উহুদ যুদ্ধের কাহিনী - সাহাবীদের জীবনী - Islamic History Bangla Site

 উহুদ যুদ্ধের ইতিহাস

উহুদের যুদ্ধ,উহুদ যুদ্ধের ঘটনা,ওহুদের যুদ্ধের ঘটনা,উহুদের যুদ্ধের ইতিহাস,উহুদ যুদ্ধের ইতিহাস,ওহুদের যুদ্ধের ওয়াজ,উহুদের পাহাড়,ওহুদ পাহাড়,উহুদ পাহাড়,উহুদের ময়দান যেখানে নবীজির দান্দান মোবারক শহীদ হয়েছিল,উহুদের যুদ্ধের ইতিহাস। মুসলমানদের চরম শিক্ষা,ওহুদের ময়দানে রক্ত ঝরালে,ওহুদের যুদ্ধের আসল ইতিহাস,কোন যুদ্ধে নবীজির দাঁত মোবারক শহীদ হয়,নবীজির দাঁত মোবারক,নবীজির চেহারা,উহুদের বেদনাদায়ক কাহিনী,নবীজির চেহারা মোবারক,ইসলামের বিজয়,ইসলামিক ছবি,image,photo,

উহুদের যুদ্ধ ও মুতার যুদ্ধ কাহিনী

তিন হাজার সশস্ত্র কুরাইশ সেনাদের দল তাদের নেতা আবু সুফিয়ানের নেতৃত্বে যুদ্ধংদেহী মনোভাবে মদিনার দিকে আগাচ্ছে। ৭০০ বর্মধারী এবং ২০০ অশ্বারোহীর এ সামরিক বাহিনী পূর্বের যেকোন সময়ের চেয়ে বেশি শক্তিশালী, সংঘবদ্ধ। 


আরও পড়ুন: বদর 


বালুকাময় মরুভূমিতে কুরাইশদের এ যুদ্ধদলে দেখা দিয়েছে অভাবনীয় রোমাঞ্চ৷ কারন এবার তাদের সাথে যুদ্ধে যোগ দিয়েছে মক্কার নারীরাও। আর আরবের সামরিক ইতিহাস বলছে যুদ্ধে নারীদের অংশগ্রহণ যুদ্ধজয়ের সম্ভাবনা দ্বিগুণ বাড়িয়ে দেয়। 


আরও পড়ুন অগোছালো অবস্থায় আমল শুরু


যুদ্ধযাত্রার পেরিয়েছে নয়দিন। আর একদিন পরই তারা পৌছে যাবে যুদ্ধক্ষেত্রে৷ আবু সুফিয়ান শেষবারের মত তাদের উদ্দেশ্যে বক্তৃতা দিচ্ছে, যেভাবেই হোক এবার মুসলিমদের কাবু করে আসতেই হবে। নয় মক্কার মান সম্মান বলে অবশিষ্ট আর কিছু থাকবে না। 


আরও পড়ুন: হযরত আয়শা (রাঃ) জীবনী


ওহুদের যুদ্ধ ইসলামের সামরিক ইতিহাসে মুসলিমদের জন্য যতটা না পরাজয়মূলক একটা হতাশার যুদ্ধ ঠিক ততটাই ছিল শিক্ষামূলক এক নাটকীয় পরীক্ষা। ইতিপূর্বে নাজুক শক্তি দিয়ে বদরের যুদ্ধে কুরাইশদের পরাজিত করে বেশ ফুরফুরে মেজাজেই ছিল মদিনার মুসলিমরা। 


কিন্তু সহসাই সেই উদ্বেলতায় ছেদ পড়ে মুসলিমদের৷ প্রথমদিকে জয়ের পথে থেকেও শেষার্ধে এসে যে দায়িত্বে অবহেলার পরিচয় দিয়েছিল মুসলিম বাহিনী সেই অবহেলার মাশুল দিতে হয়েছিল ওহুদের যুদ্ধে পরাজিত হওয়ার মাধ্যমে।


এই যুদ্ধের ভুল অবশ্য পরবর্তীতে কাজে দিয়েছিল। আর সেজন্যেই ওহুদের যুদ্ধ ইসলামের ইতিহাসে এক গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় হিসেবে বিবেচিত হয়ে আসছে। 


কেন সংঘটিত হয়েছিল ওহুদের যুদ্ধ ?


 বদরের যুদ্ধে কুরাইশ বাহিনী শোচনীয় পরাজয় বরণ করে। আবু জাহেল ও উতবার মত পরাক্রমশালী আরব যোদ্ধার মৃত্যুতে যারপরনাই ফুঁসে উঠেছিল মক্কার কুরাইশরা। স্বাভাবিকভাবেই এ পরাজয়ের বদলা নিতে তারা আরেকটি যুদ্ধের উত্থান ঘটাতে প্রয়াসী হয়।


প্রতিশোধ গ্রহণের এ আকাংখা মক্কার যুবকদের বিদ্রোহী করে তোলে৷ কুরাইশ নেতা আবু সুফিয়ান তার দলবল নিয়ে বাড়ি বাড়ি গিয়ে জনসংযোগ করতে থাকে। নতুন যুদ্ধের জন্য মক্কাবাসীকে উস্কাতে থাকে।


তার এ আহ্বানে সাড়া দিয়ে নারীরা পর্যন্ত যুদ্ধে যাওয়ার ঘোষণা দেয়। বদরের যুদ্ধের প্রতিশোধ না নেয়ার পর্যন্ত মক্কার পুরুষগণ তেল ও নারী স্পর্শ করবে না বলে সাফ জানিয়ে দেয়৷


বদরের যুদ্ধের পরাজয়ের গ্লানি তাদের এতটাই পেয়ে বসেছিল যে একটি যুদ্ধ আয়োজন না করে যেন তারা শান্তি পাচ্ছিল না। 

বদরের যুদ্ধের অব্যবহিত পর মদিনায় ইসলামের গুরুত্ব বাড়তে থাকে।


পাশাপাশি মদিনা নগরীর শান শওকাতও একই পাল্লায় বৃদ্ধি পায়৷ আর মদিনায় বানু হাশেম গোত্রের ধারাবাহিক উন্নতিতে মক্কার উমাইয়ারা ক্রোধান্বিত হয়। মদিনা নগরী এবং মদিনার নাগরিকদের ওপর সমানভাবে বীতশ্রদ্ধ মক্কার কুরাইশরা মদিনাকে ধূলোর সাথে মিশিয়ে দেয়ার শপথ গ্রহণ করে। 


মক্কায় নির্যাতনের শিকার

মক্কায় ধারাবাহিক নিপীড়ন নির্যাতনের শিকার হয়ে হযরত মুহাম্মদ (স) যখন তার অনুসারীদের নিয়ে মদিনায় একটি রাষ্ট্রের গোড়াপত্তন করেন তখন থেকেই তার ক্ষমতা এবং প্রভাব বাড়তে থাকে। 


চিরশত্রু মুহাম্মদের এমন প্রতিপত্তি কিছুতেই সহ্য হচ্ছিল না মক্কাবাসীর। আর তার এই প্রভাব চিরতরে খর্ব করে দিতে তারা ঐক্যবদ্ধ হয়। 


আমর জাহমী ও মুসাফ নামের দুই কুরাইশ কবি তাদের কবিতার মাধ্যমে তাদের গোত্রে যথেষ্ট তেজ সঞ্চার করে দেয়। আরবদের যুদ্ধে অংশ নিতে ব্যাপকভাবে উদ্বুদ্ধ করত তাদের হৃদয়স্পর্শী কবিতা। 


কুরাইশদের বীরত্ব এবং মুসলিমদের সম্ভাব্য পরাজয় নিয়ে তারা পৃথক কবিতা রচনা করে। তাদের জ্বালাময়ী কাব্য কুরাইশদের নতুন করে যুদ্ধে জড়াতে ব্যাপকভাবে উদ্দীপনা সৃষ্টি করে। মক্কার নারীরাও এ যুদ্ধে অনেকাংশে ভূমিকা পালন করে।


বদর যুদ্ধে নিহত যোদ্ধাদের স্ত্রী, কন্যা ও অন্যান্য নারী আত্মীয়রা ওহুদের যুদ্ধে অংশ নিতে সম্মতি প্রকাশ করে। আর আরবের যেকোন যুদ্ধে নারীদের উপস্থিতি থাকলে যোদ্ধারা জীবনবাজি রেখে যুদ্ধ করার চেষ্টা করত। 


ইহুদিদের কুমন্ত্রণাও এ যুদ্ধ সংঘটিত করতে ভূমিকা পালন করেছিল। মদিনার ইহুদিরা কুরাইশদের উদ্বুদ্ধ করার জন্য নানামুখী কার্যক্রম পরিচালনা করতে থাকে। ইহুদি কবি কাব বিভিন্ন সময়ে কবিতা ও রম্যরচনার মাধ্যমে কুরাইশদের উস্কানি দিতে থাকে। 


 ওহুদ পাহাড়ের অবস্থান


পাঁচ কিলোমিটার দীর্ঘ ওহুদ পাহাড় মদিনা শহরের উত্তরে অবস্থিত৷ শহর এবং এ পাহাড়ের মাঝ বরাবর একটি অর্ধবৃত্তাকার বক্র স্থান ছিল৷


এটা খুব প্রশস্ত হওয়ার কারনে এখানে অনায়াসে সহস্র মানুষের স্থান সংকুলান হয়ে যেত৷ পাহাড়ের আরো গভীরে এমন আরেকটি প্রশস্ত খোলা জায়গা ছিল এবং একটি সংকীর্ণ পথ দ্বারা এ দুটি জায়গা যুক্ত ছিল। 


ওহুদ পাহাড়ের দক্ষিণাংশ দিয়ে প্রবাহিত হওয়া ওয়াদি কানাত এর দক্ষিণে রয়েছে আইনায়েন নামের আরেকটি ছোট পাহাড়। এই আইনায়েন পাহাড়েই হযরত মুহাম্মদ (স) তার তীরন্দাজ বাহিনীকে পাহারায় রেখেছিলেন। 


 মুখোমুখি কুরাইশ- মুসলিম বাহিনী


৭০০ বর্মধারী এবং ২০০ অশ্বারোহী সমেত তিন হাজার সশস্ত্র কুরাইশ বাহিনী ২১ মার্চ ৬২৫ সালে যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হয়ে ওহুদ পাহাড়ের পাদদেশে তাদের যুদ্ধশিবির স্থাপন করে।


এ খবর তৎক্ষনাৎ মদিনায় পৌছে যায়৷ কুরাইশদের আগমনের খবর পেয়ে জরুরি বৈঠক আহ্বান করেন হযরত মুহাম্মদ (সঃ)। তিনি শহরের ভেতর থেকে শত্রুদের আক্রমণ প্রতিহত করতে মত দেন।


কিন্তু মদিনার অতি উৎসাহী তরুণ যোদ্ধারা শহরের বাইরে গিয়ে প্রতি আক্রমনের ইচ্ছা পোষণ করেন। অন্যান্য সাহাবীরাও তাদের প্রতি সমর্থন ব্যক্ত করেন। হযরত মুহাম্মাদ (স) এ পরিকল্পনা পছন্দ করেননি তবুও সংখ্যাগরিষ্ঠের মতের কারনে সিদ্ধান্ত নেয়া হয় নগরীর বাইরে গিয়েই কুরাইশদের মোকাবেলা করা হবে।


বদরের যুদ্ধের তুলনায় আরো দক্ষ ও অভিজ্ঞ ১০০০ সেনা নিয়ে হযরত মুহাম্মাদ (সঃ) ওহুদ অভিমুখে যুদ্ধযাত্রা করেন। এরই মাঝে ছোট্ট একটি দুর্ঘটনা ঘটে, আব্দুল্লাহ ইবনে উবাই তার ৩০০ সৈন্য নিয়ে যুদ্ধ থেকে সটকে পড়ে। 


সে যুক্তি দেখায় মদিনা সনদে আক্রমন হলে প্রতিরোধের কথা বলা হয়েছে নগরের বাইরে গিয়ে যুদ্ধ করতে বলা হয়নি। 


 ইবনে উবাইর এমন সিদ্ধান্তে মুসলিম বাহিনী কিছুটা দমে যায়৷ নতুন করে পরিকল্পনা সাজাতে হয় মুহাম্মাদ (স) কে। যথারীতি মুসলিম বাহিনী ওহুদের পাদদেশে বালুকাময় সমতল ভূমিতে তাদের শিবির স্থাপন করে। 


এ যুদ্ধে নারীদের নানাভাবে অংশগ্রহন নতুন মাত্রা যোগ করে। হযরত আয়েশা (রা) সহ অনেক মুসলিম নারী যুদ্ধে স্বেচ্ছাসেবকের দায়িত্ব পালন করেন। যাইহোক, হযরত মুহাম্মাদ (সঃ) পাহাড়ের বৃত্তাকার অংশের বাইরে থেকে আক্রমনের জন্য সিদ্ধান্ত নেন এবং সে অনুযায়ী আইনাইন পাহাড়ের শীর্ষভাগে তীরন্দাজ বাহিনীর ৫০ টি ক্ষুদ্র দলকে নিয়োজিত করেন।


কুরাইশরা পেছনদিক থেকে যাতে আক্রমন না করতে পারে এজন্য ওহুদ ও আইনাইন পাহাড়ের মধ্যবর্তী সংকীর্ণ পথের দায়িত্ব তীরন্দাজ বাহিনী এবং আব্দুল্লাহ ইবনে যুবাইরের অশ্বারোহী দলের ওপর ন্যস্ত করা হয়।


তীরন্দাজ বাহিনীকে উদ্দেশ্য করে হযরত মুহাম্মাদ (সঃ) সতর্কবার্তা উচ্চারণ করে বলেন কোন অবস্থায়ই যাতে তাঁর নির্দেশ উপেক্ষা করে তারা এই স্থান ত্যাগ না করে। তিনি তাদেরকে এও বলেন, “এমনকি যদি দেখো আমরা পরাজিত হয়েছি, আমাদের মৃতদেহ পশু ভক্ষণ করছে তবুও আমি নির্দেশ না দেয়া পর্যন্ত তোমরা এ স্থান ত্যাগ করবে না”। 


২১ মার্চ (কোন বর্ণনামতে ২৬ মার্চ) মুসলমানদের উপস্থিতির সংবাদ পেয়ে কুরাইশ বাহিনী তাদের প্রধান পদাতিক দল এবং ইকরামার অশ্বারোহী দল মুসলিমদের দুনিয়া থেকে বিদায় করে দিতে অগ্রসর হয়৷ খালিদ বিন ওয়ালিদকে পশ্চাতদেশ হতে আক্রমনের জন্য নিয়োজিত রাখা হয় কিছুসংখ্যক অশ্বারোহী দিয়ে।


অবশেষে উভয় বাহিনী সম্মুখ সমরে নামে। যুদ্ধের প্রথা অনুযায়ী মল্লযুদ্ধে কুরাইশ বীর তালহা এবং মুসলিম বীরকেশরী হযরত হামযা অবতীর্ণ হন। তালহা হযরত হামযার কাছে পরাজিত হলে শুরু হয় সাধারন যুদ্ধ৷ শুরু থেকেই মুসলিমদের কাছে মক্কার কুরাইশরা কোণঠাসা হতে শুরু করে৷


ধারাবাহিকভাবে পর্যুদস্ত হতে থাকলে কুরাইশরা দিগ্বিদিক পালাতে শুরু করে। বিজয় নিশ্চিত না হয়ে মুসলিম বাহিনী এক ভুল করে বসে। 


 নিজেদের বিজয় হয়েছে ভেবে যুদ্ধাস্ত্র ও শত্রুশিবির লুন্ঠন করতে থাকে প্রধান সেনাদল৷ মূল বাহিনীর এহেন কাজ দেখে প্রতিরক্ষায় থাকা তীরন্দাজ বাহিনী এবং আব্দুল্লাহ যুবাইরের অশ্বারোহী দল হযরত মুহাম্মাদ (সঃ) এর নির্দেশ বেমালুম ভুলে লুন্ঠনযজ্ঞে যোগ দেয়।


হঠাৎ করে যুদ্ধ নতুন বাঁক নেয়, পেছন দিক হতে পুরোপুরি অরক্ষিত হয়ে পড়ে মুসলিম বাহিনী৷ এই সুযোগ শতভাগ কাজে লাগালেন কুরাইশদের অশ্বারোহী সেনাপতি খালিদ বিন ওয়ালিদ৷ দুর্ধর্ষ এ দূরদর্শী নেতা মুহূর্তেই যুদ্ধের গতি বুঝে ফেলেন এবং পালিয়ে যাওয়ার ভান করে পেছন দিক হতে মুসলিম শিবিরে অতর্কিত আক্রমন শুরু করে দেন।


আব্দুল্লাহ ইবনে যুবাইর শত চেষ্টা করেও খালিদকে প্রতিরোধ করতে না পেরে প্রাণ দেন। ছত্রভঙ্গ মুসলিমদের উপর তখন পালিয়ে যাওয়া কুরাইশরা আবার নতুন করে আক্রমন শুরু করে দেয়। দিশেহারা বাহিনীকে শৃঙ্খলার মধ্যে নিয়ে আসার চেষ্টা করতে থাকেন হযরত মুহাম্মাদ (স:)। 


 কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে সেই কাজটি করা সম্ভব হয়ে উঠেনি। এরই মধ্যে কুরাইশ যোদ্ধা ইবনে কামিয়া প্রবল আক্রোশে মুহাম্মাদ (স) কে লক্ষ্য করে পাথর ছুঁড়ে মারে। এতে তাঁর দুটি দাঁত ক্ষতিগ্রস্ত হয় এবং তিনি অজ্ঞান হয়ে পড়েন৷


এরই মধ্যে মুসলিম বাহিনীর পতাবাহক হযরত মুসয়াব (রা) নিহত হলে কুরাইশরা রটায় যে হযরত মুহাম্মদ (স) যুদ্ধে নিহত হয়েছেন।এখানে বলা প্রয়োজন যে হযরত মুসাবের চেহারার সাথে মুহাম্মাদ (স) এর চেহারার কিছু মিল ছিল। এ গুজবে মুসলিম বাহিনী পুরোপুরি আশাহত হয়ে পড়ে।


হযরত মুহাম্মাদ (স:) নিহত হয়েছেন এবং মুসলিমরা পরাজিত হয়েছে ভেবে মহা আনন্দে কুরাইশরা যুদ্ধ ময়দান ত্যাগ করে৷ এ যুদ্ধে কুরাইশরা চরম পৈশাচিকতার পরিচয় দেয়। নিহত মুসলিমদের নাক ও কান ছিড়ে বীভৎসতার ন্যাক্কারজনক উদাহরন টানে৷


আবু সুফিয়ানের স্ত্রী হিন্দা হযরত হামযার হৃদপিণ্ড চিবিয়ে চূড়ান্ত পৈশাচিকতা প্রদর্শন করে। 


যুদ্ধ ময়দান ত্যাগ

করার পর আবু সুফিয়ান জানতে পারে মুহাম্মদ (স) মারা যাননি৷ তাই সে অপার সাহসে বদরের প্রান্তরে আবার মুসলিম বাহিনীকে ধ্বংস করে দিতে তার বাহিনী নিয়ে আসে। 


ইতিমধ্যে মুহাম্মাদ (স) তার সৈন্য সংগঠিত করে ফেলেন এবং আবু সুফিয়ানের আগমন সংবাদ পেয়ে আহত বাঘের মত রুখে দাঁড়ানোর শপথ নেয় মুসলিম যোদ্ধারা৷ মুসলিমদের ভয়ংকর যুদ্ধসাজ দেখে ভীত আবু সুফিয়ান যুদ্ধ না করেই ফিরে যায়৷ ইতিহাসে এ ঘটনা দ্বিতীয় বদর নামে পরিচিত। 


 ওহুদের যুদ্ধের ফলাফল কী ছিল ?


দ্বিতীয় বদরের যুদ্ধে কুরাইশদের তাড়িয়ে দেয়া কার্যত মুসলিমদের জয় নির্দেশ করে। কিন্তু জয় পরাজয়ের সরাসরি হিসেবে কোন পক্ষকেই জয়ী না ধরলেও সেনা সদস্য নিহতের সংখ্যাতাত্ত্বিক হিসেবে মুসলমানদের পরাজিত হিসেবে দেখানো হয়৷


কারন কুরাইশদের ২৩ জন নিহত হওয়ার বিপরীতে ৭৪ জন মুসলিম সৈন্য এ যুদ্ধে নিহত হন। ওহুদের যুদ্ধ মুসলমান এবং ইসলামের জন্য ছিল এক কঠিন পরীক্ষা। নেতার নির্দেশ অমান্যের ফলাফল কী হতে পারে তা ভালভাবেই টের পেয়েছিল তারা যা পরবর্তীতে বহুলাংশে কাজে লাগে। অন্যদিকে জয়ী হয়েও কুরাইশরা এ যুদ্ধে তুষ্ট থাকতে পারেনি।


অধিক সংখ্যক সামরিক ক্ষয়ক্ষতি এবং মুহাম্মাদ (স) কে হত্যা করতে না পারায় জয়ী হয়েও বিশেষ খুশি হতে পারেনি তারা। 


ইসলামের যুদ্ধগুলোর মধ্যে খন্দকের যুদ্ধ অন্যতম। ৫ হিজরির শাওয়াল মাসে খন্দকের যুদ্ধ সংঘটিত হয়। এই যুদ্ধে মক্কার কুরাইশ, মদিনার ইহুদি, বেদুইন, পৌত্তলিকেরা সম্মিলিতভাবে মুসলমানদের বিরুদ্ধে আক্রমণ করেছিল।


খন্দক শব্দের অর্থ পরিখা বা গর্ত। যেহেতু এ যুদ্ধে অনেক পরিখা খনন করা হয়, তাই এর নাম দেওয়া হয়েছে খন্দকের যুদ্ধ। এ যুদ্ধ আহজাব নামেও পরিচিত। আহজাব অর্থ সম্মিলিত বাহিনী। 


 নবীজি (সা.) মদিনায় আসার আগে সেখানে বড় দুটি ইহুদি সম্প্রদায় বসবাস করত। বনু নাজির ও বনু কোরায়জা। ইহুদিদের প্ররোচনায় কুরাইশ ও অন্যান্য গোত্র মদিনার মুসলমানদের সঙ্গে যুদ্ধ করার প্রস্তুতি গ্রহণ করে।


খন্দকের এই যুদ্ধ ছিল মদিনার ওপরে গোটা আরব সম্প্রদায়ের এক সর্বব্যাপী হামলা এবং কষ্টকর অবরোধের এক দুঃসহ অভিজ্ঞতা। এই যুদ্ধে শত্রুদের সৈন্যসংখ্যা ছিল ১০ হাজার, যা ছিল মদিনার মোট জনসংখ্যার চেয়ে বেশি।


মুসলিম বাহিনীর সৈন্যসংখ্যা ছিল ৩ হাজার। কিন্তু তারা যে অভিনব যুদ্ধকৌশল অবলম্বন করে, তা শত্রুদের অজানা ছিল। ফলে তারা হতাশাগ্রস্ত ও পর্যুদস্ত হয়ে অবশেষে পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়। 


 আবু সুফিয়ানের নেতৃত্বে মক্কা থেকে ১০ হাজার লোকের সম্মিলিত বাহিনী মদিনার দিকে যাত্রা করে। মক্কার সম্মিলিত বাহিনীর যুদ্ধযাত্রার খবর পেয়ে নবীজি (সা.) সাহাবিদের নিয়ে পরামর্শ করলেন।


মদিনার তিন দিকে খেজুরগাছের বাগান। বাকি থাকে একদিক। (সালা পাহাড়কে পেছনে এবং ওহুদ পাহাড়কে সামনে রেখে পরিখা খনন হয়) সেদিকে পরিখা খননের কথা হজরত সালমান ফারসি (রা.) বললেন। 


পরিখা খনন ছিল পারস্য দেশের একটি যুদ্ধকৌশল। একটি ঘোড়া লাফ দিয়ে যতটুকু যেতে পারে, তার চেয়ে বেশি দূরত্বে গর্ত খনন করা হয়। তাই শুরু হলো পরিখা খনন। ১০ জন করে একটি গ্রুপ। প্রতিটি গ্রুপ দৈর্ঘ্য ১০ হাত, প্রস্থে ১০ হাত, গভীরতায় ১০ হাত পরিখা খনন করে।


ছয় দিনে পরিখা খনন শেষ হয়। পরিখা খননকালে একটি বড় ও শক্ত পাথর সামনে পড়ে, যা ভাঙা অসম্ভব হয়ে পড়ে। রাসুল (সা.)–কে বিষয়টি জানানো হলে তিনি এসে আঘাত করলে তা ভেঙে চূর্ণবিচূর্ণ হয়ে যায়। এ ঘটনা নবী করিম (সা.)-এর একটা বিশেষ মুজিজা। 


 সম্মিলিত বাহিনী যখন মদিনায় এসে ‍উপনীত হয়, তখন সাহাবিদের খননকাজ শেষ। ১০ হাজার সেনার বাহিনী ওহুদ পাহাড়ের পাশে তাঁবু ফেলে। নবীজি হজরত মুহাম্মদ (সা.) ৩ হাজার সাহাবি নিয়ে হাজির হলেন। দুই দল দুই দিকে, মাঝখানে খন্দক।


কুরাইশ বাহিনী খন্দক দেখে হতভম্ব। তখন তারা মদিনা অবরোধ করে। শত্রুরা প্রায় এক মাস মদিনা অবরোধ করে রইল। এই অবরোধ এত কঠিন ছিল যে মুসলমানদের বহু বেলা খাবার না খেয়ে থাকতে হয়েছিল। কিন্তু অবরোধকারীরা কিছুতেই পরিখা পার হতে পারল না। 


হজরত মুহাম্মদ (সা.) তাঁর সৈন্যদের পরিখার বিভিন্ন স্থানে মোতায়েন করলেন। কাফেররা বাইরে থেকে পাথর ও তির ছুড়তে শুরু করলে এদিক থেকেও তার প্রত্যুত্তর দেওয়া হলো। এরই ভেতর বিক্ষিপ্তভাবে দু-একটি হামলাও চলতে লাগল। 


 অবরোধ যত দীর্ঘায়িত হলো, শত্রুদের উৎসাহও তত কমতে লাগল। ১০ হাজার লোকের খাওয়াদাওয়ার ব্যবস্থা করা মোটেই সহজ কাজ ছিল না। তার ওপর ছিল প্রচণ্ড শীত। এরই মধ্যে একদিন এমন প্রচণ্ড বেগে ঝড় বইল যে কাফেরদের সব ছাউনি উড়ে গেল। 


তাদের সৈন্যসামন্ত ছিন্নভিন্ন হয়ে গেল। তাদের ওপর যেন আল্লাহর আজাব নেমে এল। আর বাস্তবিকই আল্লাহ তাআলা মুসলমানদের জন্য রহমত এবং কাফেরদের জন্য আজাব হিসেবেই এ ঝড় পাঠিয়েছিলেন।


কাফেররা এ পরিস্থিতির মোকাবিলা করতে পারল না। অবস্থা বেগতিক দেখে ইহুদিরা আগেই সরে পড়েছিল। কুরাইশদেরও ফিরে যাওয়া ছাড়া আর কোনো উপায় রইল না। 


আহজাব যুদ্ধে ৮ জন মুসলিম শহীদ হন। অন্যদিকে, শত্রুপক্ষে ৪ জন মারা যায়। অবরোধের সময় কেউ বলেছেন ২৪ দিন, অন্য বর্ণনায় ১৫ দিন পাওয়া যায়। খন্দক যুদ্ধ সম্পর্কে আল্লাহপাক সুরা আহজাবে ৯ থেকে ২৭ পর্যন্ত ১৯টি আয়াত নাজিল করেন, যাতে এই যুদ্ধের বহু বিষয়ে আলোকপাত করা হয়েছে।


খন্দক আমাদের এই শিক্ষা দেয়—ইমান ও ধৈর্যের সঙ্গে আল্লাহর ওপর আস্থা স্থাপন করলে আল্লাহর রহমত থেকে কেউ বঞ্চিত হয় না। 


মুতার যুদ্ধের ইতিহাস


বালকার সন্নিকটে সিরিয়ার একটি স্থানের নাম মুতা যা সৌদি আরবের সীমান্ত শহর। আরবে প্রাচ্যের তরবারী খুবই বিখ্যাত ছিল, যা মুতা নামক স্থানে তৈরি হত।


হুদায়বিয়ার সন্ধি (মার্চ ৬২৮ খ্রিষ্টাব্দ) থেকে মক্কা বিজয় (জানুয়ারী ৬৩০ খ্রিষ্টাব্দ) পর্যন্ত সমযে় মুসলমানগণ কর্তৃক যে ১৭টি অভিযান পরিচালিত হয় তন্মধ্যে মুতা অভিযান ছিল অন্যতম। উমরাতুল কাযা শেষে মদিনায় ফিরে এসে রাসুলে পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যিলহাজ্জের অবশিষ্ট দিনগুলো এবং মুর্হারম, সফর, রবিউল আউয়াল ও রবিউছছানী এ কযে়ক মাস মদিনায় অবস্থান করেন।


তারপর ৬২৯ খ্রিষ্টাব্দ, ৮ম হিজরীর জুমাদাল উলা মাসে রাসুলে পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সিরিয়া অভিমুখে একটি বাহিনীকে অভিযানে প্রেরণ করেন। মুতা নামক স্থানে শত্রু বাহিনীর সাথে যুদ্ধ সংঘঠিত হওয়ায় ইসলামের ইতিহাসে তা “মুতার যুদ্ধ” নামে খ্যাত। এটি কাফেরদের সাথে মুসলমানদের একটি অসম যুদ্ধ ছিল। 


অভিযান পরিচালনার কারণ 


রাসুলে পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বছরার শাসনকর্তা অথবা রোমাধিপতি হিরাক্লিয়াসের নিকট হযরত হারেছ ইবনে ওমাইর (রা.) কে দূত হিসাবে প্রেরণ করেন। 


আরব ও সিরিয়া সীমান্ত সংলগ্ন এলাকায় যে আরব নেতারা শাসন কার্য পরিচালনা করত তাদের মধ্যে সুরাহ বিল আমরও ছিল। সে রোমাধিপতির অধীনে বালকা এলাকার সরদার ছিল। এ আরব খান্দানটি দীর্ঘকাল ধরে খৃষ্টান ছিল এবং এরা সিরিয়া সীমান্তে শাসন কাজ পরিচালনা করত।


রোমান সামন্তরাজ সুরাহ বিল আমর রাসুলে পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর প্রেরিত দুতকে মুতা নামক স্থানে নৃশংসভাবে শহীদ করে। এর পূর্বে রাসুলে পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কর্তৃক প্রেরিত কোন দূত শহীদ হননি।


এ বিশ্বাস ঘাতকতামূলক হত্যার উপযুক্ত প্রতিশোধ গ্রহণের জন্য রাসুলে পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তিন হাজার সৈন্যের এক বাহিনী গঠন করে সিরিয়া অভিমূখে প্রেরণ করেন। যদিও এ অভিযান কিসাস গ্রহণের উদ্দ্যেশ্যেই প্রেরিত হযে়ছিল। কিন্তু মুল লক্ষ্য ছিল ইসলামের তাবলীগ।


রাসুলে পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সেনাপতিদের নির্দেশ দিলেন প্রথমে তাদেরকে ইসলামের দাওয়াত দিবে। তারা ইসলাম গ্রহণ করলে যুদ্ধের প্রযে়াজন নেই। সাথে সাথে এই নির্দেশও দেওয়া হল যে, সমবেদনা প্রকাশের জন্য ঐ স্থান পর্যন্ত গমন করবে, যেখানে হযরত হারেছ ইবনে ওমাইর (রা.) কর্তব্য পালনকালে প্রাণোৎসর্গ করেছেন। 


 একই যুদ্ধে তিন জন সেনাপতি নিয়োগ


ইবনে ইসহাক বলেন, মুহাম্মদ ইবনে জাফর ইবনে যুবাযে়র আমার নিকট উরওয়া ইবনে যুবাযে়র সূত্রে বর্ণনা করেন, অষ্টম হিজরীতে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মুতা অভিমুখে একটি অভিযান প্রেরণ করেন।


হযরত যাযে়দ ইবনে হারেছা (রা.) কে সে বাহিনীর সেনাপতি নিযুক্ত করে তিনি বলে দিলেন যে, যায়েদ যদি শহীদ হয়ে যায়, তাহলে জাফর ইবনে আবু তালিব সেনাপতির দায়িত্ব পালন করবে আর জাফরও যদি শহীদ হয়ে যায়, তাহলে আব্দুল্লাহ ইবেন রাওয়াহা সেনাপতির দায়িত্ব পালন করবে। 


যুরকানীর বর্ণনায় এও রযে়ছে যে, রাসুলে পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন: আব্দুল্লাহ ইবনে রাওয়াহাও যদি শহীদ হযে় যায়, তাহলে মুসলমানরা যেন তাদের মধ্য থেকে একজনকে সেনাপতি নির্ধারন করে নেয়। 


যথাসময়ে তিন হাজার মুজাহিদ রসদ নিয়ে রওয়ানা হওয়ার উদ্দ্যেশ্যে প্রস্তুতি গ্রহণ করলেন। যাত্রার প্রাক্কালে সাহাবীগণ রাসুলে পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর সেনাপতিদেরকে একে একে বিদায় সংবর্ধনা জানালেন।


তাঁরাও যথারীতি তাঁদেরকে অভিবাদন জানালেন। রাসুলেপাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ছানিয়াতুল বেদা পর্যন্ত সেনাবাহিনীর সাথে গমন করে তাঁদেরকে বিদায় জানান।


সাহাবীগণ উচ্চ স্বরে সেনাবাহীনির জন্যে এ বলে দোয়া করেন ‘আল্লাহ তোমাদের সাথী হোন, বিপদাপদ থেকে আল্লাহ তোমাদের হেফাজত করুন।’ উল্লেখ্য যে এ অভিযানে সেনাপতি হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে রাওয়াহা (রা.) অনেক গুলো কবিতা আবৃত্তি করেন। 


রোমক বাহিনী ও তাদের মিত্রদের সাথে সম্মুখ যুদ্ধ : 


 মুসলিম বাহিনী মদিনা থেকে রওয়ানা হলে গুপ্তচরেরা এ খবর সুরাহবিলের নিকট পৌঁছে দেয়। সে তাঁদের মুকাবিলা করার জন্য এক লক্ষ সৈন্য সমবেত করে।


অপরদিকে রোমাধিপতি হিরাক্লিয়াস সুরাহ বিলের সাহায্যার্থে এক লক্ষ রোমক সৈন্য নিয়ে বালকার মাআব নামক স্থানে শিবির স্থাপন করে। ইতিমধ্যে মুসলিম বাহিনী সিরিয়ার মাআন নামক স্থানে গিয়ে পৌছে। শত্রু বাহিনীর সংবাদ পেয়ে মুসলমানরা সেখানে দু’রাত অবস্থান করেন।


সেনাপতি হযরত যায়েদ ইবনে হারিছা (রা.) সার্বিক পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করে রাসুলে পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর দরবারে ঘটনাবলী জানিয়ে দেয়ার সিদ্ধান্ত নিলে বাধ সাধেন অপর সেনাপতি হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে রাওয়াহা। তিনি সেনাদলকে উদ্ধুদ্ধ করতে বীরত্বব্যঞ্জক এক ভাষন প্রদান করেন। তাতে তিনি বলেন: ‘লোক সকল !


আল্লাহর কসম এখন তোমরা যা অপছন্দ করছো, সে শাহাদাত লাভের উদ্যেশ্যেই তোমরা বেরিয়ে এসেছো। আমরা মুসলমানরা সংখ্যা, শক্তি ও আধিক্যের জোরে লড়াই করিনা। সে দীনের জন্য আমাদের লড়াই, যার দ্বারা আল্লাহ আমাদেরকে গৌরবান্নিত করেছেন। অতএব সম্মুখপানে অগ্রসর হও। দুটি কল্যাণের একটি তোমাদের জন্য অবশ্যম্ভাবী; হয় বিজয়, নয় শাহাদাত।’ 


 তাঁর এ তেজোদীপ্ত ভাষণ শুনে সকলেই বলে উঠলেন : সত্যিই তো, হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে রাওয়াহা যথার্থই বলেছেন।


অতঃপর ক্ষুদ্র মসলিম বাহিনী সামনে অগ্রসর হয়ে বালকা সীমান্তে উপনীত হলে মাশারিক নামক স্থানে তাঁদের সঙ্গে হিরাক্লিয়াসের রোমক ও আরব বাহিনীর মুখোমুখি সাক্ষাত হয়। শত্রু বাহিনী মুসলিম বাহিনীর দিকে অগ্রসর হলে তাঁরা একটু সরে গিযে় পাশ্ববর্তী মুতা নামক একটি পল্লীতে অবস্থান নেন, সেখানেই উভয়পক্ষের যুদ্ধ সংঘঠিত হয়।


মুসলমানরা তাঁদের সৈন্যদেরকে এভাবে বিন্যস্ত করেন যে, ডান ভাগের দায়িত্ব উযরা গোত্রের হযরত কুতবা ইবনে কাতাদা (রা.) এবং বাম ভাগের দায়িত্ব হযরত উবায়া ইবনে মালিক আনসারী (রা.) কে অর্পণ করা হয়। 


যায়েদ ইবনে হারিছা (রা.) এর শাহাদাত


তারপর তিন হাজার মুসলিম বাহিনী আর দুই লক্ষ কাফির বাহিনীর মধ্যে অসম যুদ্ধ শুরু হযে় যায়। হযরত যাযে়দ ইবনে হারিছা (রা.) রাসুলে পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর পতাকা হাতে লড়াই করতে করতে এক পর্যাযে় শত্রুর বল্লমের আঘাতে রক্তাক্ত অবস্থায় মাটিতে লুটিয়ে পড়েন। এভাবে রাসুলে পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর ভবিষ্যদ্বানী অনুযায়ী প্রথম সেনাপতি শহীদ হয়ে যান। 


জাফর ইবনে আবু তালিব (রা.) এর শাহাদাত


 তারপর সে পতাকা হাতে নিযে় হযরত জাফর (রা.) সেনাপতি হিসাবে যুদ্ধক্ষেত্রে অবতীর্ণ হন। ঘোরতর যুদ্ধ শুরু হলে এক পর্যাযে় তিনি তাঁর লোহিত বর্ণের ঘোড়ার পিঠ থেকে লাফিয়ে পড়েন এবং ঘোড়াটির পা কেটে ফেলেন। বীর বিক্রমে শত্রু সৈন্যের মাঝে ঢুকে পড়েন যুদ্ধের পতাকা ডান হাতে ধারণ করেন।


কাফিরদের তরবারির আঘাতে প্রথমে তাঁর ডান হাত শহীদ হয়। বাম হাতে তিনি পতাকা তুলে ধরলে এবার তাঁর বাম হাত ও শত্রুর তরবারির আঘাতে শহীদ হয়, এবার তিনি তা বাহুদ্বযে়র সাহায্যে বুকের সাথে জডি়যে় ধরেন। আর এ অবস্থাতেই শত্রুর উপুর্যপরি বর্শা ও তরবারির আঘাতে তিনি শাহাদাত বরণ করেন। 


হযরত আব্দুল্লাহ বিন ওমর (রা.) বলেন: আমি তাঁর দেহে তরবারি ও বর্শার নব্বইটি আঘাত প্রত্যক্ষ করেছি। প্রত্যেকটি আঘাতই তাঁর দেহের সম্মুখভাগে। পশ্চাৎভাগে কোন আঘাতই ছিলনা। এভাবে রাসুলে পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ভবিষ্যদ্বানী অনুযায়ী দ্বিতীয় সেনাপতি শহীদ হয়ে যান। 


যখন তিনি শহীদ হয়ে গেলেন তখন রাসুলেপাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মদিনা শরীফের মসজিদে নববীতে বসে বসে সব কিছু দেখতে পেলেন।


তিনি হঠাৎ করে গায়েবী সালামের জবাব দিয়ে বলেন: ‘ওয়ালাইকুমুস সালাম’ উপস্থিত সাহাবাগণ কারণ জিজ্ঞাস করলে রাসুলে পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন: ইন্নি আছমাউ মা লা তাছমাউন ওয়াইন্নি আরা মা লা তারাওনা (সহিহুল বুখারী)। অর্থাৎ; তোমরা যাহা শুননা আমি তাহা শুনি, তোমরা যাহা দেখনা আমি আমি তাহা দেখি। আমি দেখতে পাচ্ছি আল্লাহ পাক জাফরকে দুহাতের বদলে দুটি নূরের পাখা দান করেছেন।


সে ফেরেস্তা সহ আকাশ পথে উডে় যাচ্ছে আর আমাকে সালাম দিচ্ছে ‘আসসালাতু আসসালামুআলাইকা ইয়া রাসুলাল্লাহ’ তাই আমি তাঁর সালামের এ জবাব দিচ্ছি। 


আব্দুল্লাহ ইবনে রাওয়াহা (রা.) এর শাহাদাত


 হযরত জাফর (রা.) শহীদ হওয়ার পর রাসুলে পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর নির্দেশ মোতাবেক হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে রাওয়াহা (রা.) সেনাপতির দায়িত্ব গ্রহণ করেন।


তাঁর ঘোড়ায় চড়ে পতাকা ধারণ করে বীর বিক্রমে যুদ্ধ করে তিনিও রাসুলেপাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর ভবিষ্যদ্বানী অনুযায়ী তৃতীয় সেনাপতি হিসাবে শাহাদাত বরণ করেন। 


খালিদ ইবনে অলীদ (রা.)কে সেনাপতি নির্বাচন


 রাসুলে পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর ভবিষ্যদ্বানী অনুসারে একে একে তিন জন সেনাপতি শাহাদাত বরণ করলে আজলান গোত্রের হযরত ছাবিত ইবনে আরকান (রা.) পতাকা ধারণ করে মুসলিম সৈন্যদের প্রতি উদাত্ত আহ্বান জানালেন : হে মুসলিম সৈন্যরা তোমরা শলা-পরামর্শের মাধ্যমে তোমাদের কোন একজনকে সেনাপতি নিযুক্ত কর !


জবাবে তারা বললেন: আপনিতো আছেনই। তখন তিনি বললেন: না আমি এ গুরু দাযি়ত্ব পালন করতে পারবোনা। তখন তাঁরা সকলে মিলে হযরত খালিদ ইবনে অলীদ (রা.)কে সেনাপতি নির্বাচিত করলেন।


তিনি পতাকা হাতে নিযে়ই বাহিনীর প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা মজবুত করে প্রবল পরাক্রমে যুদ্ধ চালাতে লাগলেন। অসংখ্য শত্রু বাহিনীকে তিনি নিধন করে চললেন। অবশেষে শত্রুরা পলায়ন করলো। মহান আল্লাহ তায়ালা তাঁর হাতে মুসলমানদের বিজয় দান করলেন।


ঐ যুদ্ধে হযরত খালিদ ইবনে অলীদ (রা.) এর হাতে মোট আটখানা তরবারী ভেঙ্গেঁ গিযে়ছিল, (সহিহুল বুখারী)। রাসুলে পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর তেজস্বিতা ও বীরত্বে স্বীকৃতি স্বরূপ তাঁকে ‘সাইফুল্লাহ’ তথা আল্লাহর তরবারী খেতাবে ভূষিত করেন।


বিপুল পরিমান গণিমতের মালসহ প্রায় সকল সৈন্যদের অক্ষত নিযে় হযরত খালিদ ইবনে অলীদ (রা.) বিজয়ী বেশে মদিনায় প্রত্যাবর্তন করেন। ইবনে ইসহাক বলেন: মুসলিম বাহিনী মদিনার নিকটবর্তী হলে রাসুলে পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এবং মুসলমানগণ এগিয়ে গিয়ে তাঁদের অভ্যর্থনা জানান। 


যুদ্ধের পরিস্থিতি সম্পর্কে রাসুলে পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর অবগতি লাভ : 


 ইবনে ইসহাক বলেন : মুসলিম বাহিনী যখন বিপর্যযে়র সম্মুখীন হলো তখন রাসুলে পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মদিনায় বলে উঠলেন, যায়েদ ইবনে হারিছা পতাকা হাতে নিয়ে লড়তে লড়তে শহীদ হয়ে গিয়েছেন। আর জাফর পতাকা ধারণ করেছে এবং সেও শহীদ হয়ে গিয়েছে। এতটুকু বলে রাসুলে পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিবর হযে় যান।


ফলে আনসারদের মুখমণ্ডল বিবর্ণ হযে় যায় এবং তাঁরা ধারণা করেন যে, আব্দুল্লাহ ইবনে রাওয়াহার সংবাদও হয়তো সন্তোষজনক নয়। তারপর রাসুলে পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন: ‘এর পর আব্দুল্লাহ ইবনে রাওয়াহা পতাকা ধারণ করেছে।


তাপর সেও পতাকা হাতে লড়তে লড়তে শাহাদাত লাভ করেছে। তারপর তিনি পুনরায় বললেন: আমি দেখলাম জান্নাতে এদের সকলকে আমার কাছে উপস্থিত করা হযে়ছে।


তাঁরা সকলেই স্বর্ণের পালক্সেক উপবিষ্ট রযে়ছে। কিন্তু আব্দুল্লাহ ইবনে রাওয়াহার পালক্সক একটু কাত হযে় রযে়ছে। আমি জিজ্ঞাসা করলাম এমনটি হলো কেন ?


উত্তরে আমাকে বলা হলো: ওরা দুজন নির্দ্ধিধায় সম্মুখে অগ্রসর হয়েছিল। পক্ষান্তরে আব্দুল্লাহ কিছুক্ষন ইতস্তত: করে তারপর অগ্রসর হয়েছিল।’ 


হযরত খালেদ ইবনে অলীদ (রা.) দায়িত্বের ব্যাপারে রাসুলে পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন : আল্লাহর তরবারী অর্থাৎ খালিদ ইবনে অলীদ এইমাত্র মুসলিম বাহিনীর পতাকা ধারন করেছে। আল্লাহ মুসলিম বাহিনীকে শত্রুদের উপর বিজয় দান করেছেন (সহিহুল মুসলিম)। 


 উপরোল্লেখিত আলোচনা থেকে আমরা নির্দ্ধধায় বলেত পারি যে, মুতা অভিযানে যুদ্ধ পরিস্থিতির আগাম সংবাদ।


যুদ্ধকালিন সময়ের ঘটনাবলির বর্ণনা তথা তিনজন সেনাপতির শাহাদাতের তাৎক্ষণিক সংবাদ, হযরত জাফর ইবনে আবু তালেব (রা.) আকাশ পথে নূরের পাখা লাভ করে ফেরেস্তাসহ উড়ে বেড়ানো, হযরত খালিদ ইবনে অলীদ (রা.) সেনাপতি মনোনীত হওয়া এবং তাঁর মাধ্যমে ইসলামের বিজয় পতাকা উড্ডীন করার সংবাদ প্রদান, রাসুলে পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর ইলমে গায়েবের অকাট্য প্রমাণ বহন করে। আরও পড়ুন দীন কাকে বলে


ভূমিকা : লিখতে গিয়ে যদি ভূল হয়ে থাকে তাহলে ক্ষমা সুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন।


এবং কোন সাজেশন এর প্রয়োজন হলে আমাকে ইমেইল এর মধ্যেমে জানিয়ে দিবেন!

প্রতিদিন এই ওয়েবসাইট ভিজিট করুন ।


ভালো লাগলে শেয়ার করবেন,

সাথে থাকার জন্য ধন্যবাদ ।

Please Do,not Share Any Spam Links

Post a Comment (0)
Previous Post Next Post