্তরাধিকার দিতে হবে। কৃষ্ণাঙ্গ ক্রীতদাসদের ‘ভাই’ হিসাবে সমান ভাবতে হবে।
সবচেয়ে বড় কথা যুগ যুগ ধরে যে রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক নেতৃত্ব তারা দিয়ে আসছিল, তা নিমেষে হারিয়ে যাবে এবং মুহাম্মাদকে নবী মেনে নিলে কেবল তারই আনুগত্য করতে হবে। অতএব মুহাম্মাদ দিন-রাত কা‘বাগৃহে বসে ইবাদত-বন্দেগীতে লিপ্ত থাকুক, আমরাও তার সাথী হ’তে রাযী আছি।
কিন্তু তাওহীদের সাম্য ও মৈত্রীর আহবান আমরা কোনমতেই মানতে রাযী নই। এইভাবে প্রধানতঃ সামাজিক ও অর্থনৈতিক স্বার্থের বিপরীত ধারণা করেই তারা রাসূল (সঃ)-এর বিরোধিতা করার সিদ্ধান্ত নেয়।
আল্লাহ বলেন, قَدْ نَعْلَمُ إِنَّهُ لَيَحْزُنُكَ الَّذِي يَقُولُوْنَ فَإِنَّهُمْ لاَ يُكَذِّبُونَكَ وَلَكِنَّ الظَّالِمِيْنَ بِآيَاتِ اللهِ يَجْحَدُوْنَ ‘তারা যেসব কথা বলে তা যে তোমাকে খুবই কষ্ট দেয়, তা আমরা জানি। তবে ওরা তোমাকে মিথ্যাবাদী বলে না।
বরং যালেমরা আল্লাহর আয়াত সমূহকে অস্বীকার করে’ (আন‘আম ৬/৩৩)। যুগে যুগে সকল নবী-রাসূল ও তাঁদের সনিষ্ঠ অনুসারীদের একই অবস্থার সম্মুখীন হ’তে হয়েছে এবং হবে।
সম্প্রদায়ের নেতাদের মন্দ প্রতিক্রিয়ার অন্যতম কারণ ছিল গোত্রীয় হিংসা এবং ভালোর প্রতি হিংসা। যেমন অন্যতম নেতা আখনাস বিন শারীক্ব-এর প্রশ্নের উত্তরে আবু জাহ্ল বলেছিলেন,
تَنَازَعْنَا نَحْنُ وَبَنُو عَبْدِ مَنَافٍ الشَّرَفَ... قَالُوا: مِنَّا نَبِيٌّ يَأْتِيهِ الْوَحْيُ مِنَ السَّمَاءِ، فَمَتَى نُدْرِكُ مِثْلَ هَذِهِ؟ وَاللهِ لاَ نُؤْمِنُ بِهِ أَبَدًا وَلاَ نُصَدِّقُهُ ‘বনু ‘আব্দে মানাফের সাথে আমাদের বংশ মর্যাদাগত ঝগড়া আছে’...
তারা বলবে, আমাদের বংশে একজন নবী আছেন, যার নিকটে আসমান থেকে ‘অহি’ আসে। আমরা কিভাবে ঐ মর্যাদায় পৌঁছব ?
অতএব আল্লাহর কসম! আমরা কখনোই তার উপর ঈমান আনব না বা তাকে সত্য বলে বিশ্বাস করব না’।
[1] উল্লেখ্য যে, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) ছিলেন ‘আব্দে মানাফের পুত্র হাশেম-এর বংশধর। পক্ষান্তরে আবু জাহল ছিলেন বনু মাখযূম গোত্রের। বনু হাশেম গোত্রে নবীর আবির্ভাব হওয়ায় বনু মাখযূম গোত্র তাদের প্রতি হিংসা পরায়ণ ছিল। যদিও সকলে ছিলেন কুরায়েশ বংশীয়।
উর্দূ কবি হালী এই সময়কার অবস্থা বর্ণনা করেন নিম্নোক্ত ভাষায়-
وه بجلى كا كڑكا تها يا صوت ہادى + عرب كى زمين جس نے سارى ہلا دى
نئى اك لگن دل ميں سب كے لگا دى + اك آواز ميں سوتى بستى جگا دى
پڑا ہر طرف غل يہ پيغام حق سے + كہ گوبخ اوٹھے دشت وجبل نام حق سے
(১) এটি বজ্রের ধবনি ছিল, না পথ প্রদর্শকের কণ্ঠ ছিল, আরবের সমগ্র যমীন যা কাঁপিয়ে দিল।
(২) নতুন এক বন্ধন সকলের অন্তরে লাগিয়ে দিল, এক আওয়াযেই ঘুমন্ত জাতিকে জাগিয়ে দিল।
(৩) সত্যের এ আহবানে সর্বত্র হৈ চৈ পড়ে গেল, সত্যের নামে ময়দান ও পাহাড় সর্বত্র গুঞ্জরিত হ’ল’ (মুসাদ্দাসে হালী -উর্দূ ষষ্ঠপদী, ১৪ পৃঃ)।
[1]. ইবনু হিশাম ১/৩১৫-১৬; সনদ মুনক্বাতি‘ বা যঈফ (তাহকীক ইবনু হিশাম ক্রমিক ৩০৪)। বায়হাক্বী, দালায়েলুন নবুঅত ২/২০৬; আল-বিদায়াহ ৩/৬৪।
বিরোধিতার কৌশল সমূহ
কুরায়েশ নেতারা মুহাম্মাদ (সঃ)-কে ঠেকানোর জন্য বিভিন্ন পথ-পন্থা উদ্ভাবন করলেন। যেমন-
(১) প্রথম পন্থা হিসাবে তারা বেছে নিলেন মুহাম্মাদের আশ্রয়দাতা আবু ত্বালেবকে দলে টানা। সেমতে নেতৃবৃন্দ সেখানে গেলেন এবং তাঁর নিকটে বাপ-দাদার ধর্মের দোহাই দিয়ে ও সামাজিক ঐক্যের কথা বলে মুহাম্মাদকে বিরত রাখার দাবী জানালেন।
আবু ত্বালিব স্থিরভাবে তাদের সব কথা শুনলেন। অতঃপর ধীরকণ্ঠে নরম ভাষায় তাদেরকে বুঝিয়ে বিদায় করলেন।
(২) হজ্জের সময় দাওয়াতে বাধা দেওয়া। হারামের এ মাসে কোন ঝগড়া-ফাসাদ নেই। অতএব এই সুযোগে মুহাম্মাদ বহিরাগতদের নিকটে তার দ্বীনের দাওয়াত পেশ করবেন এটাই স্বাভাবিক।
সুতরাং তারা সিদ্ধান্ত নিল যে, এমন একটা অপবাদ মুহাম্মাদের বিরুদ্ধে তৈরী করতে হবে এবং তা সকলের মধ্যে রটিয়ে দিতে হবে, যাতে কোন লোক তার কথায় কর্ণপাত না করে।
অলীদ বিন মুগীরাহ্র গৃহে বৈঠক বসল। এক একজন এক এক প্রস্তাব পেশ করল। কেউ বলল, তাকে ‘গণৎকার’ (كَاهِنٌ) বলা হউক।
কেউ বলল, ‘পাগল’ (مَجْنُوْنٌ) বলা হউক। কেউ বলল, ‘কবি’ (شَاعِرٌ) বলা হউক। সব শুনে অলীদ বললেন, আল্লাহর কসম! মুহাম্মাদ-এর কথাবার্তা বড়ই সুন্দর ও মিষ্ট-মধুর।
তার কাছে কিছুক্ষণ বসলেই লোকেদের নিকট তোমাদের দেওয়া ঐসব অপবাদ মিথ্যা প্রতিপন্ন হবে।
তারা বলল, তাহ’লে আপনিই বলুন, কী বলা যায়।
অলীদ অনেকক্ষণ ভেবে-চিন্তে বললেন, তার সম্পর্কে যদি কিছু বলতেই হয়, তবে বেশীর বেশী তাকে ‘জাদুকর’ (سَاحِرٌ) বলা যায়। কেননা তার কথা যেই-ই মন দিয়ে শোনে তার মধ্যে জাদুর মত আছর করে (মুদ্দাছছির ৭৪/২৪) এবং লোকেরা তার দলে ভিড়ে যায়।
ফলে আমাদের পিতা-পুত্রের মধ্যে, ভাই-ভাইয়ের মধ্যে, স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে, আত্মীয়-স্বজনের মধ্যে এমনকি গোত্রে-গোত্রে বিভক্তি সৃষ্টি হয়ে গেছে। আর এসবই হচ্ছে তার কথার জাদুকরী প্রভাবে।
অতএব তাকে ‘জাদুকর’ বলাই যুক্তিযুক্ত। অতঃপর সবাই একমত হয়ে আসন্ন হজ্জের মৌসুমে শতমুখে তাঁকে ‘জাদুকর’ বলে প্রচার করার সিদ্ধান্ত নিয়ে বৈঠক ভঙ্গ করল।
অতঃপর মক্কার পথে পথে হাজীদের নিকট এই মিথ্যা অপবাদ প্রচার করার জন্য লোক নিয়োগ করল, যেন তারা রাসূল (ছাঃ)-এর ব্যাপারে সবাইকে সাবধান করে’ (ইবনু হিশাম ১/২৭০)।
বস্ত্ততঃ যুগে যুগে সমাজ সংস্কারক নেতাদের বিরুদ্ধে স্বার্থপর সমাজ ও রাজনৈতিক নেতারা এবং মিডিয়ার দুষ্টু লোকেরা পরিকল্পিতভাবে মিথ্যাচার করেছে, আজও করে যাচ্ছে। কেবল যুগের পরিবর্তন হয়েছে। মানসিকতার কোন পরিবর্তন হয়নি।
অলীদ কে ছিলেন ?
অলীদ এর পরিচয়ঃ অলীদ বিন মুগীরা আল-মাখযূমী ছিলেন মক্কার অন্যতম সেরা ধনী। আল্লাহ তাকে ধনৈশ্বর্য ও সন্তান-সন্ততির প্রাচুর্য দান করেছিলেন।
ইবনু আববাস (রাঃ) বলেন, তিনি নিজেকে বলতেন ‘অহীদ ইবনুল অহীদ’ (আমি অদ্বিতীয়ের পুত্র অদ্বিতীয়)। সারা আরবে আমার ও আমার পিতার কোন তুলনা নেই।
তার এই ধারণা বিষয়ে আল্লাহ বলেন, ذَرْنِي وَمَنْ خَلَقْتُ وَحِيدًا ‘ছাড় আমাকে এবং যাকে আমি সৃষ্টি করেছি অদ্বিতীয় করে’ (মুদ্দাছছির ৭৪/১১)।
তার ফসলের ক্ষেত, পশু চারণ ক্ষেত্র ও বাগ-বাগিচা মক্কা হ’তে ত্বায়েফ পর্যন্ত (প্রায় ৯০ কি. মি.) বিস্তৃত ছিল (তাফসীর কুরতুবী)। শীত-গ্রীষ্ম উভয় মৌসুমে তার ক্ষেতের ফসল ও বাগানের আয়-আমদানী অব্যাহত থাকত।
তার সন্তান-সন্ততি তার সাথেই থাকত। এদিকে ইঙ্গিত করে আল্লাহ বলেন, وَجَعَلْتُ لَهُ مَالاً مَمْدُودًا- وَبَنِينَ شُهُودًا- وَمَهَّدْتُ لَهُ تَمْهِيدًا ‘তাকে আমি দিয়েছিলাম প্রচুর ধন-সম্পদ’। ‘এবং সদাসঙ্গী পুত্রগণ’।
আর তাকে দিয়েছিলাম প্রচুর সচ্ছলতা (মুদ্দাছছির ৭৪/১২-১৪)।
একদিন তিনি রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর নিকটে আসেন। তখন তিনি তাকে কুরআন শুনান। তাতে তার অন্তর গলে যায়।
একথা আবু জাহ্লের কানে পৌঁছে যায়। তখন তিনি তার কাছে এসে বলেন, হে চাচা! আপনার সম্প্রদায়ের লোকেরা আপনার জন্য অনেক টাকা জমা করতে মনস্থ করেছে আপনাকে দেওয়ার জন্য।
কেননা আপনি মুহাম্মাদের কাছে গিয়েছিলেন। জবাবে তিনি বললেন, কুরায়েশরা ভালো করেই জানে যে আমি তাদের মধ্যে সবচেয়ে বড় ধনী।
তখন আবু জাহ্ল বললেন, আপনি তার ব্যাপারে এমন কিছু কথা বলুন যাতে আপনার সম্প্রদায়ের লোকেরা বোঝে যে আপনি মুহাম্মাদ যা বলেছে, তা অস্বীকারকারী।
জবাবে তিনি বললেন, আমি তার সম্পর্কে কি বলব ?
আল্লাহর কসম! তোমাদের মধ্যে কবিতা বিষয়ে আমার চাইতে বিজ্ঞ কেউ নেই। আল্লাহর কসম!
তিনি যা বলেন, তা কোন কিছুর সাথেই তুলনীয় নয়। ক্বাতাদাহ বলেন, লোকেরা ধারণা করত যে, তিনি বলেছিলেন, وَاللهِ لَقَدْ نَظَرْتُ فِيمَا قَالَ الرَّجُلُ فَإِذَا هُوَ لَيْسَ بِشِعْرٍ، وَإِنَّ لَهُ لَحَلاَوَةٌ، وَإِنَّ عَلَيْهِ لَطَلاَوَةٌ، وَإِنَّهُ لَيَعْلُوَ وَمَا يُعْلَى، وَمَا أَشُكُّ أَنَّهُ سِحْرٌ ‘আল্লাহর কসম !
লোকটি যা বলেন সে বিষয়ে আমি গভীরভাবে চিন্তা করেছি। এটি কোন কবিতা নয়। নিশ্চয়ই এর রয়েছে বিশেষ মাধুর্য। এর উপরে রয়েছে বিশেষ অলংকার। নিশ্চয়ই এটি বিজয়ী হবে, বিজিত হবে না। আর আমি যা সন্দেহ করি তা এই যে, এটি জাদু।
[1] এভাবে সবকিছু স্বীকার করার পরও অহংকার বশে ও কুরায়েশ নেতাদের চাপে তিনি রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর নবুঅতকে স্বীকৃতি না দিয়ে বিরুদ্ধাচরণের পথ বেছে নিলেন।
ওইদিন অলীদের গৃহে অনুষ্ঠিত বৈঠকে রাসূল (সঃ)-কে ‘জাদুকর’ বলে প্রচার করার সিদ্ধান্তের ঘটনা এবং অলীদের বাকভঙ্গী আল্লাহ নিজস্ব রীতিতে বর্ণনা করেন নিম্নোক্ত ভাবে-
إِنَّهُ فَكَّرَ وَقَدَّرَ- فَقُتِلَ كَيْفَ قَدَّرَ- ثُمَّ قُتِلَ كَيْفَ قَدَّرَ- ثُمَّ نَظَرَ- ثُمَّ عَبَسَ وَبَسَرَ- ثُمَّ أَدْبَرَ وَاسْتَكْبَرَ- فَقَالَ إِنْ هَذَا إِلاَّ سِحْرٌ يُّؤْثَرُ- إِنْ هَذَا إِلاَّ قَوْلُ الْبَشَرِ-
‘সে চিন্তা করল ও মনস্থির করল’।
ধ্বংস হৌক সে কিরূপ মনস্থির করল ?
অতঃপর সে তাকাল’। ‘অতঃপর ভ্রুকুঞ্চিত করল ও মুখ বিকৃত করল’। ‘অতঃপর পৃষ্ঠ প্রদর্শন করল ও অহংকার করল’। ‘তারপর বলল, অর্জিত জাদু বৈ কিছু নয়’। ‘এটা মানুষের উক্তি বৈ কিছু নয়’ (মুদ্দাছছির ৭৪/১৮-২৫)।
অত্র সূরায় ১১ হ’তে ২৬ পর্যন্ত ১৬টি আয়াত কেবল অলীদ সম্পর্কেই নাযিল হয়েছে। দেখা যাচ্ছে যে, অলীদ রাসূল (সঃ)-কে ‘মিথ্যাবাদী’ বলতে সাহস করেননি।
তাই অবশেষে কালামে পাকের জাদুকরী প্রভাবের কথা চিন্তা করে তিনি রাসূল (সঃ)-কে ‘জাদুকর’ বলে অপবাদ দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিলেন। এতে আল্লাহ তাকে পরপর দু’বার অভিসম্পাৎ দিয়ে বলেন, فَقُتِلَ كَيْفَ قَدَّرَ- ثُمَّ قُتِلَ كَيْفَ قَدَّرَ ‘ধ্বংস হৌক সে কিরূপ মনস্থির করল ?
ধ্বংস হৌক সে কিরূপ মনস্থির করল ?
অতঃপর বললেন, سَأُصْلِيْهِ سَقَرَ ‘সত্বর আমি তাকে ‘সাক্বার’ নামক জাহান্নামে প্রবেশ করাবো’ (মুদ্দাছছির ৭৪/২৬)।
অলীদ বিন মুগীরাহ হিজরতের তিনমাস পর ৯৫ বছর বয়সে কাফির অবস্থায় মক্কায় মৃত্যুবরণ করেন এবং হাজূনে সমাহিত হন।
[1]. ইবনু কাছীর, তাফসীর সূরা মুদ্দাছছির ১৮-২৪ আয়াত; ইবনু হিশাম ১/২৭০-৭১।
[2]. ইবনুল আছীর, আল-কামিল ফিত তারীখ (বৈরূত : ১ম সংস্করণ ১৪১৭/১৯৯৭) ১/৬৬৯।
হজ্জের মৌসুমে রাসূল (সঃ)-এর দাওয়াত
হজ্জের মৌসুমে রাসূল (সঃ)-এর দাওয়াতঃ যথাসময়ে হজ্জের মৌসুম এসে গেল।
হজ্জের মাসের আগে-পিছে দু’মাস হ’ল হারামের মাস। এ তিন মাস মারামারি-কাটাকাটি নিষিদ্ধ। রাসূলুল্লাহ (সঃ) হজ্জে আগত মেহমানদের তাঁবুতে গিয়ে দ্বীনের দাওয়াত দিতে থাকেন।
ওদিকে অলীদের পরামর্শ মতে আবু লাহাবের নেতৃত্বে পরিচালিত গীবতকারী দল সবার কাছে গিয়ে রাসূল (সঃ) সম্পর্কে বিভিন্ন অপবাদ প্রচার করতে থাকে এবং শেষে বলে আসে যে, সে একজন জাদুকর। তার কথা শুনলেই জাদুগ্রস্ত হয়ে যেতে হবে।
অতএব কেউ যেন তার ধারে-কাছে না যায়। খোদ আবু লাহাব নির্লজ্জের মত রাসূল (সঃ)-এর পিছে পিছে ঘুরতে লাগল। রাসূল (সঃ) যেখানেই যান, সেখানেই সে গিয়ে বলে يَا أَيُّهَا النَّاسُ لاَ تُطِيعُوهُ فَإِنَّهُ صَابِىءٌ كَذَّابٌ ‘হে জনগণ! তোমরা এর কথা শুনো না। সে ধর্মত্যাগী মহা মিথ্যুক’।
[1] শুধু তাই নয়, সে উপরোক্ত গালি দিয়ে হজ্জ মৌসুমের বাইরে যুল-মাজায বাজারে রাসূল (সঃ)-এর পায়ে পাথর ছুঁড়ে মেরেছিল। যাতে তাঁর দু’গোড়ালী রক্তাক্ত হয়ে গিয়েছিল।
[2] যুগে যুগে বাতিলপন্থীরা এভাবে হকপন্থীদের বিরুদ্ধে মিথ্যা অপবাদ রটনা করেছে। আজও করে যাচ্ছে। যাতে লোকেরা হক কবুল করা হ’তে বিরত থাকে।
[1]. ছহীহ ইবনু খুযায়মাহ হা/১৫৯, সনদ ছহীহ; আহমাদ হা/১৬০৬৬, ১৬০৬৯, সনদ হাসান।
[2]. ছহীহ ইবনু হিববান হা/৬৫৬২; হাকেম ২/৬১১; দারাকুৎনী হা/২৯৫৭, ১৮৬ ‘ক্রয়-বিক্রয়’ অধ্যায়, সনদ হাসান।
লাভ ও ক্ষতি
এই ব্যাপক অপপ্রচারের ফলে রাসূল (সঃ)-এর জন্য লাভ ও ক্ষতি দু’টিই হ’ল। লাভ হল এই যে, তাঁর নবুঅত দাবীর কথা সর্বত্র প্রচারিত হ’ল। যা সুদূর ইয়াছরিবের কিতাবধারী ইহূদী-নাছারাদের কানে পৌঁছে গেল।
এতে তারা বুঝে নিল যে, তাওরাত-ইনজীলের ভবিষ্যদ্বাণী অনুযায়ী আখেরী নবীর আগমন ঘটেছে। ফলে দ্বীনদার লোকদের মধ্যে তাঁর প্রতি ব্যাপক আগ্রহ সৃষ্টি হল।
পক্ষান্তরে ক্ষতি হ’ল এই যে, কেউ তাঁর দাওয়াতে সাড়া দিল না। বরং অনেকের মধ্যে তাঁর সম্পর্কে বিরূপ মনোভাবের সৃষ্টি হ’ল। সবচেয়ে ক্ষতিকর দিক ছিল আবু লাহাবের কুৎসা রটনা ও নোংরা প্রচারণা।
কেননা তিনি ছিলেন রাসূল (সঃ)-এর আপন চাচা, নিকটতম প্রতিবেশী, তাঁর দুই মেয়ের সাবেক শ্বশুর এবং সুপরিচিত নেতা ও বড় ব্যবসায়ী। তার কথা সবাই বিশ্বাস করে নিল। যে কারণে দীর্ঘ প্রায় তিন মাসব্যাপী দিন-রাতের দাওয়াত বাহ্যতঃ নিষ্ফল হ’ল।
অপবাদের সংখ্যা বৃদ্ধি ও অন্যান্য কৌশল সমূহ
নানাবিধ অপবাদ রটনাঃ হজ্জের মৌসুম শেষে নেতারা পুনরায় হিসাব-নিকাশে বসে গেলেন।
দেখা গেল যে, অপবাদ রটনায় কাজ হয়েছে সবচেয়ে বেশী। এর দ্বারা যেমন প্রতিপক্ষকে মানসিকভাবে দুর্বল করা যায়।
তেমনি সাধারণ মানুষ দ্রুত সেটা লুফে নেয়। কেউ যাচাই-বাছাই করতে চাইলে তো আমাদের কাছেই আসবে। কেননা আমরাই সমাজের নেতা এবং আমরাই তার নিকটতম আত্মীয় ও প্রতিবেশী।
অতএব আমরাই যখন তার বিরুদ্ধে বলছি, তখন কেউ আর এ পথ মাড়াবে না। অতএব অপবাদের সংখ্যা বৃদ্ধির সিদ্ধান্ত নেওয়া হ’ল। ফলে রাসূল (সঃ)-এর বিরুদ্ধে তারা অনেকগুলি অপবাদ তৈরী করল। যেমন- তিনি হচ্ছেনঃ-
(১) পাগল (২) কবি وَيَقُولُونَ أَئِنَّا لَتَارِكُوا آلِهَتِنَا لِشَاعِرٍ مَّجْنُونٍ ‘তারা বলল, আমরা কি একজন কবি ও পাগলের জন্য আমাদের উপাস্যদের পরিত্যাগ করব ?
(ছাফফাত ৩৭/৩৬)।
(৩) জাদুকর
(৪) মহা মিথ্যাবাদী وَقَالَ الْكَافِرُونَ هَذَا سَاحِرٌ كَذَّابٌ ‘কাফেররা বলল, এ লোকটি একজন জাদুকর ও মহা মিথ্যাবাদী’ (ছোয়াদ ৩৮/৪)।
(৫) পুরাকালের উপাখ্যান বর্ণনাকারী إِنْ هَـذَا إِلاَّ أَسَاطِيْرُ الأوَّلِيْنَ ‘এটা পূর্ববর্তীদের মিথ্যা উপাখ্যান ব্যতীত কিছুই নয়’ (আনফাল ৮/৩১)।
(৬) অন্যের সাহায্যে মিথ্যা রচনাকারী يَقُولُونَ إِنَّمَا يُعَلِّمُهُ بَشَرٌ ‘তারা বলে যে, তাকে শিক্ষা দেয় একজন মানুষ’ (নাহল ১৬/১০৩),
(৭) মিথ্যা রটনাকারী وَقَالَ الَّذِينَ كَفَرُوا إِنْ هَذَا إِلاَّ إِفْكٌ افْتَرَاهُ وَأَعَانَهُ عَلَيْهِ قَوْمٌ آخَرُونَ ‘কাফেররা বলে, এটা বানোয়াট ছাড়া কিছুই নয় যা সে উদ্ভাবন করেছে এবং অন্য সম্প্রদায়ের লোকেরা তাকে এব্যাপারে সাহায্য করেছে’ (ফুরক্বান ২৫/৪)।
(৮) গণৎকার فَذَكِّرْ فَمَا أَنتَ بِنِعْمَتِ رَبِّكَ بِكَاهِنٍ وَلاَ مَجْنُونٍ ‘অতএব তুমি উপদেশ দিতে থাকো। তোমার প্রতিপালকের অনুগ্রহে তুমি গণক নও, উন্মাদও নও’ (তূর ৫২/২৯)।
(৯) ইনি তো সাধারণ মানুষ, ফেরেশতা নন وَقَالُوا مَالِ هَذَا الرَّسُولِ يَأْكُلُ الطَّعَامَ وَيَمْشِي فِي الْأَسْوَاقِ لَوْلاَ أُنزِلَ إِلَيْهِ مَلَكٌ فَيَكُونَ مَعَهُ نَذِيراً ‘তারা বলে যে, এ কেমন রাসূল যে খাদ্য ভক্ষণ করে ও হাট-বাজারে চলাফেরা করে ?
তার প্রতি কেন ফেরেশতা নাযিল করা হলো না, যে তার সাথে থাকতো সদা সতর্ককারী রূপে ? (ফুরক্বান ২৫/৭)।
(১০) পথভ্রষ্ট وَإِذَا رَأَوْهُمْ قَالُوا إِنَّ هَؤُلاَء لَضَالُّونَ ‘যখন তারা ঈমানদারগণকে দেখত, তখন বলত, নিশ্চয়ই এরা পথভ্রষ্ট’ (মুত্বাফফেফীন ৮৩/৩২)।
(১১) ধর্মত্যাগী قَالَ ابو لهب: لاَتُطِيْعُوْهُ فَإِنَّهُ صَابِىءٌ كَذَّابٌ ‘আবু লাহাব বলত, তোমরা এর আনুগত্য করো না। কেননা সে ধর্মত্যাগী মহা মিথ্যাবাদী’ (আহমাদ)।
(১২) পিতৃধর্ম বিনষ্টকারী
(১৩) জামা‘আত বিভক্তকারী (ইবনু হিশাম ১/২৯৫)
(১৪) জাদুগ্রস্ত يَقُوْلُ الظَّالِمُوْنَ إِنْ تَتَّبِعُوْنَ إِلاَّ رَجُلاً مَّسْحُوْراً ‘যালেমরা বলে, তোমরা তো কেবল একজন জাদুগ্রস্ত ব্যক্তির অনুসরণ করছ’ (বনু ইস্রাঈল ১৭/৪৭)।
(১৫) ‘মুযাম্মাম’। আবু লাহাবের স্ত্রী উম্মে জামীল ‘মুহাম্মাদ’ (প্রশংসিত) নামের বিপরীতে ‘মুযাম্মাম’ (নিন্দিত) নামে ব্যঙ্গ কবিতা বলত (ইবনু হিশাম ১/৩৫৬)।
(১৬) রা‘এনা। মদীনায় হিজরত করার পর সেখানকার দুরাচার ইহূদীরা রাসূল (সঃ)-কে ‘রা‘এনা’ (رَاعِنَا) বলে ডাকত (বাক্বারাহ ২/১০৪)। তাদের মাতৃভাষা হিব্রুতে যার অর্থ ছিল شَرِيْرُنَا ‘আমাদের মন্দ লোকটি’।
[1] এইসব অপবাদের জওয়াবে আল্লাহ বলেন, اُنْظُرْ كَيْفَ ضَرَبُوْا لَكَ الأَمْثَالَ فَضَلُّوْا فَلاَ يَسْتَطِيْعْوْنَ سَبِيْلاً ‘দেখ ওরা কিভাবে তোমার নামে (বাজে) উপমাসমূহ প্রদান করছে। ওরা পথভ্রষ্ট হয়েছে। অতএব ওরা আর পথ পেতে সক্ষম হবে না’ (বনু ইস্রাঈল ১৭/৪৮; ফুরক্বান ২৫/৯)।
কুৎসা রটনাকারীদের বিরুদ্ধে যুগে যুগে এটাই হ’ল সর্বোত্তম জবাব।
[1]. মুজাম্মা‘ লুগাতুল ‘আরাবিইয়াহ (মিসর : ১৪০৯/১৯৮৮) ১/৫০৬; আরবী ভাষায় رَاعِنَا অর্থ ‘আমাদের তত্ত্বাবধায়ক’। মাদ্দাহ الرعاية والحفظ এই লকবে ডেকে তারা বাহ্যতঃ মুসলমানদের খুশী করত।
কিন্তু এর দ্বারা তারা নিজেদের ভাষা অনুযায়ী গালি (الرُّعُونَةُ) অর্থ নিত। সেকারণ আল্লাহ এটাকে নিষিদ্ধ করে انظُرْنَا (‘আমাদের দেখাশুনা করুন’) লকবে ডাকার নির্দেশ দিলেন (ইবনু কাছীর, তাফসীর সূরা বাক্বারাহ ১০৪ আয়াত)।
অপবাদের সংখ্যা বৃদ্ধি ও অন্যান্য কৌশল সমূহ
ব্যঙ্গ কবিতা রচনাঃ আবু লাহাবের স্ত্রী উম্মে জামীল রাসূল (সঃ)-এর বিরুদ্ধে ব্যঙ্গ কবিতা লিখতেন। যাতে রাসূল (সঃ) কষ্ট পান। এর মাধ্যমে তিনি লোকদের ক্ষেপিয়ে তুলতেন।
সূরা লাহাব নাযিল হ’লে রাগে অগ্নিশর্মা হয়ে তিনি হাতে প্রস্তরখন্ড নিয়ে রাসূল (সঃ)-কে মারার উদ্দেশ্যে কা‘বা চত্বরে গমন করেন এবং নিম্নোক্ত কবিতা পাঠ করেন।-
مُذَمَّمًا عَصَيْنَا + وَأَمْرَهُ أَبَيْنَا + وَدِيْنَهُ قَلَيْنَا
নিন্দিতের আমরা অবাধ্যতা করি’। ‘তার নির্দেশ আমরা অমান্য করি’। ‘তার দ্বীনকে আমরা ঘৃণাভরে প্রত্যাখ্যান করি’।
[1] উক্ত কবিতায় তিনি ‘মুহাম্মাদ’ (প্রশংসিত) নামকে বিকৃত করে ‘মুযাম্মাম’ (নিন্দিত) বলেন।
কুরায়েশরাও রাসূল (সঃ)-কে গালি দিয়ে ‘মুযাম্মাম’ (নিন্দিত) বলত।
জবাবে রাসূল (সঃ) কত সুন্দরই না বলতেন, أَلاَ تَعْجَبُوْنَ كَيْفَ يَصْرِفُ اللهُ عَنِّى شَتْمَ قُرَيْشٍ وَلَعْنَهُمْ يَشْتِمُوْنَ مُذَمَّمًا وَيَلْعَنُوْنَ مُذَمَّمًا وَأَنَا مُحَمَّدٌ ‘তোমরা কি বিস্মিত হও না কিভাবে আল্লাহ আমার থেকে কুরাইশদের গালি ও লা‘নতকে ফিরিয়ে দিয়েছেন ?
তারা আমাকে ‘মুযাম্মাম’ (مُذَمَّمٌ) ‘নিন্দিত’ বলে গালি দিয়েছে ও লা‘নত করেছে, অথচ আমি হ’লাম ‘মুহাম্মাদ’ (مُحَمَّدٌ) ‘প্রশংসিত’।
[2] যুগে যুগে সংস্কারপন্থী আলেম ও সংগঠনের বিরুদ্ধে কটূক্তিকারীদের জন্য এটাই হবে সর্বোত্তম জওয়াব।
[1]. ইবনু হিশাম ১/৩৫৬; হাকেম হা/৩৩৭৬, ২/৩৬১ সনদ ছহীহ; আলবানী, ছহীহ সীরাহ নববিইয়াহ ১৩৭ পৃঃ; তাফসীর কুরতুবী, ইবনু কাছীর; সীরাহ ছহীহাহ ১/১৪৭।
[2]. ইবনু হিশাম ১/৩৫৬; বুখারী হা/৩৫৩৩; মিশকাত হা/৫৭৭৮।
অপবাদের সংখ্যা বৃদ্ধি ও অন্যান্য কৌশল সমূহ
অতীতে সংঘটিত বিভিন্ন কাহিনী সম্পর্কে প্রশ্ন করা
(ক) আছহাবে কাহফ ও যুল-ক্বারনায়েন (السؤال عن اصحاب الكهف وذى القرنين) : তাঁকে ভন্ডনবী প্রমাণের জন্য কুরায়েশ নেতারা ইহূদীদের পরামর্শ মতে বিভিন্ন অতীত কাহিনী সম্পর্কে প্রশ্ন করেছিল। যেমন-
(১) আছহাবে কাহফের সেই যুবকদের ঘটনা, যারা প্রাচীনকালে শহর ছেড়ে চলে গিয়েছিল এবং ৩০৯ বছর ঘুমিয়ে থেকে আবার জেগে উঠেছিল।
(২) যুল-ক্বারনায়েন-এর ঘটনা, যিনি পৃথিবীর পূর্ব ও পশ্চিমে সফর করেছিলেন।
(৩) রূহ কি ?
উক্ত প্রেক্ষিতে সূরা কাহফ নাযিল হয়। তবে এ বিষয়ে ইবনু ইসহাক থেকে যে বর্ণনা এসেছে, তা যঈফ।
সেখানে বলা হয়েছে যে, রাসূল (সঃ) নেতাদেরকে পরদিন জবাব দিবেন বলে ওয়াদা করেন। কিন্তু ‘ইনশাআল্লাহ’ বলেন নি। ফলে ১৫ দিন যাবৎ অহী নাযিল বন্ধ থাকে।
পরে জিব্রীল এসে তাঁকে এজন্য তিরষ্কার করেন এবং সূরা কাহফ নাযিল করেন। কথাগুলির মধ্যে যেমন অযৌক্তিকতা রয়েছে, সনদেও রয়েছে তেমনি চরম দুর্বলতা।
(খ) রূহ সম্পর্কে প্রশ্ন (السؤال عن الروح) : হযরত আব্দুল্লাহ ইবনু আববাস (রাঃ) বলেন, একবার কুরায়েশ নেতারা ইহূদী পন্ডিতদের বলল, তোমরা আমাদের এমন কিছু শিখিয়ে দাও, যেটা আমরা এই ব্যক্তিকে প্রশ্ন করব (এবং সে জবাব দিতে পারবে না)। তখন তারা বলল, তোমরা তাকে ‘রূহ’ সম্পর্কে জিজ্ঞেস কর। সেমতে তারা জিজ্ঞেস করল।
তখন আল্লাহ তা‘আলা নাযিল করেন, وَيَسْأَلُونَكَ عَنِ الرُّوحِ قُلِ الرُّوحُ مِنْ أَمْرِ رَبِّي وَمَا أُوتِيتُمْ مِنَ الْعِلْمِ إِلاَّ قَلِيلاً ‘আর ওরা তোমাকে প্রশ্ন করছে ‘রূহ’ সম্পর্কে। তুমি বলে দাও, রূহ আমার প্রতিপালকের একটি আদেশ মাত্র। আর এ বিষয়ে তোমাদের প্রতি সামান্যই জ্ঞান দেওয়া হয়েছে (ইসরা ১৭/৮৫)।
[2] ‘রূহ’ সম্পর্কিত প্রশ্নটি পুনরায় মদীনায় ইহূদীরা করলে সেখানে একই জবাব দেওয়া হয়, যা মক্কায় সূরা বনু ইস্রাঈল ৮৫ আয়াত নাযিলের মাধ্যমে দেওয়া হয়েছিল।
[1]. ইবনু জারীর, কুরতুবী, ইবনু কাছীর, তাফসীর সূরা কাহফ ৫ আয়াত; ত্বাবারী হা/২২৮৬১, ১৫/১২৭-২৮; বায়হাক্বী দালায়েলুন নবুঅত ২/২৭০; ইবনু হিশাম ১/৩০৮; সনদ যঈফ।
[2]. তিরমিযী হা/৩১৪০, আহমাদ হা/২৩০৯, সনদ ছহীহ।
[3]. বুখারী, ফাৎহুল বারী হা/৪৭২১-এর আলোচনা; মুসলিম হা/২৭৯৪; তিরমিযী হা/৩১৪০।
অপবাদের সংখ্যা বৃদ্ধি ও অন্যান্য কৌশল সমূহ
ইহূদী পন্ডিতদের মাধ্যমে সরাসরি
নবীকে পরীক্ষা করা
মদীনার কপট ইহূদী পন্ডিতরা মক্কায় এসে রাসূল (সঃ)-কে প্রশ্ন করল, বলুন তো শামে বসবাসকারী কোন নবীর ছেলেকে মিসরে বহিষ্কার করা হয় এবং তিনি সেই শোকে কেঁদে অন্ধ হয়ে যান ?
ইহূদীরা এঘটনা জানত তাওরাতের মাধ্যমে যা ছিল হিব্রু ভাষায়। মক্কার লোকেরা হিব্রু জানত না।
এমনকি তারা আরবীতেও লেখাপড়া জানত না। তারা ইউসুফ নবী সম্পর্কে কিছুই জানত না। এ প্রশ্ন ছিল রাসূল (সঃ)-এর জন্য একটি কঠিন পরীক্ষা।
ফলে ইউসুফের কাহিনী পূরাটাই একত্রে একটি সূরায় নাযিল হয়। যা অন্য নবীদের বেলায় হয়নি (তাফসীর ইবনু জারীর হা/১৮৭৮৬; কুরতুবী প্রভৃতি)।
অপবাদের সংখ্যা বৃদ্ধি ও অন্যান্য কৌশল সমূহ
চাঁদ দ্বিখন্ডিত করণের প্রস্তাবঃ সবকিছুতে ব্যর্থ হয়ে সবশেষে ইহূদী পন্ডিতেরা কুরায়েশ নেতাদের একটা বিস্ময়কর কৌশল শিখিয়ে দিল।
তারা বলল, মুহাম্মাদ জাদুকর কি-না, যাচাইয়ের একটা প্রকৃষ্ট পন্থা এই যে, জাদুর প্রভাব কেবল যমীনেই সীমাবদ্ধ থাকে। আসমানে এর কোন প্রতিক্রিয়া হয় না। অতএব তোমরা মুহাম্মাদকে বল, সে চাঁদকে দ্বিখন্ডিত করুক।
সম্ভবতঃ হযরত মূসা (আঃ) কর্তৃক লাঠির সাহায্যে নদী বিভক্ত হওয়ার মু‘জেযা থেকেই চন্দ্র দ্বিখন্ডিত করার চিন্তাটি ইহূদীদের মাথায় এসে থাকবে। অথচ নদী বিভক্ত করার চাইতে চন্দ্র দ্বিখন্ডিত করা কতই না কঠিন বিষয়।
কেননা এটি দুনিয়ার এবং অন্যটি আকাশের।
কুরায়েশ নেতারা মহা খুশীতে বাগবাগ হয়ে গেল এই ভেবে যে, এবার নির্ঘাত মুহাম্মাদ কুপোকাৎ হবে।
তারা দল বেঁধে রাসূল (সঃ)-এর কাছে গিয়ে এক চন্দ্রোজ্জ্বল রাত্রিতে উক্ত প্রশ্ন করল। ঐ সময় সেখানে হযরত আলী, আব্দুল্লাহ ইবনু মাসঊদ, জুবায়ের ইবনু মুত্ব‘ইম প্রমুখ ছাহাবীগণ উপস্থিত ছিলেন। এতদ্ব্যতীত বহু ছাহাবী উক্ত বিষয়ে হাদীছ বর্ণনা করেছেন।
যে কারণে হাফেয ইবনু কাছীর এতদসংক্রান্ত হাদীছসমূহকে ‘মুতাওয়াতির’ পর্যায়ভুক্ত বলেছেন (ইবনু কাছীর, তাফসীর সূরা ক্বামার)।
কুরায়েশ নেতাদের দাবী মোতাবেক আল্লাহর হুকুমে রাসূল (সঃ)-এর উক্ত মু‘জেযা প্রদর্শিত হল।
মুহূর্তের মধ্যে চাঁদ দ্বিখন্ডিত হয়ে পূর্ব ও পশ্চিমে ছিটকে পড়ল। উভয় টুকরার মাঝখানে ‘হেরা’ পর্বত আড়াল হয়ে গেল। অতঃপর পুনরায় দুই টুকরা এসে যুক্ত হ’ল।
এ সময় আল্লাহর রাসূল (সঃ) মিনা-তে ছিলেন। ইবনু মাস‘ঊদ (রাঃ) কর্তৃক ছহীহায়নের বর্ণনায় এসেছে যে, এরপর রাসূল (সঃ) উপস্থিত নেতাদের বললেন, إشْهَدُوْا ‘তোমরা সাক্ষী থাক’।
[1] ইবনু মাস‘ঊদ ও ইবনু ওমর (রাঃ) কর্তৃক ছহীহ মুসলিম-এর বর্ণনায় এসেছে যে, ঐসময় আল্লাহকে সাক্ষী রেখে রাসূল (সঃ) বলেন, اللَّهُمَّ اشْهَدْ হে আল্লাহ! তুমি সাক্ষী থাক।
[2] এতে অনুমিত হয় যে, ইবনু মাসঊদ (রাঃ)-এর সাথে ঐ সময় ইবনু ওমর (রাঃ) হাযির ছিলেন এবং উভয়ে উক্ত ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী ছিলেন।
এ সময় তাঁর বয়স ছিল ১৩ বছরের মত। ঘটনাটি ৯ম নববী বর্ষে ঘটে।[3] উক্ত ঘটনার প্রেক্ষিতে সূরা ক্বামার নাযিল হয়। যার শুরু হ’ল اقْتَرَبَتِ السَّاعَةُ وَانْشَقَّ الْقَمَرُ ‘ক্বিয়ামত আসন্ন। চন্দ্র বিদীর্ণ হয়েছে’ (ক্বামার ৫৪/১)।
এত বড় ঘটনা চাক্ষুষ দেখা সত্ত্বেও কুরায়েশ নেতারা ঈমান আনলেন না।
পরে বিভিন্ন এলাকা হতে আগত লোকদের কাছেও তারা একই ঘটনা শোনেন।
ইবনু মাসঊদ বলেন, তারা বললেন, এটা আবু কাবশার পুত্রের (মুহাম্মাদের) জাদু। সে তোমাদের জাদু করেছে। অতএব তোমরা বহিরাগত লোকদের জিজ্ঞেস কর।
কেননা মুহাম্মাদ একসঙ্গে সবাইকে জাদু করতে পারবে না। অতএব বহিরাগতরা বললে সেটাই ঠিক। নইলে এটা স্রেফ জাদু মাত্র।
অতঃপর চারদিক থেকে আসা মুসাফিরদের জিজ্ঞেস করলেন। তারা সবাই এ দৃশ্য দেখেছেন বলে সাক্ষ্য দেন’।
[4] কিন্তু যিদ ও অহংকার তাদেরকে ঈমান আনা হতে বিরত রাখলো।
এ প্রসঙ্গে আল্লাহ বলেন, وَإِن يَّرَوْا آيَةً يُعْرِضُوا وَيَقُولُوا سِحْرٌ مُّسْتَمِرٌّ، وَكَذَّبُوا وَاتَّبَعُوا أَهْوَاءَهُمْ وَكُلُّ أَمْرٍ مُّسْتَقِرٌّ
তারা যদি কোন নিদর্শন (যেমন চন্দ্র দ্বিখন্ডিত করণ) দেখে, তবে মুখ ফিরিয়ে নেয় এবং বলে যে, এটা তো চলমান জাদু’। ‘তারা মিথ্যারোপ করে এবং নিজেদের খেয়াল-খুশীর অনুসরণ করে। অথচ প্রত্যেক কাজের ফলাফল (ক্বিয়ামতের দিন) স্থিরীকৃত হবে (ক্বামার ৫৪/২-৩)।
তারীখে ফিরিশতায় বর্ণিত হয়েছে যে, চন্দ্র দ্বিখন্ডিত হওয়ার এই দৃশ্য ভারতের মালাবারের জনৈক মহারাজা স্বচক্ষে দেখেন এবং তা নিজের রোজনামচায় লিপিবদ্ধ করেন।
পরে আরব বণিকদের মুখে ঘটনা শুনে তখনকার রাজা ‘সামেরী’ উক্ত রোজনামচা বের করেন। অতঃপর তাতে ঘটনার সত্যতা দেখে তিনি মুসলমান হয়ে যান। যদিও সামরিক নেতা ও সমাজনেতাদের ভয়ে তিনি ইসলাম গোপন রাখেন’।
[5] ১৯৬৯ সালের ২০শে জুলাই চন্দ্রে প্রথম পদাপর্ণকারী দলের নেতা নেইল আর্মষ্ট্রং স্বচক্ষে চন্দ্রপৃষ্ঠের বিভক্তি রেখা দেখে বিস্ময়াভিভূত হন এবং ইসলাম কবুল করেন। কিন্তু মার্কিন প্রশাসনের ভয়ে তিনি একথা কয়েক বছর পরে প্রকাশ করেন।
[6] চন্দ্র দ্বিখন্ডিত করা ছাড়াও রাসূল (সঃ)-এর জীবনে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন মু‘জেযা প্রদর্শিত হয়েছে। কিন্তু এগুলি ছিল কেবল হঠকারীদের অহংকার চূর্ণ করার জন্য।
এর দ্বারা তারা কখনোই হেদায়াত লাভ করেনি। যদিও এর ফলে দ্বীনদারগণের ঈমান বৃদ্ধি পেয়েছে।
[1]. বুখারী হা/৩৮৬৮; মুসলিম হা/২৮০০ (৪৩-৪৪); মিশকাত হা/৫৮৫৪-৫৫।
[2]. মুসলিম হা/২৮০০ (৪৫) ‘মুনাফিকদের বৈশিষ্ট্যাবলী’ অধ্যায়, ‘চন্দ্র দ্বিখন্ডিত করণ’ অনুচ্ছেদ।
[3]. মানছূরপুরী, রহমাতুল্লিল ‘আলামীন ৩/১৫৫ পৃঃ।
[4]. তাফসীর ইবনু জারীর হা/৩২৬৯৯ প্রভৃতি; সনদ ছহীহ; কুরতুবী হা/৫৭৩৭।
[5]. মুহাম্মাদ ক্বাসেম হিন্দুশাহ ফিরিশতা, তারীখে ফিরিশতা (ফার্সী হতে উর্দূ অনুবাদ : লাক্ষ্ণৌ ছাপা, ১৩২৩/১৯০৫) ১১শ অধ্যায় ‘মালাবারের শাসকদের ইতিহাস’ ২/৪৮৮-৮৯ পৃঃ।
[6]. লেখক নিজে উক্ত চন্দ্র বিজয়ী দলের ঢাকা সফরকালে নিকট থেকে তাদের স্বচক্ষে দেখেছেন এবং অনেক পরে বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় উক্ত খবরটি পড়েছেন। -লেখক।
অপবাদের সংখ্যা বৃদ্ধি ও অন্যান্য কৌশল সমূহ
আপোষমুখী প্রস্তাব সমূহ
পেশঃ বুদ্ধিবৃত্তিক ও অলৌকিক সকল পন্থায় পরাজিত হয়ে কুরায়েশ নেতারা এবার আপোষমুখী পদ্ধতি গ্রহণ করল। ‘কিছু গ্রহণ ও কিছু বর্জন’-এর নীতিতে তারা রাসূল (সঃ)-এর সাথে আপোষ করতে চাইল।
কুরআনের ভাষায় وَدُّوْا لَوْ تُدْهِنُ فَيُدْهِنُوْنَ ‘তারা চায় যদি তুমি কিছুটা শিথিল হও, তাহ’লে তারাও নমনীয়তা দেখাবে’ (ক্বলম ৬৮/৯)।
এ বিষয়ে তাদের প্রস্তাবগুলি ছিল নিম্নরূপ :
(ক) একদিন রাসূল (সঃ) কা‘বায় তাওয়াফ করছিলেন। এমতাবস্থায় আসওয়াদ বিন আবদুল মুত্ত্বালিব, অলীদ বিন মুগীরাহ, উমাইয়া বিন খালাফ, ‘আছ বিন ওয়ায়েল প্রমুখ মক্কার বিশিষ্ট নেতৃবর্গ রাসূলুল্লাহ (সঃ)
-এর নিকটে এসে আপোষ প্রস্তাব দিয়ে বলেন,
يَا مُحَمَّدُ، هَلُمَّ فَلْنَعْبُدْ مَا تَعْبُدُ، وَتَعْبُدُ مَا نَعْبُدُ، فَنَشْتَرِكُ نَحْنُ وَأَنْتَ فِي الْأَمْرِ، فَإِنْ كَانَ الَّذِي تَعْبُدُ خَيْرًا مِمَّا نَعْبُدُ، كُنَّا قَدْ أَخَذْنَا بِحَظِّنَا مِنْهُ، وَإِنْ كَانَ مَا نَعْبُدُ خَيْرًا مِمَّا تَعْبُدُ، كُنْتَ قَدْ أَخَذْتَ بِحَظِّكَ مِنْهُ
হে মুহাম্মাদ! এসো আমরা ইবাদত করি তুমি যার ইবাদত কর এবং তুমি পূজা কর আমরা যার পূজা করি। আমরা এবং তুমি আমাদের কাজে পরস্পরে শরীক হই।
অতঃপর তুমি যার ইবাদত কর, তিনি যদি উত্তম হন আমরা যাদের পূজা করি তাদের চাইতে, তাহ’লে আমরা তার ইবাদতে পুরাপুরি অংশ নিব।
আর আমরা যাদের পূজা করি, তারা যদি উত্তম হয় তুমি যার ইবাদত কর তাঁর চাইতে, তাহ’লে তুমি তাদের পূজায় পুরাপুরি অংশ নিবে’ (ইবনু হিশাম১/৩৬২)।
[1] ইবনু জারীর-এর বর্ণনায় এসেছে, ونُشركُكَ في أَمرِنا كُلِّهِ، فإن كان الذي جِئتَ به خيرًا مما بأيدينا، كنا قد شَرِكناكَ فيه ‘আমরা তোমাকে আমাদের সকল কাজে শরীক করব।
অতঃপর তুমি যে দ্বীন নিয়ে এসেছ, তা যদি আমাদের দ্বীনের চাইতে উত্তম হয়, তাহ’লে আমরা সবাই তোমার সাথে তাতে শরীক হব।
আর যদি আমাদেরটা উত্তম হয়, তাহ’লে তুমি আমাদের কাজে শরীক হবে এবং তাতে পুরোপুরি অংশগ্রহণ করবে’। তখন অত্র সূরা নাযিল হয়।
(খ) যদি তুমি আমাদের কোন একটি মূর্তিকে চুমু দাও, তাহ’লে আমরা তোমাকে সত্য বলে মেনে নিব।
(গ) তারা একথাও বলেছিল যে, তুমি চাইলে আমরা তোমাকে এত মাল দেব যে, তুমি সেরা ধনী হবে। তুমি যাকে চাও, তার সাথে তোমাকে বিয়ে দেব।
আর আমরা সবাই তোমার অনুসারী হব। কেবল তুমি আমাদের দেব-দেবীদের গালি দেওয়া বন্ধ কর। যদি তাতেও তুমি রাযী না হও, তাহ’লে একটি প্রস্তাবে তুমি রাযী হও, যাতে আমাদের ও তোমার মঙ্গল রয়েছে। আর তা হল,
(ঘ) তুমি আমাদের উপাস্য লাত-উযযার এক বছর পূজা কর এবং আমরা তোমার উপাস্যের এক বছর পূজা করব।
এইভাবে এক বছর এক বছর করে সর্বদা চলবে’। তখন সূরা কাফেরূন নাযিল হয় (কুরতুবী) এবং তাদের সাথে চূড়ান্ত বিচ্ছেদ ঘোষণা করা হয়।
[2] সূরা কাফেরূন নাযিলের কারণ হিসাবে বর্ণিত উপরোক্ত বিষয়গুলির সূত্র যথার্থভাবে ছহীহ নয়। তবে এগুলির প্রসিদ্ধি অতি ব্যাপক। যা ইবনু জারীর, কুরতুবী, ইবনু কাছীরসহ প্রায় সকল প্রসিদ্ধ তাফসীর গ্রন্থে এসেছে।
অতএব সূত্র দুর্বল হ’লেই ঘটনা সঠিক নয়, তা বলা যাবে না। কেননা সূরা কাফেরূনের বক্তব্যেই ঘটনার যথার্থতা প্রতীয়মান হয়।
[1]. ইবনু জারীর, কুরতুবী; ইবনু হিশাম ১/৩৬২ ‘সূরা কাফেরূন নাযিলের কারণ’ অনুচ্ছেদ; আলবানী, ছহীহুস সীরাহ ২০১-২০২ পৃঃ ।
[2]. আর-রাহীক্ব পৃঃ ৮৪-৮৫; তাফসীর ইবনু জারীর, কুরতুবী, ইবনু কাছীর প্রভৃতি; ইবনু হিশাম ১/৩৬২। বর্ণনাটির সনদ ‘মুরসাল’ (তাহকীক ইবনু হিশাম ক্রমিক ৩৫৪); মা শা-‘আ ৫১ পৃঃ।
অপবাদের সংখ্যা বৃদ্ধি ও অন্যান্য কৌশল সমূহ
লোভনীয় প্রস্তাবসমূহ পেশঃ
অতঃপর তারা সাধারণ মুসলমানদের ফিরিয়ে আনার জন্য লোভনীয় প্রস্তাব সমূহ পেশ করল।
সেরা ধনী অলীদ বিন মুগীরাহ্র নেতৃত্বে তারা নির্যাতিত-নিপীড়িত নওমুসলিমদের বলতে লাগলো যে, তোমরা পিতৃধর্মে ফিরে এলে তোমাদের জীবনে সচ্ছলতা ও সুখ-সাচ্ছন্দ্য ফিরিয়ে দেওয়া হবে। এমনকি পরকালে তোমাদের পাপের বোঝা আমরাই বহন করব।
যেমন আল্লাহ বলেন,
وَقَالَ الَّذِيْنَ كَفَرُوا لِلَّذِيْنَ آمَنُوا اتَّبِعُوْا سَبِيْلَنَا وَلْنَحْمِلْ خَطَايَاكُمْ وَمَا هُمْ بِحَامِلِيْنَ مِنْ خَطَايَاهُمْ مِنْ شَيْءٍ إِنَّهُمْ لَكَاذِبُوْنَ- وَلَيَحْمِلُنَّ أَثْقَالَهُمْ وَأَثْقَالاً مَعَ أَثْقَالِهِمْ وَلَيُسْأَلُنَّ يَوْمَ الْقِيَامَةِ عَمَّا كَانُوا يَفْتَرُونَ- (العنكبوت ১২-১৩)-
কাফিররা মুমিনদের বলে, তোমরা আমাদের পথ অনুসরণ কর, আমরা তোমাদের পাপভার বহন করব।
অথচ তারা তাদের পাপভার কিছুই বহন করবে না। নিশ্চয়ই তারা মিথ্যাবাদী’। ‘তারা নিজেদের পাপের বোঝা বহন করবে এবং তাদের বোঝার সাথে অন্যদের বোঝা সমূহ।
আর তারা যেসব মিথ্যা উদ্ভাবন করে, সেবিষয়ে তাদেরকে ক্বিয়ামতের দিন অবশ্যই প্রশ্ন করা হবে’ (আনকাবূত ২৯/১২-১৩; তাফসীর ইবনু কাছীর)। বস্ত্ততঃ কুফর ও নিফাকের অনুসারী বাতিলপন্থীরা সর্বযুগে উক্ত কপট নীতি অনুসরণ করে থাকে।
উদ্ভট দাবী সমূহ পেশ
যেমন- উৎবা, শায়বাহ, আবু সুফিয়ান, নযর বিন হারেছ, আবুল বাখতারী, আসওয়াদ বিন মুত্ত্বালিব, অলীদ বিন মুগীরাহ, আবু জাহল, উমাইয়া বিন খালাফ, আব্দুল্লাহ ইবনু আবী উমাইয়া সহ ১৪জন কুরায়েশ নেতা রাসূল (সঃ)-কে মাগরিবের পর কা‘বা চত্বরে ডাকিয়ে এনে বললেন, হে মুহাম্মাদ !
তুমি তোমার বংশের উপরে যে বিপদ ডেকে এনেছ, সমগ্র আরবে কেউ তা আনেনি। لَقَدْ شَتَمْتَ الْآبَاءَ، وَعِبْتَ الدِّينَ، وَشَتَمْتَ الْآلِهَةَ، وَسَفَّهْتَ الْأَحْلاَمَ، وَفَرَّقْتَ الْجَمَاعَةَ
তুমি তোমার বাপ-দাদাকে গালি দিয়েছ, তাদের দ্বীনকে দোষারোপ করেছ, উপাস্যদের গালি দিয়েছ, জ্ঞানীদের বোকা ধারণা করেছ এবং আমাদের জামা‘আতকে বিভক্ত করেছ’।
এক্ষণে যদি তুমি এগুলো পরিত্যাগের বিনিময়ে মাল চাও, মর্যাদা চাও, নেতৃত্ব চাও, শাসন ক্ষমতা চাও, তোমার জিন ছাড়ানোর চিকিৎসক চাও, সবই তোমাকে দিব।
জবাবে রাসূল (সঃ) বললেন, আল্লাহ আমাকে আপনাদের নিকট রাসূল হিসাবে পাঠিয়েছেন। আমি আপনাদের নিকট রিসালাত পৌঁছে দিয়েছি।
যদি আপনারা সেটা কবুল করেন, তাহ’লে দুনিয়া ও আখেরাতে আপনাদের কল্যাণ হবে। আর যদি অস্বীকার করেন, তাহ’লে আমি আল্লাহর আদেশের অপেক্ষায় ধৈর্য ধারণ করব।
যতক্ষণ না তিনি আমার ও আপনাদের মধ্যে ফায়ছালা করে দেন’। তখন নেতারা বললেন, তুমি যদি আমাদের কোন কথাই না শোন, তাহ’লে তোমার প্রভুকে বল যেন,
(১) তিনি মক্কার পাহাড়গুলি সরিয়ে এস্থানটিকে সমতল ভূমিতে পরিণত করে দেন। কেননা তুমি জান মক্কার চাইতে সংকীর্ণ শহর আর নেই।
(২) তোমার প্রভু যেন এখানে নদীসমূহ প্রবাহিত করে দেন, যেমন শাম ও ইরাকে রয়েছে।
(৩) আমাদের সাবেক নেতা কুছাই বিন কিলাবকে জীবিত করে এনে দাও। যার কাছে শুনব তোমাকে যে আল্লাহ রাসূল করে পাঠিয়েছেন, তা সত্য কি-না।
(৪) তোমার প্রভু যেন তোমার সঙ্গে একজন ফেরেশতা পাঠান, যিনি তোমার ব্যাপারে সত্যায়ন করবেন।
(৫) তুমি তাঁর নিকটে প্রার্থনা কর, যেন তোমার জন্য বাগ-বাগিচা এবং স্বর্ণ ও রৌপ্য মন্ডিত প্রাসাদ বানিয়ে দেন।
(৬) আমরা তোমার উপরে ঈমান আনিনি বিধায় তোমার প্রভু যেন আমাদের উপর আকাশকে টুকরা-টুকরা করে গযব হিসাবে নামিয়ে দেন, যেমনটি তুমি ধারণা করে থাক।
(৭) তাদের একজন বলল, আমরা কখনই তোমার উপরে ঈমান আনবো না, যতক্ষণ না আল্লাহ ও ফেরেশতাদেরকে আমাদের সামনে না নিয়ে আসবে।
(৮) আরেকজন নেতা রাসূল (সঃ)-এর ফুফাতো ভাই আব্দুল্লাহ ইবনু আবী উমাইয়া বললেন, আল্লাহর কসম! আমরা কখনই তোমার উপরে ঈমান আনবো না, যতক্ষণ না তুমি আসমান থেকে সিঁড়ি নামিয়ে দিবে।
অতঃপর তুমি তাতে আরোহন করবে ও আল্লাহর কাছে চলে যাবে। অতঃপর সেখান থেকে চারজন ফেরেশতাকে সাথে নিয়ে আসবে, যে তোমার বিষয়ে সাক্ষ্য দিবে যে, তুমি যা বল, তা সত্য।
দাবীগুলির বর্ণনা এবং তার সনদ যঈফ হ’লেও এগুলির বর্ণনা ও এসবের জবাব কুরআনে এসেছে। এতেই বুঝা যায় যে, ঘটনা সঠিক ছিল।
যেমন আল্লাহ বলেন,
وَقَالُوْا لَنْ نُؤْمِنَ لَكَ حَتَّى تَفْجُرَ لَنَا مِنَ الْأَرْضِ يَنْبُوعًا- أَوْ تَكُونَ لَكَ جَنَّةٌ مِنْ نَخِيلٍ وَعِنَبٍ فَتُفَجِّرَ الْأَنْهَارَ خِلاَلَهَا تَفْجِيرًا- أَوْ تُسْقِطَ السَّمَاءَ كَمَا زَعَمْتَ عَلَيْنَا كِسَفًا أَوْ تَأْتِيَ بِاللهِ وَالْمَلاَئِكَةِ قَبِيلاَ- أَوْ يَكُونَ لَكَ بَيْتٌ مِنْ زُخْرُفٍ أَوْ تَرْقَى فِي السَّمَاءِ وَلَنْ نُؤْمِنَ لِرُقِيِّكَ حَتَّى تُنَزِّلَ عَلَيْنَا كِتَابًا نَقْرَؤُهُ قُلْ سُبْحَانَ رَبِّي هَلْ كُنْتُ إِلاَّ بَشَرًا رَسُولاً-
তারা বলল, আমরা কখনোই তোমার উপর বিশ্বাস স্থাপন করব না যতক্ষণ না তুমি আমাদের জন্য ভূমি থেকে ঝর্ণাধারা প্রবাহিত করে দিবে’ (৯০)।
অথবা তোমার জন্য খেজুর ও আঙ্গুরের বাগিচা হবে। যার মধ্যে তুমি ব্যাপকভাবে (শাম ও ইরাকের ন্যায়) নদী-নালা প্রবাহিত করাবে’ (৯১)।
অথবা আকাশকে টুকরা টুকরা করে আমাদের উপরে নিক্ষেপ করবে যেমনটা তুমি ধারণা ব্যক্ত করে থাক। অথবা আল্লাহ ও ফেরেশতাদেরকে আমাদের সামনে নিয়ে আসবে’ (৯২)।
অথবা তোমার একটি স্বর্ণমন্ডিত প্রাসাদ হবে। অথবা তুমি আকাশে আরোহণ করবে। অবশ্য আমরা তোমার আকাশে আরোহণে বিশ্বাস করব না যতক্ষণ না তুমি সেখান থেকে (তোমার সত্যতার পক্ষে) আমাদের উপর কোন কিতাব নাযিল করাবে, যা আমরা পড়ে দেখব।
তুমি বল, আমার প্রভু (এইসব থেকে) পবিত্র। আমি একজন মানুষ রাসূল ব্যতীত কিছুই নই’ (ইসরা ১৭/৯০-৯৩)। কাফেররা মানুষ রাসূল চায়নি, ফেরেশতা রাসূল চেয়েছিল।
যার প্রতিবাদে এক আয়াত পরেই আল্লাহ বলেন, قُلْ لَوْ كَانَ فِي الْأَرْضِ مَلَائِكَةٌ يَمْشُونَ مُطْمَئِنِّينَ لَنَزَّلْنَا عَلَيْهِمْ مِنَ السَّمَاءِ مَلَكًا رَسُولاً ‘যদি ফেরেশতারা যমীনে স্বচ্ছন্দে পদচারণা করতে পারত, তাহ’লে আমরা তাদের জন্য ফেরেশতা রাসূল পাঠাতাম’ (ইসরা ১৭/৯৫)।
মুসলমানদের মধ্যে যারা রাসূল (সঃ)-কে ‘নূরের নবী’ বলেন, তারা কি কাফেরদের ‘ফেরেশতা রাসূল’ দাবীর সাথে সুর মিলাচ্ছেন না ?
অতএব আল্লাহ নিরাকার। তিনি সর্বত্র বিরাজমান। প্রত্যেক সৃষ্টিই আল্লাহর অংশ। রাসূল (সঃ) মানুষ নবী নন, তিনি নূরের নবী ইত্যাদি নষ্ট আক্বীদা থেকে প্রথমেই তওবা করা আবশ্যক।
ইবনু কাছীর বলেন, কুরায়েশ নেতারা রাসূল (সঃ)-এর নিকটে এগুলি দাবী করেছিল। যদি আল্লাহ এর মধ্যে তাদের কোন কল্যাণ আছে বলে জানতেন, তাহলে অবশ্যই তা কবুল করতেন।
]
কিন্তু তিনি ভালভাবেই অবহিত ছিলেন যে, তারা এসব প্রশ্ন করছে স্রেফ কুফরী ও হঠকারিতা বশে। সেকারণ তিনি তা কবুল করেননি (ইবনু কাছীর, তাফসীর উক্ত আয়াত)।
ইবনু আববাস (রাঃ) বলেন, কুরায়েশরা রাসূল (সঃ)-এর নিকটে দাবী করল যে, আপনি আপনার প্রতিপালকের নিকটে দো‘আ করুন।
যেন তিনি ছাফা পাহাড়কে আমাদের জন্য স্বর্ণ বানিয়ে দেন। তাহ’লে আমরা ঈমান আনব। রাসূল (সঃ) তাদের দাবী মোতাবেক দো‘আ করলেন।
অতঃপর জিব্রীল (আঃ) রাসূল (সঃ)-এর নিকটে এসে তাঁর প্রতি আল্লাহ তা‘আলার সালাম পৌঁছে দিয়ে বললেন, আল্লাহ বলেছেন, ‘আপনি চাইলে আমি তাদের জন্য ছাফা পাহাড়কে স্বর্ণে রূপান্তরিত করব।
কিন্তু এরপর যারা কুফরী করবে, তাদেরকে আমি এমন শাস্তির সম্মুখীন করব, যা আমি পৃথিবীর অন্য কাউকে দেইনি। আর যদি তুমি চাও তবে আমি তওবা ও রহমতের দুয়ার খুলে দিব।
তখন রাসূল (সঃ) তওবা ও রহমতই কামনা করলেন।
অতঃপর আল্লাহ নাযিল করলেন, وَمَا مَنَعَنَا أَنْ نُرْسِلَ بِالْآيَاتِ إِلاَّ أَنْ كَذَّبَ بِهَا الْأَوَّلُونَ وَآتَيْنَا ثَمُودَ النَّاقَةَ مُبْصِرَةً فَظَلَمُوا بِهَا وَمَا نُرْسِلُ بِالْآيَاتِ إِلاَّ تَخْوِيفًا
‘পূর্ববর্তী উম্মতসমূহ কর্তৃক নিদর্শন সমূহকে অস্বীকার করাই আমাদেরকে (তোমাদের প্রতি) নিদর্শন প্রেরণ করা হ’তে বিরত রেখেছে।
আমরা ছামূদ কওমের নিকট স্পষ্ট নিদর্শন স্বরূপ উষ্ট্রী পাঠিয়েছিলাম। অতঃপর তারা তার প্রতি অত্যাচার করেছিল (অর্থাৎ হত্যা করেছিল)। আর আমরা কেবল ভয় প্রদর্শনের জন্যেই নিদর্শন সমূহ প্রেরণ করে থাকি’ (ইসরা ১৭/৫৯)।
[1]. ইবনু জারীর, ইবনু কাছীর, তাফসীর সূরা বাক্বারাহ ১০৮; কুরতুবী হা/৪০৭৯, সনদ যঈফ; ইবনু হিশাম ১/২৯৫-২৯৮।
[2]. আহমাদ হা/২১৬৬; হাকেম হা/৩৩৭৯; সিলসিলা ছহীহাহ হা/৩৩৮৮।
অপবাদের সংখ্যা বৃদ্ধি ও অন্যান্য কৌশল সমূহ
দুনিয়াবী স্বার্থ লাভের দাবী পেশঃ এক সময় তারা তিনটি দাবী নিয়ে উপস্থিত হয়।
(ক) যদি তুমি সত্যই নবী হয়ে থাক, তাহ’লে সারা পৃথিবীর ধন-ভান্ডার আমাদের কাছে এনে দাও।
(খ) আমাদের ভবিষ্যৎ ভাল-মন্দের বিষয়গুলি বলে দাও। যাতে আমরা আগেভাগে সাবধান হ’তে পারি।
(গ) তুমি একজন ফেরেশতাকে নবী হিসাবে এনে দাও, আমরা তাকে নেতা রূপে মেনে নেব। কেননা তুমি তো আমাদেরই মত একজন মানুষ মাত্র।
জবাবে আল্লাহ নিম্নোক্ত আয়াত নাযিল করেন,
قُل لآ أَقُولُ لَكُمْ عِنْدِيْ خَزَآئِنُ اللهِ وَلا أَعْلَمُ الْغَيْبَ وَلا أَقُولُ لَكُمْ إِنِّي مَلَكٌ إِنْ أَتَّبِعُ إِلاَّ مَا يُوحَى إِلَيَّ قُلْ هَلْ يَسْتَوِي الأَعْمَى وَالْبَصِيرُ أَفَلاَ تَتَفَكَّرُونَ- (الأنعام 50)
তুমি বলে দাও, আমি তোমাদের একথা বলিনা যে, আমার কাছে আল্লাহর ধন-ভান্ডার সমূহ রয়েছে। আর আমি অদৃশ্য বিষয় অবগত নই। আমি একথাও বলি না যে, আমি ফেরেশতা।
আমি তো কেবল তারই অনুসরণ করি, যা আমার নিকটে ‘অহি’ করা হয়। তুমি বল, অন্ধ ও চক্ষুষ্মান কি কখনো সমান হয়? তোমরা কি চিন্তা করবে না ? (আন‘আম ৬/৫০)।
অপবাদের সংখ্যা বৃদ্ধি ও অন্যান্য কৌশল সমূহ
বিভিন্ন অপযুক্তি প্রদর্শনঃ যেমন-
(ক) আল্লাহ প্রেরিত রাসূল হ’লে উনি কখনো মানুষের মত খাওয়া-দাওয়া ও বাজার-ঘাট করতেন না। আল্লাহ বলেন, وَقَالُوا مَالِ هَذَا الرَّسُوْلِ يَأْكُلُ الطَّعَامَ وَيَمْشِي فِي الْأَسْوَاقِ لَوْلاَ أُنزِلَ إِلَيْهِ مَلَكٌ فَيَكُونَ مَعَهُ نَذِيراً ‘তারা বলে, এ কেমন রাসূল যে খাদ্য ভক্ষণ করে ও হাট-বাজারে চলাফেরা করে ?
কেন তার নিকটে ফেরেশতা নাযিল হ’ল না যে তার সাথে সর্বদা সতর্ককারী হিসাবে থাকত’ (ফুরক্বান ২৫/৭)।
[1] জবাবে আল্লাহ বলেন, وَلَوْ جَعَلْنَاهُ مَلَكاً لَّجَعَلْنَاهُ رَجُلاً وَلَلَبَسْنَا عَلَيْهِم مَّا يَلْبِسُونَ ‘যদি আমরা কোন ফেরেশতাকে রাসূল করে পাঠাতাম, তবে সে মানুষের আকারেই হ’ত এবং তাকে ঐ ধরনের পোষাক পরাতাম, যা তারা পরিধান করে’ (আন‘আম ৬/৯)।
তিনি বলেন, اُنْظُرْ كَيْفَ ضَرَبُوْا لَكَ الْأَمْثَالَ فَضَلُّوْا فَلاَ يَسْتَطِيْعُوْنَ سَبِيْلاً ‘দেখ ওরা কিভাবে তোমার নামে (বাজে) উপমা সমূহ প্রদান করছে। ওরা পথভ্রষ্ট হয়েছে। অতএব ওরা আর পথ পেতে সক্ষম হবে না’ (ইসরা/বনু ইস্রাঈল ১৭/৪৮; ফুরক্বান ২৫/৯)।
(খ) তারা বলল, যদি নিতান্তই কোন মানুষকে নবী করার ইচ্ছা ছিল, তাহ’লে মক্কা ও ত্বায়েফের বিত্তবান প্রভাবশালী কোন নেতাকে কেন নবী করা হ’ল না ? যেমন আল্লাহ বলেন, وَقَالُوْا لَوْلاَ نُزِّلَ هَذَا الْقُرْآنُ عَلَى رَجُلٍ مِّنَ الْقَرْيَتَيْنِ عَظِيْمٍ
‘তারা বলে, কুরআন কেন দুই জনপদের কোন প্রধান ব্যক্তির উপরে অবতীর্ণ হ’ল না ?
(যুখরুফ ৪৩/৩১)। জবাবে আল্লাহ বলেন, أَهُمْ يَقْسِمُوْنَ رَحْمَةَ رَبِّكَ ‘তারা কি তোমার প্রতিপালকের অনুগ্রহ বণ্টন করবে ? (যুখরুফ ৪৩/৩২)।
অর্থাৎ আল্লাহ কাকে অনুগ্রহ করে নবুঅত দান করবেন এটা কেবল তাঁরই এখতিয়ার। এতে অন্যদের কিছুই করার নেই।
(গ) কোন যুক্তিতে কাজ না হওয়ায় অবশেষে তারা অজুহাত দিল, যদি আল্লাহ চাইতেন, তাহ’লে আমরা শিরক করতাম না। যেমন আল্লাহ বলেন,
سَيَقُوْلُ الَّذِيْنَ أَشْرَكُواْ لَوْ شَآء اللهُ مَا أَشْرَكْنَا وَلاَ آبَاؤُنَا وَلاَ حَرَّمْنَا مِن شَيْءٍ كَذَلِكَ كَذَّبَ الَّذِينَ مِن قَبْلِهِم حَتَّى ذَاقُوا بَأْسَنَا قُلْ هَلْ عِندَكُم مِّنْ عِلْمٍ فَتُخْرِجُوهُ لَنَا إِن تَتَّبِعُونَ إِلاَّ الظَّنَّ وَإِنْ أَنتُمْ إَلاَّ تَخْرُصُوْنَ- (الأنعام ১৪৮)-
সত্বর মুশরিকরা বলবে, যদি আল্লাহ ইচ্ছা করতেন তাহ’লে না আমরা শিরক করতাম, না আমাদের বাপ-দাদারা। আর না আমরা কোন বস্ত্তকে হারাম করতাম।
বস্ত্ততঃ এভাবেই তাদের পূর্ব যুগের কাফিররা (রাসূলদের) মিথ্যা সাব্যস্ত করেছিল। অবশেষে তারা আমাদের শাস্তির স্বাদ আস্বাদন করেছিল। তুমি বল, তোমাদের কাছে কি কোন প্রমাণ আছে, যা আমাদের দেখাতে পার ?
তোমরা কেবল ধারণার অনুসরণ কর এবং কেবল অনুমান ভিত্তিক কথা বলে থাক’ (আন‘আম ৬/১৪৮)। বস্ত্ততঃ এ আয়াতটিই হ’ল অদৃষ্টবাদী ভ্রান্ত ফের্কা জাবরিয়াদের প্রধান দলীল।
অথচ বান্দা শিরক ও কুফরীতে লিপ্ত হউক, এটা কখনোই আল্লাহ চান না। যেমন তিনি বলেন, وَلاَ يَرْضَى لِعَبِادِهِ الْكُفْرَ ‘তিনি তার বান্দাদের কুফরীতে সন্তুষ্ট হন না’ (যুমার ৩৯/৭)।
[1]. কাফের নেতাদের ধন্যবাদ দিতে হয় যে, তাদের মাথায় রাসূল (সঃ)-কে ‘নূর’ বলার যুক্তিটির উদয় হয়নি। কেননা ‘নূর’ হ’লে তার খাওয়া-পরা ও বাজার-ঘাট কিছুই লাগে না। যেমন একদল পীর ও মুফতী তাঁকে ‘নূর’ বানিয়েছেন এবং ‘তিনি মরেননি’ বলে প্রচার করেন।
সেই সাথে ‘আওলিয়ারা মরেন না’ বলে চুটিয়ে কবরপূজার ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছেন। এভাবে স্বাধীন মানুষকে তারা মৃত মানুষের গোলামে পরিণত করেছেন। আর ভক্তদের পকেট ছাফ করছেন।
রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর উপর নানামুখী অত্যাচার ঠাট্টা-বিদ্রুপ করাঃ
সমস্ত যুক্তি, কৌশল ও আপোষ প্রস্তাব ব্যর্থ হওয়ার পর কুরায়েশ নেতারা এবার রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর উপরে সরাসরি অত্যাচারের সিদ্ধান্ত নিল। যেমন-
রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর দিক থেকে লোকদের ফিরিয়ে আনার জন্য কুরায়েশ নেতারা বিদ্রুপ করে বলে, আমরাও এরূপ বলতে পারি।
এ বিষয়ে আল্লাহ বলেন, وَإِذَا تُتْلَى عَلَيْهِمْ آيَاتُنَا قَالُوْا قَدْ سَمِعْنَا لَوْ نَشَاءُ لَقُلْنَا مِثْلَ هَـذَا إِنْ هَـذَا إِلاَّ أَسَاطِيْرُ الْأَوَّلِيْنَ ‘যখন তাদের নিকটে আমাদের আয়াত সমূহ পাঠ করা হয়, তখন তারা বলে, আমরা শুনেছি।
ইচ্ছা করলে আমরাও এরূপ বলতে পারি। এসব তো পূর্ববর্তীদের উপকথা ভিন্ন কিছুই নয়’ (আনফাল ৮/৩১)।
উক্ত আয়াতে কাফেররা ‘কুরআনকে পুরাকালের কাহিনী এবং ইচ্ছা করলে আমরাও এরূপ বলতে পারি’ বলে দম্ভ প্রকাশ করেছে। অথচ অনুরূপ একটি কুরআন বা তার মত দু’একটি সূরা বা আয়াত জিন-ইনসান সকলকে একত্রিত হয়ে রচনা করে আনার জন্য মক্কায় পাঁচবার,
[1] এবং মদীনায় একবার (বাক্বারাহ ২/২৩-২৪) সহ মোট ছয়বার কাফেরদের চ্যালেঞ্জ করা হয়েছে।
কিন্তু সে যুগে ও এ যুগে কেউ সে চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করেনি। বরং দেখা গেছে যে, সে যুগে ঐসব নেতারাই গোপনে রাতের অন্ধকারে বাইরে দাঁড়িয়ে তাহাজ্জুদের ছালাতে রাসূল (ছাঃ)-এর কুরআন তেলাওয়াত শুনত।
আবু সুফিয়ান, নযর বিন হারেছ, আখনাস বিন শারীক্ব, আবু জাহল প্রমুখ নেতারা একে অপরকে না জানিয়ে গোপনে একাজ করত’ (ইবনু হিশাম ১/৩১৫-১৬)।
কিন্তু যখন তারা তাদের জনগণের সামনে যেত, তখন তাদের মন্তব্য পাল্টে যেত। কারণ তখন দুনিয়াবী স্বার্থ তাদেরকে সত্যভাষণ থেকে ফিরিয়ে রাখত।
একই অবস্থা আজকালকের মুসলিম-অমুসলিম নেতাদের। যাদের অধিকাংশ রাসূল (সঃ) ও কুরআনের সত্যতাকে স্বীকার করে। কিন্তু বাস্তবে তা মানতে রাযী হয় না স্রেফ দুনিয়াবী স্বার্থের কারণে।
এভাবে কাফেররা তাঁকে হত্যার সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগ পর্যন্ত নানারূপ মানসিক কষ্ট দেয়।
এ সময় আল্লাহ তাঁকে সান্ত্বনা দিয়ে বলেন, وَاصْبِرْ عَلَى مَا يَقُوْلُوْنَ وَاهْجُرْهُمْ هَجْرًا جَمِيْلاً ‘তারা যেসব কথা বলে, তাতে তুমি ছবর কর এবং তাদেরকে সুন্দরভাবে পরিহার করে চল’ (মুযযাম্মিল ৭৩/১০)।
তিনি আরও বলেন, إِنَّا كَفَيْنَاكَ الْمُسْتَهْزِئِيْنَ ‘বিদ্রূপকারীদের বিরুদ্ধে আমরাই তোমার জন্য যথেষ্ট’ (হিজর ১৫/৯৫)।
[1]. ইউনুস ১০/৩৮; হূদ ১১/১৩; ইসরা ১৭/৮৮; ক্বাছাছ ২৮/৪৯, তুর ৫২/৩৪।
রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর উপর নানামুখী অত্যাচার
প্রতিবেশীদের অত্যাচারঃ রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর নিকটতম প্রতিবেশী ছিলেন তাঁর চাচা আবু লাহাব।
তিনি ও তার স্ত্রী ছাড়াও কষ্টদানকারী অন্যান্য প্রতিবেশী ছিল হাকাম বিন আবুল ‘আছ বিন উমাইয়া, উক্ববা বিন আবু মু‘আইত্ব, ‘আদী বিন হামরা ছাক্বাফী, ইবনুল আছদা আল-হুযালী।
প্রতিবেশীদের মধ্যে কেবল হাকাম বিন আবুল ‘আছ বিন উমাইয়া ইসলাম কবুল করেছিলেন (ইবনু হিশাম ১/৪১৫-১৬)। ইনিই ছিলেন উমাইয়া বংশের অন্যতম খলীফা মারওয়ানের পিতা।
বস্ত্ততঃ মু‘আবিয়া (রাঃ) ও ইয়াযীদ বাদে মারওয়ানের বংশধরগণই ছিলেন উমাইয়া খেলাফতের পরপর খলীফা। অন্যান্য প্রতিবেশীরাও রাসূল (সঃ)-এর উপর নানাবিধ অত্যাচার চালায়।
তাতে সান্ত্বনা দিয়ে আল্লাহ বলেন, وَلَقَدْ كُذِّبَتْ رُسُلٌ مِنْ قَبْلِكَ فَصَبَرُوا عَلَى مَا كُذِّبُوا وَأُوْذُوا حَتَّى أَتَاهُمْ نَصْرُنَا وَلاَ مُبَدِّلَ لِكَلِمَاتِ اللهِ وَلَقَدْ جَاءَكَ مِنْ نَبَإِ الْمُرْسَلِيْنَ
তোমার পূর্বের বহু রাসূলকে মিথ্যা বলা হয়েছে। কিন্তু এ মিথ্যারোপে তারা ছবর করেছেন এবং তারা নির্যাতিত হয়েছেন যতক্ষণ না তাদের কাছে আমাদের সাহায্য এসে পৌঁছেছে।
আর আল্লাহর বাণীসমূহের পরিবর্তনকারী কেউ নেই। এ বিষয়ে নবীগণের কিছু খবর তোমার নিকটে পৌঁছে গেছে (যার মধ্যে তোমার জন্য অনেক শিক্ষণীয় বিষয় রয়েছে)’ (আন‘আম ৬/৩৪)
[1]. প্রসিদ্ধ আছে যে, প্রতিবেশীরা যবেহ করা দুম্বা-ভেড়ার নাড়ি-ভুঁড়ি রাসূল (সঃ)-এর বাড়ীর মধ্যে ছুঁড়ে মারত।
রাসূল (সঃ) সেগুলি কুড়িয়ে নিয়ে দরজায় দাঁড়িয়ে ডাক দিয়ে বলতেন يَا بَنِي عَبْدِ مَنَافٍ، أَيُّ جِوَارٍ هَذَا؟ ‘হে বনু ‘আব্দে মানাফ! এটা কেমন প্রতিবেশী সূলভ আচরণ ?
এরপর তিনি সেগুলি দূরে ফেলে আসতেন’ (ইবনু হিশাম ১/৪১৬; আর-রাহীক্ব পৃঃ ৮৭)। বর্ণনাটি মওযূ‘ বা জাল (সিলসিলা যঈফাহ হা/৪১৫১)।
রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর উপর নানামুখী অত্যাচার
কা‘বাগৃহে ছালাতরত অবস্থায় কষ্টদান
(ক) আব্দুল্লাহ ইবনে মাস‘ঊদ (রাঃ) বলেন যে, একদিন রাসূল (সঃ) বায়তুল্লাহ্র পাশে ছালাত আদায় করছিলেন। এমন সময় আবু জাহল ও তার সাথীরা অদূরে বসে বলাবলি করতে লাগল, কে উটের নাড়ি-ভুঁড়ি এনে এই ব্যক্তির উপর চাপাতে পারে, যখন সে সিজদায় যাবে ?
তখন ওক্ববা বিন আবী মু‘আইত্ব উটের ভুঁড়ি এনে সিজদারত রাসূলের দুই কাঁধের মাঝখানে চাপিয়ে দিল, যাতে ঐ বিরাট ভুঁড়ির চাপে ও দুর্গন্ধে দম বন্ধ হয়ে তিনি মারা যান।
এতে শত্রুরা হেসে লুটোপুটি খেয়ে একে অপরের উপর গড়িয়ে পড়তে থাকে। ইবনু মাসঊদ বলেন, আমি সব দেখছিলাম। কিন্তু এই অবস্থায় আমার কিছুই করার ছিল না।
এই সময় ফাতেমার কাছে খবর পৌঁছলে তিনি দৌঁড়ে এসে ভুঁড়িটি সরিয়ে দিয়ে পিতাকে সাক্ষাৎ মৃত্যুর হাত থেকে রক্ষা করেন। ইবনু হাজার বলেন, সম্ভবতঃ খবরটি রাবী নিজেই দিয়েছিলেন (বুখারী ফৎহসহ হা/৫২০-এর আলোচনা)।
অতঃপর রাসূলুল্লাহ (সঃ) মাথা উঁচু করে তিনবার বলেন,
اللهُمَّ عَلَيْكَ بِقُرَيْشٍ، اللهُمَّ عَلَيْكَ بِقُرَيْشٍ، اللهُمَّ عَلَيْكَ بِقُرَيْشٍ- ثُمَّ سَمَّى- اللهُمَّ عَلَيْكَ بِعَمْرِو بْنِ هِشَامٍ، وَعُتْبَةَ بْنِ رَبِيعَةَ، وَشَيْبَةَ بْنِ رَبِيعَةَ، وَالْوَلِيدِ بْنِ عُتْبَةَ، وَأُمَيَّةَ بْنِ خَلَفٍ، وَعُقْبَةَ بْنِ أَبِى مُعَيْطٍ، وَعُمَارَةَ بْنِ الْوَلِيدِ، قَالَ عَبْدُ اللهِ فَوَاللهِ لَقَدْ رَأَيْتُهُمْ صَرْعَى يَوْمَ بَدْرٍ، ثُمَّ سُحِبُوا إِلَى الْقَلِيبِ قَلِيبِ بَدْرٍ- متفق عليه-
হে আল্লাহ তুমি কুরায়েশকে ধর (তিনবার)! হে আল্লাহ তুমি আমর ইবনে হেশাম (আবু জাহল)-কে ধর।
হে আল্লাহ তুমি উৎবা ও শায়বাহ বিন রাবী‘আহ, অলীদ বিন উৎবা, উমাইয়া বিন খালাফ, ওক্ববা বিন আবু মু‘আইত্ব এবং উমারাহ বিন অলীদকে ধর’। ইবনু মাস‘ঊদ বলেন, আমি তাদের (উক্ত ৭ জনের) সবাইকে বদর যুদ্ধে নিহত হয়ে কূয়ায় নিক্ষিপ্ত অবস্থায় দেখেছি’।
[1] উটের ভুঁড়ি চাপানোর এই নির্দেশ আবু জাহলই দিয়েছিলেন এবং অন্যেরা তা মেনে নিয়েছিল। সেমতে তার আগের দিন উটসমূহ নহর করা হয়েছিল।
[2] এর দ্বারা বুঝা যায় যে, নেককার ব্যক্তির দো‘আ বা বদ দো‘আ অবশ্যই আল্লাহর নিকটে কবুল হয়। তার বাস্তবায়ন সঙ্গে সঙ্গে হ’তে পারে অথবা আল্লাহ তার থেকে অনুরূপ একটি কষ্ট দূর করে দেন অথবা সেটি আখেরাতে প্রদানের জন্য রেখে দেন’ (আহমাদ হা/১১১৪৯)।
কিন্তু আখেরাতের জন্য রেখে দেওয়ার কারণে বদকারগণ ঐ বদ দো‘আর কোন গুরুত্ব দেয় না। বরং পুনরায় কঠিনভাবে শত্রুতা করতে থাকে।
যেমন আবু জাহ্ল গং রাসূল (সঃ)-এর বদ দো‘আ শুনে ঘাবড়ে গেলেও পরক্ষণে তা ভুলে যায় এবং বিপুল উৎসাহে শত্রুতা করতে থাকে।
ফলে এই ঘটনার প্রায় দশ বছর পর বদর যুদ্ধে তাদের উপরে উক্ত বদ দো‘আর বাস্তবায়ন ঘটে ও সব নেতা একত্রে নিহত হয়।
আর বদর যুদ্ধের পর এক সপ্তাহের মধ্যে আরেক নেতা আবু লাহাব গুটিবসন্তে আক্রান্ত হয়ে পচে-গলে দুর্গন্ধযুক্ত অবস্থায় মক্কায় নিজ গৃহে মারা যায়। এভাবে মযলূম নবী বিজয়ী হন ও যালেম নেতারা ধ্বংস হয়।
উল্লেখ্য যে, রাবী আব্দুল্লাহ ইবনু মাসঊদ (রাঃ) উক্ত হাদীছে বর্ণিত মুশরিক নেতাদের সবাইকে বদরের যুদ্ধে নিহত হয়ে কূয়ায় নিক্ষিপ্ত হ’তে দেখেছেন’ বলে যে কথা বর্ণনায় এসেছে, তার অর্থ হ’ল তিনি এদের ‘অধিকাংশ’কে দেখেছেন।
কেননা ওক্ববা বিন আবু মু‘আইত্ব বদরে যুদ্ধাবস্থায় নিহত হননি। বরং তাকে বন্দী করে মদীনায় নিয়ে যাওয়ার পথে হত্যা করে ফেলে দেওয়া হয়।
উমাইয়া বিন খালাফ বদরে নিহত হ’লেও উক্ত কূয়ায় নিক্ষিপ্ত হননি। বরং অধিক স্থূলদেহী হওয়ায় ও ফুলে যাওয়ার কারণে কূয়ায় ফেলা সম্ভব হয়নি। ফলে তাকে কূয়ার অদূরে একটি গর্তে ফেলে মাটি ও পাথর চাপা দেওয়া হয়।
[3] অতঃপর ‘উমারাহ বিন অলীদ বিন মুগীরাহ মাখযূমী, যাকে কুরায়েশরা দূত হিসাবে বাদশাহ নাজাশীর দরবারে পাঠিয়েছিল।
[4] সেখানে গিয়ে সে জাদুর ঘটনায় জড়িয়ে পড়ে। অতঃপর হাবশার জঙ্গলে কাফের অবস্থায় তার মৃত্যু হয়। ঘটনাটি খুবই প্রসিদ্ধ। তখন ছিল দ্বিতীয় খলীফা হযরত ওমর (রাঃ)-এর খেলাফতকাল।
(খ) একদিন ছালাতরত অবস্থায় ওক্ববা বিন আবু মু‘আইত্ব এসে গলায় জোরে কাপড় পেঁচিয়ে ধরল, যাতে রাসূল (সঃ) নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে মারা যান।
জনৈক ব্যক্তি চিৎকার করে গিয়ে এ খবর দিলে আবুবকর (রাঃ) ছুটে এসে পেঁচানো কাপড় খুলে দিলেন ও বদমায়েশগুলিকে ধিক্কার দিয়ে বললেন, أَتَقْتُلُونَ رَجُلاً أَنْ يَقُولَ رَبِّىَ اللهُ؟ وَقَدْ جَاءَكُمْ بِالْبَيِّنَاتِ مِنْ رَبِّكُمْ ‘তোমরা কি এমন একজন মানুষকে হত্যা করছ, যিনি বলেন আমার প্রভু আল্লাহ।
অথচ তিনি তোমাদের প্রতিপালকের নিকট থেকে সুস্পষ্ট প্রমাণাদি সহ তোমাদের কাছে আগমন করেছেন ? এ সময় তারা রাসূল (সঃ)-কে ছেড়ে আবুবকরকে বেদম প্রহার করে’ (বুখারী, হা/৬৩৭৮, ৪৮১৫)।
ওরওয়া বিন যুবায়ের বলেন, আমি আব্দুল্লাহ বিন আমর ইবনুল ‘আছ (রাঃ)-কে জিজ্ঞেস করলাম, মুশরিকরা রাসূল (সঃ)-এর সাথে সবচাইতে কষ্টদায়ক আচরণ কোনটি করেছিল, আমাকে বলুন। তখন তিনি ওক্ববা বিন আবু মু‘আইত্বের অত্র ঘটনাটি বর্ণনা করেন’ (বুখারী হা/৩৮৫৬)।
রাসূল (সঃ)-এর জীবনের অত্র ঘটনায় তার প্রিয় আবুবকরের উপরোক্ত বক্তব্য অন্যূন দু’হাযার বছর পূর্বে মূসা (আঃ)-কে হত্যার পরিকল্পনাকারীদের সম্মুখে তাঁর জনৈক গোপন ভক্ত যে কথা বলেছিলেন, তার কুরআনী বর্ণনার সাথে শব্দে শব্দে মিলে যায়। যেমন আল্লাহ বলেন,
وَقَالَ رَجُلٌ مُّؤْمِنٌ مِّنْ آلِ فِرْعَوْنَ يَكْتُمُ إِيْمَانَهُ أَتَقْتُلُوْنَ رَجُلاً أَنْ يَّقُوْلَ رَبِّيَ اللهُ وَقَدْ جَاءَكُمْ بِالْبَيِّنَاتِ مِنْ رَّبِّكُمْ- (مؤمن ২৮)-
ফেরাঊন গোত্রের জনৈক মুমিন ব্যক্তি, যে তার ঈমান গোপন রাখত, লোকদের বলল, তোমরা কি এমন একজন মানুষকে হত্যা করবে, যিনি বলেন, আমার পালনকর্তা আল্লাহ এবং তিনি তোমাদের প্রতিপালকের নিকট থেকে সুস্পষ্ট প্রমাণাদি সহ তোমাদের কাছে আগমন করেছেন ? (গাফের/মুমিন ৪০/২৮)।
আবুবকর (রাঃ)-এর উক্ত ঘটনা স্মরণ করে একদিন হযরত আলী (রাঃ) লোকদের বলেন, বল তো সবচেয়ে বড় বীর কে ?
তারা বলল, আপনি। তিনি বললেন, না। বরং আবুবকর।
আমি দেখেছি কুরায়েশরা রাসূলুল্লাহ (সঃ)-কে কাপড় ধরে টানাটানি করছে ও গালি দিয়ে বলছে, তুমি আমাদেরকে বহু উপাস্য ছেড়ে এক উপাস্য গ্রহণ করতে বলে থাক’।
সেই কঠিন সময়ে কেউ এগিয়ে যায়নি আবুবকর ছাড়া। তিনি একে ধরেন ওকে ঠেলেন, আর বলতে থাকেন, তোমাদের ধ্বংস হৌক। তোমরা কি এমন একজন মানুষকে হত্যা করবে যিনি বলেন,
আমার প্রতিপালক আল্লাহ ? অতঃপর আলী (রাঃ) কাঁদতে থাকেন। অতঃপর বলেন, আমি তোমাদেরকে আল্লাহর দোহাই দিয়ে বলছি, তোমরা বল ফেরাঊন কওমের ঈমান গোপনকারী মুমিন ব্যক্তি উত্তম না আবুবকর ?
লোকেরা চুপ থাকল। তখন তিনি বললেন, আল্লাহর কসম! ঐ সময়ের ঘটনায় আবুবকর উত্তম। কেননা ফেরাঊন কওমের মুমিন ঈমান গোপন করেছিল। কিন্তু আবুবকর তার ঈমান প্রকাশ্যে ঘোষণা করেছিলেন’।
[1]. বুখারী হা/৫২০; মুসলিম হা/১৭৯৪; মিশকাত হা/৫৮৪৭; ‘রাসূল (ছাঃ)-এর আবির্ভাব ও অহি-র সূচনা’ অনুচ্ছেদ।
[2]. মুসলিম হা/১৭৯৪; বুখারী ফৎহসহ হা/২৪০, ১/৪১৭ পৃঃ; মা শা-‘আ ৫০ পৃঃ।
[3]. বুখারী ফৎহসহ হা/৩৯৮১-এর আলোচনা দ্রষ্টব্য।
[4]. বুখারী ফৎহসহ হা/২৪০-এর আলোচনা দ্রষ্টব্য; আল-ইছাবাহ ক্রমিক ৬৮৩৩।
[5]. মুসনাদে বাযযার হা/৭৬১। ইবনু হাজার এটিকে বুখারী হা/৩৮৫৬-এর ‘সমর্থক’ (شاهد) হিসাবে এনেছেন। হায়ছামী বলেন, এর সনদে একজন রাবী আছেন, যাকে আমি চিনি না (মাজমা‘উয যাওয়ায়েদ হা/১৪৩৩৩)।
রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর উপর নানামুখী অত্যাচার
সম্মুখে ও পশ্চাতে নিন্দা করা ও অভিশাপ দেওয়াঃ এ ব্যাপারে অন্যতম প্রতিবেশী উমাইয়া বিন খালাফ অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন। তিনি পশ্চাতে সর্বদা নিন্দা করতেন।
তাছাড়া রাসূল (সঃ)-কে দেখলেই তাঁর সামনে গিয়ে যাচ্ছে-তাই বলে নিন্দা ও ভৎর্সনা করতেন এবং তাঁকে অভিশাপ দিতেন।
এ প্রসঙ্গেই নাযিল হয়, وَيْلٌ لِّكُلِّ هُمَزَةٍ لُّمَزَةٍ ‘দুর্ভোগ প্রত্যেক সম্মুখে নিন্দাকারী ও পশ্চাতে নিন্দাকারীর জন্য’ (হুমাযাহ ১০৪/১)।
[1]. ইবনু হিশাম ১/৩৫৬; কেউ অন্য নেতাদের নামও বলেছেন। সনদ ‘মুরসাল’ (তাফসীর কুরতুবী, তাহকীক উক্ত আয়াত)।
রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর উপর নানামুখী অত্যাচার রাসূল (সঃ)-এর মুখে থুথু নিক্ষেপ করা
(ক) উমাইয়া বিন খালাফের ভাই উবাই বিন খালাফ ছিল আরেক দুরাচার।
সে যখন শুনতে পেল যে, তার সাথী ওক্ববা বিন আবু মু‘আইত্ব রাসূল (সঃ)-এর কাছে বসে কিছু আল্লাহর বাণী শুনেছে, তখন ভীষণ ক্ষেপে গিয়ে ওক্ববাকে বাধ্য করল যাতে সে তৎক্ষণাৎ গিয়ে রাসূল (সঃ)-এর মুখে থুথু নিক্ষেপ করে আসে।
ওক্ববা তাই-ই করল’। এ প্রসঙ্গে নাযিল হয়, وَيَوْمَ يَعَضُّ الظَّالِمُ عَلَى يَدَيْهِ يَقُولُ يَا لَيْتَنِي اتَّخَذْتُ مَعَ الرَّسُولِ سَبِيلاً (27) يَا وَيْلَتَى لَيْتَنِي لَمْ أَتَّخِذْ فُلاَنًا خَلِيلاً (28) لَقَدْ أَضَلَّنِي عَنِ الذِّكْرِ بَعْدَ إِذْ جَاءَنِي وَكَانَ الشَّيْطَانُ لِلْإِنْسَانِ خَذُولاً- (الفرقان 27-29) ‘যালেম সেদিন নিজের দু’হাত কামড়ে বলবে, হায় !
যদি (দুনিয়াতে) রাসূলের পথ অবলম্বন করতাম’। ‘হায় দুর্ভোগ আমার !
যদি আমি অমুককে বন্ধুরূপে গ্রহণ না করতাম’। ‘আমার কাছে উপদেশ (কুরআন) আসার পর সে আমাকে পথভ্রষ্ট করেছিল। বস্ত্ততঃ শয়তান মানুষের জন্য পথভ্রষ্টকারী’ (ফুরক্বান ২৫/২৭-২৯)।
(খ) অনুরূপ এক ঘটনায় একদিন আবু লাহাবের পুত্র উতাইবা বিন আবু লাহাব এসে রাসূল (সঃ)-কে বলল, আমি সূরা নাজমের ১ ও ৮ আয়াত (وَالنَّجْمِ إِذَا هَوَى...ثُمَّ دَنَا فَتَدَلَّى) দু’টিকে অস্বীকার করি, বলেই সে হেঁচকা টানে রাসূল (সঃ)-এর গায়ের জামা ছিঁড়ে ফেলল এবং তাঁর মুখে থুথু নিক্ষেপ করল।
অথচ এই হতভাগা ছিল রাসূল (সঃ)-এর জামাতা। যে তার পিতার কথা মত রাসূল (সঃ)-এর কন্যা উম্মে কুলছূমকে তালাক দেয়। তার ভাই উৎবা একইভাবে রাসূল (ছসঃ)-এর অপর কন্যা রুক্বাইয়াকে তালাক দেয়।
পরে যার বিয়ে হযরত ওছমান (রাঃ)-এর সাথে হয়। তাঁর মৃত্যুর পরে উম্মে কুলছূমের সাথে ওছমান (রাঃ)-এর বিবাহ হয়। আল্লাহর রাসূল (সঃ) তখন তাকে বদ দো‘আ করে বললেন, اللهُمَّ سَلِّطْ عَلَيْهِ كَلْبًا مِنْ كِلاَبِكَ ‘হে আল্লাহ! তুমি এর উপরে তোমার কোন একটি কুকুরকে বিজয়ী করে দাও’।
[2] উক্ত ঘটনা সম্পর্কে কবি হাসসান বিন ছাবিত (রাঃ) কবিতা রচনা করেন। কিছুদিন পরে উতাইবা সিরিয়ায় ব্যবসায়িক সফরে গেলে সেখানে যারক্বা (الزرقاء) নামক স্থানে রাত্রি যাপন করে।
এমন সময় হঠাৎ একটা বাঘকে সে তাদের চারপাশে ঘুরতে দেখে ভয়ে বলে উঠে, هَذَا وَاللهِ آكِلِي كَمَا قَالَ مُحَمَّدٌ، قَاتِلِي ابْنُ أَبِي كَبْشَةَ وَهُوَ بِمَكَّةَ وَأَنَا بِالشَّامِ ‘আল্লাহর কসম! এ আমাকে খেয়ে ফেলবে। এভাবেই তো মুহাম্মাদ আমার বিরুদ্ধে বদ দো‘আ করেছিল।
সে আমাকে হত্যাকারী। অথচ সে মক্কায় আর আমি শামে’।
অতঃপর বাঘ এসে সবার মধ্য থেকে তাকে ধরে নিয়ে ঘাড় মটকে হত্যা করল’।
[1]. মুছান্নাফ আব্দুর রাযযাক হা/৯৭৩১; ইবনু হিশাম ১/৩৬১; তাহকীক ইবনু হিশাম ক্রমিক-৩৫২, আছার ছহীহ; আর-রাহীক্ব ৮৮ পৃঃ।
[2]. আর-রাহীক্ব পৃঃ ৯৮; হাকেম হা/৩৯৮৪, হাকেম ছহীহ বলেছেন, যাহাবী তা সমর্থন করেছেন।
[3]. কুরতুবী হা/৫৬৯০; আবু নু‘আইম ইছফাহানী, দালায়েলুন নবুঅত হা/৩৮১; মাজমা‘উয যাওয়ায়েদ হা/৯৮২০; কুরতুবীর মুহাক্কিক বলেন, হাদীছটি একদল তাবেঈ কর্তৃক ‘মুরসাল’ সূত্রে বর্ণিত।
তবে এগুলির সমষ্টি বর্ণনাটিকে শক্তিশালী করে’ (দ্রঃ কুরতুবী, তাফসীর সূরা নাজম ১ আয়াত)।
Read more: ইসলামিক হাদিস
ভূমিকা : লিখতে গিয়ে যদি ভূল হয়ে থাকে তাহলে ক্ষমা সুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন।
এবং কোন সাজেশন এর প্রয়োজন হলে আমাকে ইমেইল এর মধ্যেমে জানিয়ে দিবেন !
ভালো লাগলে দয়াকরে শেয়ার করবেন ।
সাথে থাকার জন্য ধন্যবাদ।
