কারবালার ইতিহাস - কারবালার কাহিনী - islamic history bangla book


islamic history bangla pdf, কারবালার কাহিনী বাংলা

কারবালার ইতিহাস

এই মর্মান্তিক ঘটনার সূত্রপাত যেখান থেকে শুরু হয়, তাহলো- বিশ বছর খলিফা হিসেবে রাষ্ট্র পরিচালনার পর হিজরির ৬০ সালে হজরত মুয়াবিয়া (রা.) ইন্তেকাল করেন।


Read more: সহীহ ঈমানের কষ্টিপাথর


মৃত্যুর পূর্বে বসরার শাসনকর্তা হযরত মুগিরার প্ররোচণায় মুয়াবিয়া তাঁর জেষ্ঠ্য পুত্র ইয়াজিদকে খলিফা হিসেবে মনোয়ন দিয়ে যান। এই নিয়োগ ইসলামের গণতান্ত্রিক নিয়মের পুরোপুরি বহির্ভূত ছিল।


ইয়াজিদ ছিলেন নিষ্ঠুর প্রকৃতির মানুষ

ইয়াজিদ ছিলেন নিষ্ঠুর প্রকৃতির, মদ্যপ, ধর্মে অবিশ্বাসী এক ব্যক্তি। যার কারণে তৎকালীন মুসলিম বিশ্বের অধিকাংশ মানুষ এটিকে ভালোভাবে মেনে নেয়নি।


পক্ষান্তরে মদিনা ও কুফার জনগণ ইমাম হোসাইন (রা.)কে খলিফা হিসেবে দেখতে চেয়েছে। এরই এক সময় কুফার লক্ষাধিক মানুষ ইমাম হোসাইন (রা.)কে পত্র প্রেরণ করেন।


এই পত্রে তারা দাবি জানান, সুন্নাহ পুনর্জীবিত এবং ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠা করতে অবিলম্বে তার দায়িত্ব গ্রহণ করা প্রয়োজন।


যদিও এ সময় হযরত ইমাম হোসাইন (রা.) ইয়াজিদের অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে ইরাক থেকে চলে গিয়ে মক্কা-মদিনায় অবস্থান করছিলেন।


মদিনায় অবস্থানরত সাহাবিগণ এবং ইমাম হোসাইনের আপনজনরা এ সময় ইমামকে কুফায় যেতে বারণ করেন।


ইয়াজিদের পক্ষ থেকে বাধা

কারণ তারা আশঙ্কা করছিলেন, ইয়াজিদের পক্ষ থেকে বাধা আসলে ইরাকবাসীরা ইমাম হোসাইনের পক্ষ ত্যাগ করবে।


কুফাবাসীর ডাকে সাড়া দিয়ে হযরত হোসাইন (রা.) তার চাচাতো ভাই মুসলিম ইবনে আকিলকে ইরাকের সার্বিক অবস্থা পর্যবেক্ষণের জন্য প্রেরণ করেন।


আর বলে দেন, যদি সে পরিস্থিতি অনুকূল দেখে এবং ইরাকবাসীদের অন্তরকে সুদৃঢ় ও সুসংহত পায় তাহলে যেন তাঁর কাছে দূত প্রেরণ করে।


মুসলিম ইবনে আকিল কুফায় আগমন করার সঙ্গে সঙ্গে ১৮ হাজার কুফাবাসী তার কাছে এসে ইমাম হোসাইনের পক্ষে বাইয়াত গ্রহণ করে এবং তারা শপথ করে বলে, অবশ্যই আমরা জানমাল দিয়ে ইমাম হোসাইনকে সাহায্য করব।


তখন মুসলিম ইবনে আকিল ইমাম হোসাইন (রা.)-এর কাছে পত্র পাঠিয়ে জানালেন যে, কুফার পরিস্থিতি সন্তোষজনক, তিনি যেন আগমন করেন।


এই সংবাদের ভিত্তিতে ইমাম হোসাইন (রা.) তার পরিবারের ১৯ জন সদস্যসহ প্রায় ৫০ জন সঙ্গী নিয়ে কুফার উদ্দেশে রওনা হন।


এই খবরে ইয়াজিদ উত্তেজিত হয়ে কুফার গভর্ণর নোমান ইবনে বশিরকে (রা.) পদচ্যুত করে ওবায়দুল্লাহ ইবনে জিয়াদকে কুফার দায়িত্ব প্রদান করেন।


ইমাম হোসাইন (রা.) যেন কোনোভাবেই কুফায় প্রবেশ করতে না পারে এই মর্মে নির্দেশও দেন ইয়াজিদ।


ওবায়দুল্লাহ বিন জিয়াদ কুফায় পৌঁছে সেখানকার জনগণকে কঠোর হস্তে দমন করে এবং মুসলিম বিন আকিলকে হত্যা করে।


এরপর ইমাম হোসাইনকে (রা.) প্রতিরোধ করতে চার হাজার সৈন্যের একটি বাহিনী প্রেরণ করে।

ইবনে জিয়াদের বাহিনী কারবালার প্রান্তরে অবরোধ করলে হোসাইন (রা.) বললেন, আমি তো যুদ্ধ করতে আসিনি। তোমরা আমাকে ডেকেছ বলে আমি এসেছি।


এখন তোমরা কুফাবাসীরাই তোমাদের বাইয়াত পরিত্যাগ করছ। তাহলে আমাদেরকে যেতে দাও, আমরা মদিনায় ফিরে যাই অথবা সীমান্তে কাফেরদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করি।


অন্যথায় ইয়াজিদের কাছে গিয়ে তার সঙ্গে বোঝাপড়া করি। কিন্তু হযরত হোসাইন (রা.)কে নিঃশর্ত আত্মসমর্পণ করতে আদেশ দেয় ইবনে জিয়াদ। ঘৃণা ভরে এ আদেশ প্রত্যাখ্যান করেন ইমাম হোসাইন (রা.)।


মহররমের ১০ তারিখ সকাল থেকে ইবনে জিয়াদের নেতৃত্বে প্রায় ৪ হাজার ইয়াজিদ বাহিনী হোসাইন (রা.)-এর ওপর আক্রমণ চালাতে থাকে এবং ফোরাত নদী থেকে পানি সংগ্রহের সব পথ বন্ধ করে দেয়। হজরত হোসাইন (রা.)-এর শিবিরে শুরু হয় পানির জন্য হাহাকার।


হোসাইন (রা.) সাথীদের নিয়ে বীরত্বের সঙ্গে যুদ্ধ করতে থাকেন। এই যুদ্ধে একমাত্র ছেলে হজরত জায়নুল আবেদিন (রহ.) ছাড়া পরিবারের শিশু, কিশোর ও মহিলাসহ সবাই একে একে শাহাদাতের বরণ করেন।


মৃত্যুর আগ মুহূর্ত পর্যন্ত ইমাম হোসাইন একাই লড়াই চালিয়ে যান। শেষ পর্যন্ত অত্যন্ত নির্মম ও নির্দয়ভাবে ইমাম হোসাইনকে শহীদ করা হয়। শিমার নামক এক পাপিষ্ঠ তার মস্তক দেহ থেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলে।


শাহাদাতের পর ইমাম হোসাইন (রা.)

শাহাদাতের পর ইমাম হোসাইন (রা.)-এর ছিন্ন মস্তক বর্শা ফলকে বিদ্ধ করে এবং তাঁর পরিবারের জীবিত সদস্যদেরকে দামেস্কে ইয়াজিদের কাছে প্রেরণ করা হয়। ইমামের খণ্ডিত মস্তক দেখে ইয়াজিদ ভীত ও শঙ্কিত হয়ে পরে।


ইয়াজিদের এই জয়লাভ বেশি দিন টিকে থাকেনি। মাত্র চার বছরের মধ্যে ইয়াজিদ মৃত্যুর স্বাদ গ্রহণ করে। এর কয়েকদিনের মধ্যে মৃত্যু হয় ইয়াজিদ পুত্রের।


কারবালার এই মর্মান্তিক হত্যায় জড়িত প্রতিটি ব্যক্তি কয়েক বছরের মধ্যেই মুখতার সাকাফির বাহিনীর হাতে নির্মমভাবে নিহত হয়। এরপর ইয়াজিদের বংশের কেউ শাসন ক্ষমতা লাভ করেনি।


ইমাম হোসাইন (রা.) আজও বেঁচে আছেন সত্য ও ন্যায়ের প্রতীক হিসেবে। তার ত্যাগ যুগের পর যুগ মুসলিম বিশ্ব শ্রদ্ধা ও ভক্তির সঙ্গে স্মরণ করবে।

মুসলিমদের রোম বিজয়

রাসুল (সা.) মদিনাতে হিজরতের পরে সেখানে ইসলামি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করেন। সে রাষ্ট্রের পরিচালনা হতো মহান আল্লাহর নিকট মনোনীত একমাত্র জীবনব্যবস্থা অনুযায়ী।


রাসুল (সা.)–এর সময় থেকেই সেই জীবনব্যবস্থা ও আদর্শের ধারক-বাহকগণ দাওয়াত ও যুদ্ধ-সংগ্রামের মাধ্যমে সেই আদর্শকে তাবৎ মানবতার কাছে পৌঁছে দেওয়া শুরু করেন।


মদিনার বাইরে নতুন নতুন অঞ্চলে; যেসব অঞ্চলের শাসকরা সেখানকার সাধারণ জনগণের ওপর ‘খোদা’ হয়ে বসেছিল।


তারা অত্যাচার-নির্যাতনে নাগরিকদের জীবন অতিষ্ঠ করে তুলতো, প্রাপ্য ও ন্যায্য অধিকার থেকে তাদের বঞ্চিত করতো।


রাসুল (সা.) ও তার উত্তরসূরি মহান খলিফাদের দাওয়াতে সপ্রণোদিত হয়ে দলে দলে লোক ইসলাম গ্রহণ করতেন।


কেউ কেউ আবার শান্তির আদর্শ ইসলাম গ্রহণ না করলেও ‘জিযয়া’ বা কর আদায় করতো। এভাবেই মুসলিমরা একের পর এক ক্ষমতাধর রাষ্ট্র বিজয়ের মাধ্যমে খিলাফত রাষ্ট্রকে নিয়ে যায় দূর থেকে বহু দূর।


তৎকালীন পৃথিবীর পরাশক্তি


ইসলামী রাষ্ট্রের গোড়াপত্তনের আগেই পৃথিবীর পরাশক্তি হিসেবে রোম সাম্রাজ্য (বাইজেন্টাইন) ও পারস্য সাম্রাজ্য (বর্তমান ইরান) আত্মপ্রকাশ করে।

রোমের সীমানা ছিল সিরিয়া থেকে পশ্চিমে স্পেন পর্যন্ত। আর পারস্যের সীমানা ছিল ইরাক থেকে পূর্বে খোরাসান (আফগানিস্তান) পর্যন্ত।


রোম আর পারস্য উভয়েই যুগের পর যুগ ধরে পরস্পর যুদ্ধে লিপ্ত থাকত। ৬০৩ খ্রিস্টাব্দের দিকে রোমানদের সঙ্গে পার্সিয়ানদের যুদ্ধ শুরু হয়।

পার্সিয়ানরা একের পর এক রোমান সাম্রাজ্যের বিভিন্ন অঞ্চল দখল করে নিচ্ছিল। রোমানরা ছিল খ্রিস্টান, অন্যদিকে পার্সিয়ানরা ছিল অগ্নিপূজক। এক পর্যায়ে যুদ্ধটা ধর্মীয় যুদ্ধে রূপ নেয়।


৬১৫ খ্রিস্টাব্দে পার্সিয়ানরা দামেশক, বায়তুল মাকদিস পর্যন্ত দখল করে নেয়। পার্সিয়ান সম্রাট খসরু পারভেজ হেরাক্লিয়াসের নিকট যে পত্রটি লিখেছিল, তাতে স্পষ্টই বোঝা যায় যুদ্ধটা ধর্মীয় যুদ্ধে রূপ নিয়েছিল।


মুসলিমরা যখন রোমানদের পক্ষে

সেসময় মক্কায় রাসুল (সা.) এর সঙ্গে মুশরিকদের নতুন এক ধরনের যুদ্ধ চলছিল।

রোমানদের পরাজয়ের খবর শুনে মক্কার মুশরিকরা খুশী হয়েছিল, কারণ পার্সিয়ানরাও তাদের মতো পৌত্তলিক।


অন্যদিকে মুসলিমদের সঙ্গে রোমানদের অনেক মিল, উভয়েই নবী, আসমানি গ্রন্থ ও আখেরাত ইত্যাদিতে বিশ্বাসী। তাই রোমানদের এই বিজয়ে মুসলিমরা দুঃখিত হয়েছিল।


মুশরিকরা এই নিয়ে মুসলিমদের সঙ্গে ঠাট্টা করতে শুরু করে। তখন আল্লাহ কোরআন নাজিল করলেন, ‘রোমকরা পরাজিত হয়েছে।’ (সুরা রুম, আয়াত: ২)


পরবর্তী আয়াতে রোমানদের বিজয়ের ভবিষ্যদ্বাণী করা হয়েছে। ভবিষ্যদ্বাণীটি এমন সময় করা হয়, যখন রোমান সাম্রাজ্যের আর উঠে দাঁড়ানোর কোনো শক্তি নেই।


আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘নিকটবর্তী এলাকায় এবং তারা তাদের পরাজয়ের পর অতি শিগগির বিজয়ী হবে, কয়েক বছরের মধ্যে। অগ্র-পশ্চাতের কাজ আল্লাহর হাতেই। সেদিন মুমিনরা আনন্দিত হবে।’ (সুরা রুম, আয়াত: ৩-৪)


ভবিষ্যদ্বাণীর বাস্তবায়ন

এ প্রসঙ্গে কোরআনে অনেকগুলো ভবিষ্যদ্বাণী করা হয়। এর একটি হলো রোমানরা কয়েক বছরের মধ্যে বিজয় লাভ করবে।


কোরআনের এই বাণী সত্য হয়েছিল। রোমানরা পার্সিয়ানদের থেকে জেরুজালেম এবং তৎসংলগ্ন অঞ্চল হেরাক্লিয়াসের নেতৃত্বে দখল করে।


৬২৪ সালে তারা ইরানীদের সবচেয়ে বড় অগ্নিকুণ্ড ভেঙে ফেলে। (অর্থাৎ ৯ বছরের মধ্যেই রোমানরা পার্সিয়ানদের উপর চূড়ান্তভাবে বিজয় লাভ করে।)


আরেকটি ভবিষ্যদ্বাণীটি হল, ওই সময় মুমিনরা আনন্দ করবে। আগে ও পরের ঘটনা ও আয়াত গুলোতে এটা প্রকাশ্যই ধরা পড়ে, রোমানদের বিজয়ে মুমিনরা খুশী হবে।


কিন্তু, যেই সময় রোমানরা পার্সিয়ান দের বিরুদ্ধে বিজয় লাভ করে, ঠিক একই বছর মক্কার মুশরিকদের বিরুদ্ধে মুসলিমরা বদরের যুদ্ধে মুখোমুখি হয়ে বিজয় লাভ করে।


পবিত্র কোরআনে বলা হয়েছে, ‘সেদিন মুমিনগণ আনন্দিত হবে। আল্লাহর সাহায্যে। তিনি যাকে ইচ্ছা সাহায্য করেন এবং তিনি পরাক্রমশালী, পরম দয়ালু।’ (সুরা রুম, আয়াত: ৩-৪)


কোরআনের এই ভবিষ্যদ্বাণী সত্য হওয়ার পর, মক্কার অনেক মুশরিক ইসলাম গ্রহণ করে। আল হামদুলিল্লাহ।


বস্তুত আল্লাহ্‌ নিঃসন্দেহে অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যত সম্পর্কে অবগত। আল্লাহ্‌ দৃশ্যমান ও অদৃশ্যমান সব কিছুই জানেন।


রোমানদের সঙ্গে মুসলমানদের যুদ্ধ

পরবর্তীতে রাসুল (সা.)-এর সময় থকেই রোমের সঙ্গে সদ্য প্রতিষ্ঠিত ইসলামী রাষ্ট্রের যুদ্ধ শুরু হয়।

একবার রাসুল (সা.) হারেস ইবনে ওমায়র আজদি (রা.)-কে এক চিঠি দিয়ে বসরার গভর্নরের কাছে দূত হিসেবে পাঠান।


তখন রোমের কায়সারের নিযুক্ত ‘বালাকা’ এলাকার গভর্নর শোরাহবিল ইবনে আমর গাসসানি সেই দূত হারেস ইবনে ওমায়র আজদি (রা.)-কে হত্যা করে।


দূতকে হত্যা করা তৎকালীন সময়ে যুদ্ধ ঘোষণার শামিল ছিল। তাই মুসলমানদের ৩ হাজার সেনাবাহিনী নিয়ে রোমানদের ২ লাখ সেনাবাহিনীর ওপর আক্রমণ করেন।


এটিই ইসলামের ইতিহাসে মুতারযুদ্ধ হিসেবে প্রসিদ্ধ। খালিদ বিন ওয়ালিদ (রা.) -এর বুদ্ধিমত্তায় সে যুদ্ধে মুসলিমরা জয় লাভ করেন।


পরে মুতার যুদ্ধ ও তাবুকের অভিযানের পরে রাসুল (সা.) সবশেষে ওসামা (রা.)-কে সেনাপতি নিযুক্ত করে রোমদের বিরুদ্ধে সর্বশেষ বাহিনী পাঠান।

হযরত আবু বকর (রা.)-এর খিলাফত কালে তিনি সে বাহিনীর নেতৃত্ব অপরিবর্তন রেখেই সামনে অগ্রসর হতে বলেন।


রাসুল (সা.)–এর ওফাতের পরে যখন ইরাকে বিভিন্ন গোত্র বিদ্রোহ করে বসে, আবু বকর (রা.) তখন মুছান্না (রা.)-কে দিয়ে সুকৌশলে সেই বিদ্রোহ দূর করে ইরাকেই মুসলিমদের এক বিশাল বাহিনী গড়ে তোলেন, যারা ইরাকের মুসলিমদের বিদ্রোহ থেকে শান্তির পথে একীভূত করে ইরানের দিকে এগিয়ে যান।

রোম বিজয়ের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস

এদিকে খালিদ (রা.)-কে মদিনা থেকে ইরাকের দিকে অভিযানে পাঠানোর পরপরই খলিফা আবু বকর (রা.) সেনাপতিদের পতাকা দিয়ে দায়িত্বপ্রাপ্ত নিজ নিজ এলাকায় পাঠিয়ে দেন।


তিনি খালিদ ইবনে সাইদ (রা.)-কে ‘তায়মার’ দিকে এখানে ওমর (রা.) খালিদ ইবনে সাইদকে সিরিয়াতে পাঠাতে খলীফাকে নিষেধ করেন, কারণ সে রেশমের জুব্বা পরার ব্যাপারে হযরত ওমর (রা.) এর সঙ্গে তর্ক করেছিল; অথচ ইসলামে পুরুষদের জন্য রেশমের কাপড় নিষিদ্ধ।


ইয়াজিদ ইবনে আবু সুফিয়ান (রা.) কে ‘দামেশকে’র দিকে, আবু উবায়দা ইবনুল জাররাহ (রা.) কে হিমসের (আলেপ্পো) দিকে এবং আমর ইবনুল আস (রা.) কে ফিলিস্তিনের দিকে দায়িত্ব দিয়ে পাঠান।


পথে আবু উবায়দা (রা.) সে বালাকা অঞ্চলের জনগনের সঙ্গে সন্ধির মাধ্যমে ‘বালাকা’ জয় করেন। সিরিয়ায় এটাই প্রথম সন্ধি চুক্তি।


ইয়ারমুকের যুদ্ধ

মুসলিমরা যখন সিরিয়ার দিকে আগমন করেন, তখন রোমান সম্রাট হিরাক্লিয়াস ভয় পেয়ে যায়।

কারণ সে জানত রাসুল (সা.) শেষ নবী আর তাদের খ্রিস্টান ধর্মের সময় শেষ হয়ে গেছে। আল্লাহ তাআলা নতুন ও মনোনীত শেষ ধর্ম ইসলামের আবির্ভাব ঘটিয়েছেন।


হিরাক্লিয়াস তখন হিমসে অবস্থান করছিল। আবু বকর (রা.)-এর মোট সৈন্য সংখ্যা ছিল ২১ হাজার ও তাদের সাহায্যার্থে ছিল ইকরিমা ইবনে আবু জাহেল (রা.)-এর ৬ হাজার সৈন্য।


মুসলিমদের সিরিয়া বিজয়

হিরাক্লিয়াসের সম্মুখ বাহিনীর দায়িত্বে ছিল জুরজা। যিনি পরে ইসলামে দীক্ষিত হওয়ার পরপরই ইয়ারমুকের জিহাদে শহিদ হন।


হিরাক্লিইয়াসের ২ লাখ সৈন্যের বিরুদ্ধে মুজাহিদদের সংখ্যা কম হওয়ায় তারা খলিফা আবু বকর (রা.) এর কাছে সাহায্য চাইলে তিনি খালিদ বিন ওয়ালিদ (রা.)-কে ইরাক থেকে সিরিয়া যেতে নির্দেশ দেন।


খালিদ (রা.) পাঁচ দিন পর তার নয় হাজার মুজাহিদ নিয়ে ইয়ারমুকের যুদ্ধে মূল সেনাপতির দায়িত্বে এসে নিযুক্ত হন। খালিদ (রা.) সেখানে যেয়ে দেখেন মুজাহিদগণ রোমানদের সঙ্গে জিহাদে লিপ্ত।


অন্যদিকে তার আগমনের সংবাদ শুনে রোমানরা মুসলিমদের সঙ্গে সন্ধি করার আগ্রহ প্রকাশ করে। আর সিরিয়াই ছিল রোমান সাম্রাজ্যে মুসলমানদের প্রথম জয়কৃত এলাকা।


ইতিহাসে বর্ণিত হয়েছে, যখন ইয়ারমুকের যুদ্ধে দুই বাহিনী প্রচণ্ড লড়াই করছিল, তখন আরব থেকে এক পত্র বাহক এসে খালিদ বিন ওয়ালিদের (রা.) কাছে খলীফার একটি চিঠি দেন।


পত্র বাহক খালিদ (রা.)-কে একান্তে নিয়ে গিয়ে বলেন, খলিফা আবু বকর ইন্তেকাল করেছেন, ওমর (রা.) পরবর্তী খলিফা নিযুক্ত হয়েছেন। ওমর (রা.) আপনার স্থলে মূল সেনাপতির দায়িত্ব দিয়েছেন আবু উবায়দা আমির ইবনে জাররাহ (রা.)-কে।


কিন্তু খালিদ (রা.) এই সংবাদ যুদ্ধ শেষ না হওয়া পর্যন্ত গোপন রাখেন, যেন যুদ্ধরত সাহাবি ও সৈন্যদের মনোবল ভেঙে না যায়।

আজনাদায়নের যুদ্ধ

তৎকালীন ‘মা’ওয়ারের আরবা’ অঞ্চলে আমর ইবনে আস (রা.) এর সঙ্গে রোমানরা যুদ্ধে লিপ্ত ছিল, সেখানে তার সাহায্যার্থে খালিদ (রা.), আবু উবায়দা (রা.), শুরাহবিল (রা.) ও মুরছাদ (রা.) মুসলিম সৈন্যদের নিয়ে হাজির হলে আজনাদায়নের যুদ্ধ শুরু হয়।


এযুদ্ধে রোমানরা ছিল ২ লাখ ৪০ হাজার। আর মুসলিম মুজাহিদরা ছিলেন মাত্র ৪০ হাজার। অবশেষে মুসলিম যোদ্ধারাই কাফিরদের পরাজিত করেন। কাফিরদের সেনাপতি কায়কালান নিহত হয়।


মুসলিমদের পারস্য বিজয়

পারস্য সম্রাট মহানবী (সা.)-এর প্রেরিত চিঠি ছিঁড়ে টুকরা টুকরা করে ফেলেছিল। এ ঘটনা শুনে মহানবী (সা.) মুসলমানদের হাতে পারস্য বিজয়ের ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন, তাঁর ওফাতের অল্প দিনের মাথায় এ ভবিষ্যদ্বাণী সত্য প্রমাণিত হয়।


হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এর জীবিত থাকা অবস্থায়ই পারস্য সাম্রাজ্যের অধীন ইয়েমেনের শাসনকর্তা বাজান ও তাঁর লোকজন ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করে, ফলে ইয়েমেন মদিনাভিত্তিক রাষ্ট্রের আওতায় চলে আসার মাধ্যমে পারস্য বিজয়ের সূচনা হয়।


রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর সময়ে পারস্য সাম্রাজ্যের প্রভাবিত এলাকা বাহরাইনের শাসনকর্তা ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করায় বাহরাইনও মদিনাভিত্তিক রাষ্ট্রের অধীনে চলে আসে।


নবী করিম (সা.)-এর ইন্তেকালের অল্পকাল পরে আবু বকর সিদ্দিক (রা.)-এর খিলাফতের সময় বাহরাইনের মুসলিম শাসনকর্তার মৃত্যু হলে ওই প্রদেশে বিশৃঙ্খলার সৃষ্টি হয়।


সেখানকার বনু আবুল কায়েস নামে একটি গোত্র ইসলাম ধর্মের অনুসারী ছিল, আর বনু বকর গোত্রটি ইসলামবিরোধী ছিল, পরস্পরবিরোধী মতাদর্শের এ দুটি গোত্রের মধ্যে যুদ্ধ লেগে যায়।


বনু আবুল কায়েসের গোত্র খলিফা হযরত হযরত আবু বকর (রা.)-এর কাছে সাহায্য চাইল, হযরত আর আবু বকর গোত্র পারস্য সম্রাটের কাছে সাহায্য চাইলে তারা তাদের সাহায্যে এগিয়ে আসে।


হযরত আবু বকর ও পারস্যের এ সম্মিলিত বাহিনী মুসলমানদের সঙ্গে যুদ্ধে হেরে যায়, ফলে বাহরাইনের শাসনক্ষমতা মদিনাভিত্তিক রাষ্ট্রের হাতেই অটুট থেকে যায়।


যুদ্ধে পরাজিত হয়ে পারস্য বাহিনী মদিনাভিত্তিক রাষ্ট্রের সীমান্তে বিভিন্ন অমুসলিম গোত্রের মধ্যে মুসলমানদের বিরুদ্ধে উসকানিমূলক তৎপরতা শুরু করে।


রাষ্ট্রের নিরাপত্তার স্বার্থে পারস্য সীমান্তে বিদ্রোহের আশঙ্কা দূর করতে খলিফা হযরত আবু বকর (রা.) সেনাপতি মুসান্নার নেতৃত্বে আট হাজার সৈন্যের একটি বাহিনী সংশ্লিষ্ট পারস্য সীমান্তে প্রেরণ করেন।

মুসান্না ও খালিদের যৌথ বাহিনী উবান্ন্নার ৫০ মাইল দক্ষিণে হাফির নামক স্থানে পারস্যের বিশাল বাহিনীর সঙ্গে যুদ্ধে লিপ্ত হয়।


যুদ্ধে পরাজিত হয়ে পারস্য বাহিনী পালাতে থাকে, মুসলিম বাহিনী তাদের ইউফ্রেটিস নদীর পূর্ব তীরে মেসোপটেমিয়া পর্যন্ত পশ্চাদ্ধাবন করে।


এ অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে পারস্য সম্রাট খালিদ ও মুসান্নার নেতৃত্বাধীন মুসলিম বাহিনীর বিরুদ্ধে সেনাপতি বাহমানের নেতৃত্বে একটি নতুন বাহিনী প্রেরণ করেন।


ওয়ালাজা নামক স্থানে এ বাহিনী মুসলিম বাহিনীর কাছে শোচনীয়ভাবে পরাজিত হয়, এরপর সেনাপতি খালিদ অন্য একটি পারসিক বাহিনীকে উলিসের যুদ্ধে পরাজিত করে হীরা অধিকার করেন।


হীরা বিজয়ের পর সেনাপতি খালিদ উত্তর দিকে অগ্রসর হয়ে আনবার নামক স্থানটি অধিকার করেন, এরপর আনবার থেকে কিছু দূরে অবস্থিত আইনুত তামুর ও দুমা স্থান দুটিও দখল করেন।

হীরাসহ উপরোক্ত এলাকা মুসলমানদের অধিকারে চলে আসার পর খলিফা আবু বকর (রা.)-এর নির্দেশে মহাবীর খালিদ ইরাক থেকে সিরিয়ায় চলে যান।


এ সময় হীরা উদ্ধারের জন্য পারস্য সম্রাট বিখ্যাত সেনাপতি রুস্তমের নেতৃত্বে এক বিরাট সেনাবাহিনী প্রেরণ করেন, এ সময় মদিনাভিত্তিক রাষ্ট্রের প্রথম খলিফা আবু বকর (রা.) ইন্তেকাল করেন।


এখানে উল্লেখ্য যে হযরত আবু বকর (রা.) মৃত্যুর আগে মাত্র দুই বছর তিন মাস খলিফার দায়িত্ব পালন করেন।

হযরত ওমর (রা.) মদিনাভিত্তিক রাষ্ট্রের দ্বিতীয় খলিফা হয়ে আবু ওবায়দার নেতৃত্বে একটি সেনাবাহিনী মুসান্নার সঙ্গে ইরাকে প্রেরণ করেন।


আবু ওবায়দা ও মুসান্না সেনাবাহিনীসহ ইউফ্রেটিস অতিক্রম করে হীরা অভিমুখে অগ্রসর হতে থাকলে পারস্য সেনাবাহিনীর সেনাধ্যক্ষ রুস্তম দুটি স্বতন্ত্র বাহিনী গঠন করেন।


একটি বাহিনীর সেনাপতি ছিলেন জাবান, তাঁর নেতৃত্বে পারস্য বাহিনী হীরা অভিমুখে অগ্রসর হয়ে নামারক নামক স্থানে মুসলিম বাহিনীর সঙ্গে যুদ্ধে লিপ্ত হয়, এ যুদ্ধে পারস্য বাহিনী পরাজিত হয়। ফলে ‘হীরা’ মুসলমানদের অধীনে থাকে।


এরপর কুফার কয়েক মাইল দূরে বুয়ায়েরের যুদ্ধে মুসলিম বাহিনীর বিজয়ের ফলে পারস্য সাম্রাজ্যের ইরাক অংশের মেসোপটেমিয়ার নিম্নাঞ্চলও টুকরা হয়ে মুসলমানদের অধীনে চলে আসে।


বুয়ায়েরের যুদ্ধের পর পারস্যের তৎকালীন সম্রাট ইয়াজদিজার্দ পারস্য সাম্রাজ্যের ইরাকস্থ যে এলাকা মদিনাভিত্তিক রাষ্ট্রের দখলে চলে যায়, তা উদ্ধারের জন্য মহাবীর রুস্তমের তত্ত্বাবধানে এক লাখ ২০ হাজার সৈন্যের এক বিশাল বাহিনী গঠন করেন।


খলিফা হযরত ওমর (রা.) পারস্যের এ সমর প্রস্তুতির খবর জানতে পেরে সাদকে সেনাপতি নিযুক্ত করে ৩০ হাজার সৈন্যসহ পারস্য অভিমুখে প্রেরণ করেন।

সেনাপতি সাদ তাঁর সেনাবাহিনী নিয়ে ইরাকের কুফার অদূরে কাদেসিয়া প্রান্তরে পারস্যের বিশাল সেনাবাহিনীর মোকাবেলা করেন।


পারস্য বাহিনী এ যুদ্ধে শোচনীয়ভাবে পরাজিত হয়। পারস্য বাহিনীর প্রধান সেনাপতি রুস্তম যুদ্ধের ময়দান থেকে পলায়ন করতে গিয়ে নিহত হন।

এ যুদ্ধ পারস্য সাম্রাজ্যের ভিত্তি দুর্বল করে দেয়, এ যুদ্ধে মুসলিম বাহিনীর আট হাজার ৫০০ সৈন্য ও পারস্য বাহিনীর ৩৪ হাজার সৈন্য নিহত হয়।


কাদেসিয়ার যুদ্ধে বিজয়ের পর মুসলিম বাহিনী ব্যাবিলনের দিকে অগ্রসর হয়, ব্যাবিলনের দখল পেতে তাদের তেমন একটা বেগ পেতে হয়নি।

খলিফা ওমর (রা.)-এর অনুমতিক্রমে এরপর সেনাপতি সাদ সেনাবাহিনী নিয়ে পারস্য সাম্রাজ্যের রাজধানী মাদায়েন অভিমুখে যাত্রা করেন, মাদায়েন শব্দের অর্থ দুই শহর।


দজলা-ফোরাত নদীর মিলনস্থল থেকে ১৫ মাইল উজানে দজলার উভয় পারের ভূখণ্ডব্যাপী এ নগর অবস্থিত।

সেনাপতি সাদ সেনাবাহিনী নিয়ে প্রথমে রাজধানী মাদায়েন নগরীর পশ্চিমাংশের দিকে অগ্রসর হন, পারস্য বাহিনী পথিমধ্যে মুসলিম বাহিনীকে বাধা দিয়ে পরাজিত হয়।


মাদায়েন নগরীর পশ্চিমাংশ দখল করার পর সাদ বাহিনীসহ নদী অতিক্রম করে নগরীর পূর্বাংশে চলে আসেন, মুসলিম বাহিনীর আগমনের আগেই পারস্য সম্রাট সদলবলে উত্তরাঞ্চলের পার্বত্য এলাকা হুলওয়ানে চলে যান।


ফলে পারস্য সাম্রাজ্যের রাজধানী মাদায়েন এক প্রকার বিনা বাধায়ই মুসলমানরা ৬৩৭ খ্রিস্টাব্দে জয় করে।

হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এর ‘শিগগিরই পারস্যের রাজধানী ইসলামের অন্তর্ভুক্ত হবে’ ভবিষ্যদ্বাণী বাস্তবে পরিণত হওয়ায় মুসলিম বাহিনী ‘আল্লাহু আকবার’ ধ্বনিতে আকাশ-বাতাস প্রকম্পিত করে তোলে এবং সেই স্থানে শোকরানা নামাজ পড়ে।


এ অভিযানে দজলা-ফোরাতের মধ্যবর্তী সমগ্র এলাকায় মুসলমানদের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়।

মুসলিম বাহিনীর সামরিক অভিযান প্রতিহত করার জন্য পারস্য সম্রাট সর্বাত্মক প্রচেষ্টা নিয়ে এক লাখ ৫০ হাজার সৈন্যের এক বিশাল বাহিনী গঠন করেন।


সেনাপতি নোমানের নেতৃত্বে মুসলিম বাহিনীর ৩০ হাজার সৈন্য ইরাকের হামদানের কাছে নিহাওয়ান্দ নামক স্থানে পারস্যের এ বিশাল বাহিনীকে মোকাবেলা করে।


মুসলিম বাহিনীর সৈন্যরা বীরবিক্রমে যুদ্ধ করে পারস্য বাহিনীকে শোচনীয়ভাবে পরাজিত করে, যুদ্ধক্ষেত্রেই পারস্য বাহিনীর ৩০ হাজার সৈন্য মারা যায়। এরপর পারস্য সম্রাট আত্মরক্ষার জন্য স্থান হতে স্থানান্তরে পলায়ন করতে থাকেন।


কাদেসিয়ার যুদ্ধে যেখানে পারস্য সাম্রাজ্যের ভিত দুর্বল করে দিয়েছিল, নিহাওয়ান্দের যুদ্ধে সেখানে শেষ আঘাত হানে, এ যুদ্ধের পর মাত্র দুই থেকে তিন বছরের মধ্যে পারস্য সাম্রাজ্যের অবশিষ্ট এলাকা টুকরা টুকরা হয়ে যায়।


যেমন—কিরমান, মাকরান, সিস্তান, খোরাসান, আজারবাইজান প্রভৃতি অঞ্চল একে একে মুসলমানদের অধীনে চলে আসে, এভাবে মুসলমানদের পারস্য বিজয় সম্পর্কে মুহাম্মদ (সা.)-এর ভবিষ্যদ্বাণী পূর্ণ হয়।

মুসলিমদের স্পেন বিজয়

খোলাফায়ে রাশেদীনের দ্বিতীয় খলিফা হযরত উমরের শাসনকাল থেকে শুরু হওয়া মুসলমানদের জয়রথ উমাইয়া আমলে এসে আরো বিকশিত হয়ে পড়ে।

সাম্রাজ্যবাদী উমাইয়া শাসকরা একে একে আরব ভূখণ্ড পেরিয়ে ইসলামকে নিয়ে গেলেন এশিয়া, আফ্রিকা এবং ইউরোপেও।


উত্তর আফ্রিকায় সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠার সময় এই অঞ্চল পেরিয়ে মুসলমানদের দৃষ্টি গেল আন্দালুসিয়ায়, বর্তমান স্পেনে। স্পেনের রাজনৈতিক অবস্থা ছিল তখন শোচনীয়।


রাজা ও সামন্তের দ্বন্দ্বের সুযোগ কাজে লাগায় মুসলিমরা। মুসলিম সেনাপতি তারেক বিন জিয়াদের নেতৃত্বে স্পেন বিজিত হয় অষ্টম শতকের প্রথম ভাগে, পঞ্চদশ শতক পর্যন্ত স্পেনে বাতিঘর হয়ে জ্বলেছিল মুসলিম এই সাম্রাজ্য।


প্রাক কথন

উমাইয়া খলিফা প্রথম ওয়ালিদ ৬৯৮ সালে তার সুযোগ্য সেনাপতি মুসা বিন নুসাইরকে ইফরিকিয়ার গভর্ণর পদে পদায়ন করেন।


বর্তমান লিবিয়া,আলজেরিয়া অঞ্চলকে বলা হত ইফরিকিয়া। উত্তর আফ্রিকায় মুসলিম শাসন বলবৎ করা ছিল তার দায়িত্ব, আর এ কাজের জন্য তিনি নিজের সামরিক সক্ষমতা বৃদ্ধি করেন।

গড়ে তুলেন সুদক্ষ নৌবাহিনী, উত্তর আফ্রিকা নিয়ে ব্যস্ত থাকা মুসার কানে হঠাৎ স্পেন ও পর্তুগাল তথা হিস্পানিয়া অঞ্চলের এক সামন্ত কিছু সংবাদ দিয়ে যান।


সেই সামন্তের ভাষ্যমতে, হিস্পানিয়া প্রাকৃতিক সম্পদে ভরপুর একটা দেশ,সেখানকার রাজা রডারিক একজন দুর্বল প্রকৃতির মানুষ, সৈন্যরা তার আদেশ মান্য করে না, রাজনৈতিক বিশৃঙ্খলা সেখানে নিত্যসঙ্গী।


কাউন্ট জুলিয়ান নামের রাজা রডারিকের এই সামন্ত অবশ্য শত্রুতার বশেই মুসা বিন নুসায়েরের কান ভারী করেছিলেন।


কথিত আছে, রাজ রেওয়াজ অনুযায়ী কাউন্ট জুলিয়ান তার কন্যার পড়াশোনার জন্য রাজা রডারিকের দরবারে পাঠালে রাজা তার শ্লীলতাহানি করেন। এই ঘটনায় ক্ষুব্ধ পিতা কাউন্ট জুলিয়ান প্রতিশোধের চেষ্টা চালান।


তিনি নিজে সামান্য সামন্ত হওয়ায় প্রতিশোধ গ্রহণ করতে পারবেন না ভেবে তিনি মুসলিমদের সাহায্য চান এবং জুলিয়ান মুসার কাছে এও প্রস্তাব দেন যে, তিনি গোপনে মুসলমানদের জিব্রাল্টার প্রণালী পার হবার ব্যবস্থা করে দেবেন। মুসা তার সুযোগ্য সেনাপতি তারেক বিন জিয়াদকে স্পেন আক্রমণের দায়িত্ব অর্পণ করেন।


স্পেন অভিযান ও বিজয়

যে তারিক বিন জিয়াদকে মুসা স্পেন অভিযানের জন্য নির্বাচিত করেন তিনি একসময় মুসার দাস ছিলেন, তার কর্মদক্ষতায় মুগ্ধ হয়ে তিনি তাকে মুক্ত করে এক পর্যায়ে সেনাপতি পদে আনয়ন করেন।


যাইহোক, তারিক বিন জিয়াদকে চারটি যুদ্ধজাহাজ, ৪০০ পদাতিক সৈন্য এবং কিছু বার্বার সৈনিক দিয়ে ৭১০ সালে মুসা স্পেনে প্রেরণ করেন। এই বাহিনী প্রেরণের উদ্দেশ্য ছিল, স্পেনের রাজনৈতিক এবং প্রতিরক্ষার সালতামামি পর্যবেক্ষণ করা।


ক্ষুদ্র এই বাহিনীটি সার্বিক দিক পর্যবেক্ষণ করে অভিযানের অনূকূল পরিবেশ বজায় আছে বলে মত দেয়, ফলে মুসা বিন নুসায়ের সংকল্পবদ্ধ হোন স্পেনে একটি বিশেষায়িত বাহিনী পাঠানোর জন্য।


অবশেষে সাত হাজার বার্বার সৈন্য এবং ৩০০ আরব সৈন্যের একটি বাহিনী চূড়ান্ত অভিযানে নামে হিস্পানিয়ার শাসক কিং রডারিকের বিরুদ্ধে, অভিযানের মাঝপথে মুসা বিন নুসাইর আরো ৫ হাজার সৈন্য প্রেরণ করলে মোট ১২ হাজার সৈন্য নিয়ে তারিক বিন জিয়াদ অগ্রসর হোন।


প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী কাউন্ট জুলিয়ানের জাহাজে করে তারিকের বাহিনী জিব্রাল্টার পার হয়ে স্পেনের পার্বত্য অঞ্চলে অবতরণ করে, তারিক যেখানে অবতরণ করেন সেই জায়গার নাম দেয়া হয় জাবাল আত তারিখ বা তারিকের পাহাড়।


যাইহোক অপেক্ষমাণ গথিক রাজা রডারিকের বাহিনীর সাথে এবার চূড়ান্ত যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হয় মুসলিম বাহিনী।


৭১১ সালের ১৯ জুলাই সংঘটিত হয় ঐতিহাসিক ওয়াদী লাস্কের যুদ্ধ। মুসলিম বাহিনীর স্বল্প সংখ্যক সৈন্য থাকা সত্ত্বেও তারা স্পেনিয়ার্ড বাহিনীর সাথে বাঘের মত যুদ্ধ করে।


অপরপক্ষে রডারিকের অপেশাদার সৈন্যরা নিজ শহরের বাইরে এসে যুদ্ধ করতে কিছুটা বিরক্ত বোধ করছিল, মনোবলহীন এই বাহিনী মুসলিম বাহিনীর কাছে বাজেভাবে পরাজিত হয়।


কর্ডোভা ও টলোডা মুসলিমদের হাতে পদানত হয়। কিছুদিন পর মুসা নিজে উত্তর পশ্চিমাঞ্চলের খ্রিস্টান শহরগুলোতে অভিযান প্রেরণ করেন, মুসা ও তারিকের সম্মিলিত এই শক্তি দুই বছরের মধ্যে পুরো স্পেনে মুসলিম সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয়।


ইউরোপে মুসলমানদের আগমনের এই ঐতিহাসিক ধারার উপর ভিত্তি করে ধীরে ধীরে ইউরোপের আনাচে কানাচে ইসলামের বিস্তার হতে থাকে, স্পেনে মুসলিমদের এই বিজয় এবং তার পতন আজো মুসলিম ইতিহাসে গৌরবময় এবং স্মৃতিময় একটি অধ্যায়।

কনস্টান্টিনোপল বিজয়

৩৩০ খ্রিস্টাব্দে রোমান সম্রাট কনস্টান্টিন বসফরাস প্রণালীর উপকূলে প্রতিষ্ঠা করেন কনস্টান্টিনোপল শহর, ৩৯৫ সালে রোমান সাম্রাজ্য দু’ভাগ হলে পূর্ব রোমান সাম্রাজ্যের নাম হয় বাইজেন্টাইন সাম্রাজ্য, যার রাজধানী হয় কনস্টান্টিনোপল।


পশ্চিমে রোমের পতন হলেও পূর্বে রোমান সাম্রাজ্যের ধারক হিসেবে বাইজেন্টাইন সাম্রাজ্যের পতাকাতলে টিকে ছিল কনস্টান্টিনোপল।


কনস্টান্টিনোপল অনেকবার শত্রুদের আক্রমণের শিকার হলেও এগারো শতাব্দীর ইতিহাসে মাত্র একবারই এ শহর জয় করা সম্ভব হয়েছিল, ১২০৪ সালের চতুর্থ ক্রুসেডে।


প্রায় ত্রিকোণাকার এ শহরের উত্তরে বসফরাস প্রণালীর অংশ গোল্ডেন হর্ন, পূর্বে বসফরাস প্রণালীর মূল অংশ এবং দক্ষিণে মারমারা সাগর।


এছাড়াও রয়েছে শহরকে ঘিরে রাখা অসংখ্য নগর প্রতিরক্ষা দেয়াল, এগুলোর মধ্যে রয়েছে থিওডেসিয়ান দেয়াল, যা প্রায় অজেয় এক নগর প্রতিরক্ষা দেয়াল।


ফলে প্রাকৃতিকভাবেই নিরাপত্তা পেয়ে যেত কনস্টান্টিনোপল। মুসলিমরাও বেশ কয়েকবার চেষ্টা করেছে এ শহর বিজয়ের, শুরুটা হয়েছিল বেশ আগেই, ইয়াজিদের হাত ধরে।


কিন্তু তার আক্রমণ থেমে গিয়েছিল শহরের প্রাচীরের কাছেই, উসমানীয় সুলতান বায়োজিদও চেষ্টা করেছিলেন এ শহর দখলের, কিন্তু ব্যর্থ হয়েছিলেন তিনিও।


এতো ব্যর্থতার পরেও উসমানীয় (অটোমান) সুলতান দ্বিতীয় মুহাম্মদ (তুর্কী ভাষায় মেহমেদ) সিদ্ধান্ত নেন কনস্টান্টিনোপল দখলের।


১৪৫১ সালে মাত্র ১৯ বছরে সিংহাসনে বসা সুলতানকে শুরুতে তার দেশের লোকেরাই খুব একটা পাত্তা দেয়নি, সেখানে আশেপাশের অন্য সাম্রাজ্যরা তাকে কোনো হুমকি হিসেবেই গণ্য করেনি। তাকে অবহেলা করার কারণও আছে। এর আগেও একবার সিংহাসনে বসেছিলেন তিনি।


মাত্র বারো বছর বয়সে তার বাবা তাকে সিংহাসন ছেড়ে দিয়েছিলেন। কিন্তু বহিঃশত্রুর আক্রমণের কারণে তিনি তার বাবাকে নির্দেশ দেন সিংহাসন ফিরিয়ে নিতে। এ কারণে অনেকেই তাকে দুর্বল ভাবত।


এ অবহেলার সুযোগটাই নেন সুলতান মুহাম্মদ। এছাড়াও সে সময় থেকে ইউরোপের রাজনৈতিক পরিস্থিতিও তাকে এ সিদ্ধান্ত নিতে উৎসাহ দিয়েছিল।


ইউরোপের দুই পরাশক্তি ফ্রান্স আর ইংল্যান্ড নিজেদের মধ্যে যুদ্ধে লিপ্ত ছিল প্রায় একশ বছরেরও বেশি। এ যুদ্ধ ইতিহাসে ‘একশ বছরের যুদ্ধ’ নামে পরিচিত।


এছাড়াও সে সময়ের অন্যান্য পরাশক্তি স্পেন, জার্মানি, পোল্যান্ড, হাঙ্গেরি নিজেদের বিভিন্ন যুদ্ধে জড়িত ছিল, এসব যুদ্ধের কারণে ইউরোপের সেনাবাহিনী বেশ দুর্বল হয়ে পড়েছিল, এর সুযোগ নিতে চেয়েছিলেন দ্বিতীয় মুহাম্মদ।


এক সময়ের প্রতাপশালী বাইজেন্টাইন সাম্রাজ্যও তার জৌলুশ হারিয়ে ফেলেছিল সে সময়ে । ল্যাটিন, সার্বিয়া, বুলগেরিয়ার কাছে রাজ্যের অনেক জায়গাই হাতছাড়া হয় বাইজেন্টাইন সাম্রাজ্যের।


তবে সবচেয়ে বেশি ক্ষতি করেছিল উসমানীয় সাম্রাজ্যই প্রায় সবদিক থেকে ঘিরে ফেলেছিল কনস্টান্টিনোপলকে।


চতুর্দশ শতকের প্লেগে শহরের প্রায় অর্ধেক মানুষ মারা যায়। ফলে অর্থনৈতিক এবং সামরিক উভয় দিক থেকেই দুর্বল হতে থাকে বাইজেন্টাইন সাম্রাজ্য ।


সুলতান দ্বিতীয় হযরত  মুহাম্মদ যখন সিংহাসনে বসেন তখন বাইজেন্টাইন সাম্রাজ্য বলতে টিকে ছিল শুধুমাত্র কনস্টান্টিনোপল শহর, মারমারা সাগরে প্রিন্স আইল্যান্ড এবং পেলোপন্সে।


সুলতান মুহাম্মদ তাড়াহুড়ো করে যুদ্ধে জড়িয়ে পড়েননি । তিনি প্রতিটি পদক্ষেপ নিয়েছিলেন অল্প অল্প করে।


এর মধ্যে ছিল ১৪৫২ সালে সুলতান মুহাম্মদ বসফরাসের পশ্চিম দিকে একটি দুর্গ নির্মাণের নির্দেশ দেয়া, এর আগে তার প্রপিতামহ প্রথম বায়োজিদ বসফরাসে একটি দুর্গ নির্মাণ করেছিলেন।


তবে বায়োজিদের দুর্গ ছিল এশিয়ায় আর মুহাম্মদের দুর্গ ছিল ইউরোপে, দুর্গ দু’টি উসমানীয় সাম্রাজ্যকে বসফরাস প্রণালীর সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ এনে দেয়।


কারণ এই দুই দুর্গ এড়িয়ে বসফরাস প্রণালী পার করা সম্ভব ছিল না, ফলে সরাসরি যুদ্ধে জড়ানোর আগেই বাইজেন্টাইন সাম্রাজ্যের অর্থনীতিতে আঘাত হানেন সুলতান।


সে বছরের অক্টোবরেই সুলতান তুরাখান বেগকে পেলোপন্সে বিশাল সেনাবাহিনী নিয়ে যাবার নির্দেশ দেন, যাতে পেলোপন্সে কনস্টান্টিনোপল শহরে কোনো সাহায্য পাঠাতে না পারে।


সেসময় বাইজেন্টাইন সাম্রাজ্যের সিংহাসনে ছিলেন একাদশ কন্সটানটিন, তিনি সহজেই মুহাম্মদের চাল বুঝতে পারেন।


ক্রমেই ছোট হয়ে আসা বাইজেন্টাইন সাম্রাজ্যের কফিনে শেষ পেরেক পড়ার ভয়ে সম্রাট সাহায্য চান পশ্চিমে ইউরোপের দেশগুলোর কাছে।


কিন্তু কয়েক শতাব্দী ধরে চলে আসা শত্রুতা এবং পূর্বের অর্থোডক্স চার্চ ও পশ্চিমের ক্যাথোলিক চার্চের দ্বন্দ্ব বাঁধা হয়ে দাঁড়ায় ঐক্যবদ্ধ সাহায্য পাবার পথে।


শেষ পর্যন্ত কোনো উপায় না পেয়ে পূর্ব অর্থোডক্স চার্চ রাজি হয় পশ্চিমের ক্যাথোলিক চার্চের সাথে একতাবদ্ধ হবার ব্যাপারে। পোপের কাছে প্রস্তাবও পাঠায় এ ব্যাপারে।


বাইজেন্টাইন সাম্রাজ্য ভেবেছিল ইউরোপের অন্যান্য দেশের উপরে পোপের ভালো নিয়ন্ত্রণ রয়েছে। কিন্তু তাদের ধারণা ছিল ভুল।


নিজেদের মধ্যে যুদ্ধ করে দুর্বল হয়ে যাওয়া দেশগুলো বাইরের কোনো দেশের জন্য যুদ্ধ করতে সহজে রাজি হয়নি, শেষে পোপ পুরো ব্যাপারটিকে ধর্মযুদ্ধের মতো করে দেখানোয় মুসলিমদের থামাতে একতাবদ্ধ হয় খ্রিস্টান সেনাবাহিনী।


ইউরোপের বিভিন্ন জায়গা থেকে কিছু সাহায্য পেতে থাকে বাইজেন্টাইন সাম্রাজ্য, তবে একেবারেই নগন্য। অনেকে নিজ উদ্যোগে ২০০-৪০০ জনের বাহিনী নিয়ে যোগ দেয় কন্সটান্টিপোল রক্ষার জন্য।


এদের মধ্যে ছিলেন জেনোয়া থেকে আসা জিওভানি জিউসটিনিয়ানি নগর রক্ষা দেয়াল প্রতিরক্ষার ব্যাপারে তিনি বেশ অভিজ্ঞ ছিলেন। ১৪৫৩ সালের জানুয়ারিতে তিনি শহরে পৌঁছানোর পরেই দেয়াল প্রতিরক্ষার মূল সেনাপতি হিসেবে নিয়োগ পান।


ভেনিস আনুষ্ঠানিকভাবে কন্সটান্টিনকে সাহায্য করার ব্যাপারে কোন সিদ্ধান্ত না নিলেও গোল্ডেন হর্নে অবস্থান করা ভেনিসিয়ান নাবিকরা শহর রক্ষার জন্য সম্রাটের পক্ষে অবস্থান নেয়। মার্চের শেষের দিকে পোপের নির্দেশে তিনটি জাহাজ যাত্রা করে কন্সটান্টিনোপল রক্ষার জন্য।


ভেনিস শেষ পর্যন্ত কন্সটান্টিনোপলকে সাহায্যের সিদ্ধান্ত নেয় । ভেনিস ফেব্রুয়ারিতে নৌবাহিনী পাঠাতে চাইলেও বিভিন্ন কারণে দেরি হওয়াতে নৌবাহিনীর যাত্রা শুরু হয় এপ্রিলে।


নৌ আক্রমণ প্রতিরোধের জন্য সম্রাট কন্সটান্টিন পোতাশ্রয়ের মুখে কাঠের গুড়ি দিয়ে প্রতিরক্ষা চেইন নির্মাণ করেন। স্থলপথে ওসমানীয় বাহিনীকে আটকানোর জন্য দেয়াল মেরামতের কাজও শুরু করা হয়।


ওসমানীয়দের সেনাবাহিনী ছিল অনেক বড়, প্রায় পঁচাত্তর হাজার থেকে এক লক্ষের মতো সেনাসদস্য ছিলো তাদের।
অন্যদিকে বাইজেন্টাইনদের সেনাবাহিনী ছিল অনেক ছোট, মাত্র আট হাজার জনের মতো।


বাইজেন্টাইনদের সবচেয়ে বড় সুবিধা ছিল তাদের প্রায় অজেয় প্রতিরক্ষা দেয়াল। তবে দুশ্চিন্তার কারণও ছিল তাদের, কেননা অরবান নামক এক প্রকৌশলীর তৈরি করা এক বিশাল কামান।


মজার ব্যাপার হলো, ধর্মযুদ্ধের রূপ নেয়া এ যুদ্ধে এই কামানের বেশ বড় ভূমিকা ছিল, যা তৈরি করেছিল এক খ্রিস্টান ধর্মাবলম্বী। এই কামান কন্সটান্টিনোপলের দেয়ালের জন্য ছিল এক বড় হুমকি।


মারমারা সাগরে ওসমানীয়দের বিশাল নৌবাহিনীও প্রস্তুত ছিল জলপথে আক্রমণের জন্য। বসফরাস প্রণালীর উপকূলে দু’টি দুর্গ বাইজেন্টাইনদের নৌপথে চলাচল সীমিত করে দিয়েছিল।


১৪৫৩ সালের ১ এপ্রিল থেকে ওসমানীয় সেনাবাহিনী কন্সটান্টিনোপলের চারিদিকে অবস্থান নেয়া শুরু করে।

চারদিন পর ৫ এপ্রিল সুলতান দ্বিতীয় মুহাম্মদ যোগ দেন সেনাবাহিনীর সাথে এবং ঠিক পরের দিন অর্থাৎ ৬ এপ্রিল শুরু হয় কন্সটান্টিপোল দখলের যুদ্ধ।


শুরুতেই শহরের বাইরে থাকা বাইজেন্টাইন সাম্রাজ্যের শক্তিশালী চৌকিগুলো দখল করে নেয় ওসমানীয় বাহিনী।


এরপরই ওসমানীয় বাহিনী নগর থিওডেসিয়ান দেয়ালে কামানের গোলা বর্ষণ শুরু করে। কিন্তু কামানের দু’টি গোলা নিক্ষেপের মধ্যবর্তী সময় ছিল তিন ঘন্টার মতো।


ফলে একবার গোলা বর্ষণে যে ক্ষতি হতো, বাইজেন্টাইনরা সহজেই সেই ক্ষতি মেরামত করে ফেলতো। ফলে ওসমানীয় সাম্রাজ্য বলার মতো কোনো সাফল্যের মুখ দেখেনি প্রথম কয়েকদিনে।


অন্যদিকে জলপথে সুলাইমান বাল্টোঘলুর নেতৃত্বাধীন ওসমানীয় সাম্রাজ্যের নৌবাহিনী ছিল বিপর্যস্ত। গোল্ডেন হর্নে দেয়া চেইনের কারণে তারা বেশিদূর এগোতে পারেনি।


সবচেয়ে লজ্জাজনক ছিল যখন ২০ এপ্রিল বাইজেন্টাইন সাম্রাজকে সাহায্য করার জন্য আসা চারটি জাহাজ প্রায় একশটি ওসমানীয় জাহাজকে বোকা বানিয়ে লক্ষ্যস্থলে পৌঁছে যায়।


কিন্তু নৌবাহিনীকে গোল্ডেন হর্নে পৌঁছানোর ব্যাপারে দৃঢ় প্রতিজ্ঞ সুলতান মুহাম্মদ নির্দেশ দেন জাহাজের তলদেশে কাঠের গুড়ি লাগিয়ে স্থলপথে ঘুরিয়ে গোল্ডেন হর্নে নিয়ে যাবার। অমানবিক পরিশ্রমের পর ওসমানীয় নৌবাহিনী চেইনের পেছনের জলপথে পৌঁছায়।


২৮ এপ্রিল সম্রাট কন্সটান্টিন এই নৌবাহিনীকে আক্রমণের জন্য নৌবাহিনী পাঠান। কিন্তু আগে থেকেই খবর পেয়ে যাওয়ায় ওসমানীয় নৌবাহিনী ছিল প্রস্তুত।


ফলে সহজেই বাইজেন্টাইন নৌবাহিনীকে পরাজিত করে গোল্ডেন হর্নে। ফলে গোল্ডেন হর্নের দিকে দেয়াল রক্ষার জন্য সম্রাট কন্সটান্টিনকে নতুন করে লোক নিয়োগ দিতে হয়।


অন্যদিকে থিওডেসিয়ান দেয়ালে কামানের গোলা বর্ষণে কোন কাজ না হওয়ায় সুলতান নতুন পদক্ষেপ নেন। জাগানোস পাশা এবং সার্বিয়ান সৈন্যদের নেতৃত্বে সুড়ঙ্গ তৈরি করা শুরু হয়।


উদ্দেশ্য ছিল সুড়ঙ্গ দিয়ে সেনা নিয়ে দেয়াল না ভেঙেই মূল শহরে আক্রমণ করা। ওসমানীয়দের নতুন কৌশল ধরতে পেরে বাইজেন্টাইন প্রকৌশলী জোহানসন গ্রান্ট পাল্টা আক্রমণ করেন।


১৮ মে গ্রান্টের নেতৃত্বে প্রথম সুড়ঙ্গ দখল করে বাইজেন্টাইনরা। এরপর ২১ এবং ২৩ মে আরো দু’টি সুড়ঙ্গের পাশাপাশি দুইজন ওসমানীয় অফিসারকে গ্রেপ্তার করতে সক্ষম হয় ।


তারা অত্যাচার করে তাদের কাছ থেকে অন্যান্য সুড়ঙ্গের অবস্থান জেনে সবগুলো ধ্বংস করে দেয় ২৫ মে। ফলে ওসমানীয়দের এই পরিকল্পনাও নস্যাৎ হয়ে যায়।


দীর্ঘদিন ধরে কোনো সফলতা না পাওয়ায় ওসমানীয় বাহিনী একদিকে মানসিকভাবে ভেঙে পড়ছিল, অন্যদিকে গ্রান্টের সাফল্য পাবার পরেও বাইজেন্টাইনরাও মানসিকভাবে ভেঙে পড়ছিল। ভেনিস থেকে সাহায্য আসা সম্ভব না ততোদিনে বুঝে গিয়েছিল তারা।


এছাড়াও ২৬ মে ঘন কুয়াশা শহরের অনেকের মনে বিভিন্ন কুসংস্কারের জন্ম দেয়। শহরের অনেকেই ধরে নেয় হাজিয়া সোফিয়া থেকে পবিত্র আত্মার চলে যাওয়া লুকাতেই এই কুয়াশা হয়েছিল।


অন্যদিকে ক্লান্ত, বিধ্বস্ত সুলতান মুহাম্মদ ২৬ মে রাতে তার সেনাপতিদের সাথে আলোচনায় বসেন।

সিদ্ধান্ত হয় ২৮ মে রাতে বিশ্রাম এবং নামাজের পর বড় একটি আক্রমণ চালানো হবে। ২৮ মে মাঝরাতের পর পর ওসমানীয় বাহিনী আক্রমণ শুরু করে।


প্রথমদিকে কিছু সাফল্য পাবার পর ওসমানীয়দের এলিট ফোর্স জ্যানিসারিরা যোগ দেয় আক্রমণে। কিন্তু জিওভানি জিউসটিনিয়ানির নেতৃত্বে তাদের আটকে রাখে বাইজেন্টাইন সেনারা।


ওসমানীয় বাহিনীর আক্রমণে জিউসটিনিয়ানি আহত হলে তার শুশ্রুষার জন্য তাকে শহরের ভেতরে নিয়ে যাওয়া হয়। এরপরই প্রতিরক্ষা দুর্বল হতে থাকে বাইজেন্টাইনদের।


ওসমানীয়রা বাইজেন্টাইনদের প্রতিরক্ষা ভেদ করে ধীরে ধীরে ভেতরে প্রবেশ শুরু করে। দক্ষিণ দিকে সম্রাট কন্সটান্টিন নিজেই দেয়াল প্রতিরক্ষায় নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন।


কিন্তু উত্তর দিকের একটি প্রবেশদ্বার ওসমানীয়রা খুলে ফেলায় তিনি চাপে পড়ে পিছিয়ে যেতে থাকেন। একই সময়ে ওসমানীয়রা আরো কিছু প্রবেশদ্বার খুলে দলে দলে শহরে ঢুকে পড়তে থাকে।


সম্রাট কন্সটান্টিনের ভাগ্যে শেষ পর্যন্ত কি হয়েছিল তা জানা না গেলেও, ধারণা করা হয় ওসমানীয় বাহিনীকে শেষবারের মতো আটকে দেবার প্রচেষ্টায় মারা যান তিনি।


বাইজেন্টাইনদের প্রায় চার হাজার সেনা মারা যায়, অন্যদিকে ওসমানীয়দের হতাহতের সংখ্যা জানা যায়নি।

দীর্ঘদিন অজেয় থাকা কন্সটান্টিনোপল শহর ১৪৫৩ সালের ২৯ মে দখল করে নেয় ওসমানীয় সাম্রাজ্য।


আসল রোমের পতন ঘটলেও রোমান সাম্রাজ্যের জৌলুশের ছায়া হয়ে থাকা বাইজেন্টাইন সাম্রাজ্যেরও পতন ঘটে সেদিন।

হাজার বছর ধরে চলে আসা রোমান সাম্রাজ্যের পতনের সাক্ষী হয়ে থাকে ওসমানীয় বাহিনীর এ বিজয়।


মুসলিমদের কাছে যা কন্সটান্টিনোপল বিজয়, খ্রিস্টানদের কাছে তা ছিল কন্সটান্টিনোপলের পতন।

সেসময় পোপ ওসমানীয়দের বিরুদ্ধে ধর্মযুদ্ধের ডাক দিয়ে কন্সটান্টিনোপল ফিরে পাবার আহ্বান জানান।


কিন্তু ইউরোপের কেউই কোনো আগ্রহ দেখায়নি কন্সটান্টিপোল ফিরে পাওয়ার ব্যাপারে। সুলতান দ্বিতীয় মুহাম্মদ ওসমানীয় সাম্রাজ্যের রাজধানী প্রতিষ্ঠা করেন কন্সটান্টিনোপলে।


প্রাচীন এ শহরকে কেন্দ্র করেই ওসমানীয় সাম্রাজ্য পরবর্তীতে বিস্তৃত করে তাদের সাম্রাজ্য। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে পরাজয়ের মাধ্যমে পতন ঘটে এই ওসমানীয় সাম্রাজ্যের।


ওসমানীয়দের এই বিজয় ইউরোপের ইতিহাসে এক গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা হিসেবে চিহ্নিত করা হয়ে থাকে। এশিয়ার সাথে সরাসরি বাণিজ্যের পথ হারায় ইউরোপিয়ানরা।


ফলে তারা পূর্ব দিক দিয়ে ভারত কিংবা চীনে যাবার রাস্তা খুঁজতে থাকে। সেগুলো আবার জন্ম দেয় নতুন সব অভিযানের।


মাত্র একুশ বছর বয়সে প্রায় অজেয় এক শহর দখল করে সুলতান দ্বিতীয় মুহাম্মদ উপাধি পান ‘মুহাম্মদ আল-ফাতিহ’ বা ‘বিজয়ী’। এই বিজয়ী সুলতানকে নিয়ে নবী হযরত  মুহাম্মদ (সা) অনেক আগেই ভবিষ্যৎবাণী করে গিয়েছিলেন,

তোমরা (মুসলিমরা) অবশ্যই কন্সটান্টিনোপল বিজয় করবে। 


কতোই না অপূর্ব হবে সেই বিজয়ী সেনাপতি, কতোই না অপূর্ব হবে তার সেনাবাহিনী”। (আহমাদ আল-মুসনাদ ১৪:১৩১)


Read more: অগোছালো অবস্থায় আমল শুরু

ভূমিকা : লিখতে গিয়ে যদি ভূল হয়ে থাকে তাহলে ক্ষমা সুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন।
এবং কোন সাজেশন এর প্রয়োজন হলে আমাকে ইমেইল এর মধ্যেমে জানিয়ে দিবেন !
ভালো লাগলে দয়াকরে শেয়ার করবেন ।
সাথে থাকার জন্য ধন্যবাদ।

Please Do,not Share Any Spam Links

Post a Comment (0)
Previous Post Next Post