হযরত মুহাম্মদ (সঃ) এর জীবন কাহিনী
আরব জাতিঃ
মধ্যপ্রাচ্যের মূল অধিবাসী হ’লেন আরব জাতি। সেকারণ একে আরব উপদ্বীপ (جزيرة العرب) বলা হয়। আরবরা মূলতঃ তিনটি সম্প্রদায়ে বিভক্ত।
More Info: হযরত আয়শা (রাঃ) জীবনী
১. আদি আরব (العربُ البائدةُ) যারা আদ, ছামূদ, আমালেক্বা প্রভৃতি আদি বংশের লোক। যাদের বিস্তৃত ইতিহাস পাওয়া যায় না।
More Info: বদর যুদ্ধের কাহিনী
২. ক্বাহত্বানী আরব (العربُ العارِبَةُ)। যারা ইয়ামনের অধিবাসী। এরা ইয়া‘রাব বিন ইয়াশজাব বিন ক্বাহত্বানের বংশধর।
৩. ‘আদনানী আরব (العربُ الْمُسْتَعْرِبَةُ)। এরা ইরাক থেকে আগত ইবরাহীম-পুত্র ইসমাঈল (আঃ)-এর বংশোদ্ভূত ‘আদনান-এর বংশধর। এদের বংশেই রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর জন্ম হয়।
আরবের অবস্থানস্থল
আরবের অবস্থানস্থল তিনদিকে সাগর বেষ্টিত প্রায় ১৩ লক্ষ বর্গমাইল ব্যাপী বিশ্বসেরা আরব উপদ্বীপ কেবল পৃথিবীর মধ্যস্থলেই অবস্থিত নয়, বরং এটি তখন ছিল চতুর্দিকের সহজ যোগাযোগস্থল ও ব্যবসা-বাণিজ্যের কেন্দ্রভূমি।
বর্তমান ফ্রান্সের প্রায় দ্বিগুণ এই বিশাল ভূখন্ডটির অধিকাংশ এলাকা মরুময়।
অথচ এই ধূসর মরুর নীচে রয়েছে আল্লাহর রহমতের ফল্গুধারা বিশ্বের মধ্যে মূল্যবান তরল সোনার সর্বোচ্চ রিজার্ভ। এর পশ্চিমে লোহিত সাগর, পূর্বে আরব উপসাগর। যা গ্রীকদের নিকট পারস্য উপসাগর নামে খ্যাত।
দক্ষিণে আরব সাগর (যা ভারত মহাসাগরের বিস্তৃত অংশ) এবং উত্তরে সিরিয়া ও ইরাকের ভূখন্ড। পানিপথ ও স্থলপথে আরব উপদ্বীপ এশিয়া, আফ্রিকা ও ইউরোপ তিনটি মহাদেশের সাথে যুক্ত।
নবুঅতের কেন্দ্রস্থলঃ
আদি পিতা আদম, নূহ, ইদ্রীস, হূদ, ছালেহ, ইবরাহীম, লূত্ব, ইসমাঈল, ইসহাক্ব, ইয়াকূব, শু‘আয়েব, মূসা, দাঊদ, সুলায়মান, ইলিয়াস, যাকারিয়া, ইয়াহইয়া ও ঈসা (‘আলাইহিমুস সালাম) এবং সর্বশেষ নবী হযরত মুহাম্মাদ (সঃ) সহ সকল নবী ও রাসূলের আবির্ভাব ও কর্মস্থল ছিল মধ্যপ্রাচ্যের এই পবিত্র ভূখন্ড।
এর নানাবিধ কারণ থাকতে পারে। তবে আমাদের ধারণায়ঃ
প্রথম কারণ ছিল অনুর্বর এলাকা হওয়ায় এখানকার অধিবাসীগণ ব্যবসায়ে অভ্যস্ত ছিল।
ফলে পৃথিবীর অন্যান্য এলাকার সঙ্গে আরবদের নিয়মিত বাণিজ্যিক যোগাযোগ ছিল। সেকারণ খুব সহজেই এখান থেকে নবুঅতের দাওয়াত সারা বিশ্বে দ্রুত ছড়িয়ে পড়ত।
দ্বিতীয় কারণ হ’ল এই ভূখন্ডে ছিল দু’টি পবিত্র স্থানের অবস্থিতি। প্রথমটি ছিল মক্কায় বায়তুল্লাহ বা কা‘বাগৃহ। যা হযরত আদম (আঃ) কর্তৃক প্রথম নির্মিত হয়। অতঃপর ইবরাহীম ও তৎপুত্র ইসমাঈলের হাতে পুনর্নির্মিত হয়।
দ্বিতীয়টি ছিল বায়তুল মুক্বাদ্দাস, যা কা‘বাগৃহের চল্লিশ বছর পর আদম-পুত্রগণের কারু হাতে প্রথম নির্মিত হয়, যা নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়। অতঃপর ইবরাহীম (আঃ)-এর পৌত্র ইয়াকূব বিন ইসহাক (আঃ) কর্তৃক নির্মিত হয়।
অতঃপর দাউদ ও সুলায়মান (আঃ) কর্তৃক পুনর্নির্মিত হয়। ইবরাহীমপুত্র ইসমাঈল-এর বংশধরগণ মক্কা এলাকা আবাদ করেন। তাঁরাই বংশ পরম্পরায় বায়তুল্লাহর রক্ষণাবেক্ষণ, হাজী ছাহেবদের জান-মালের হেফাযত এবং তাদের পানি সরবরাহ, আপ্যায়ন ও তত্ত্বাবধানের দায়িত্ব পালন করেন।
অন্যদিকে ইবরাহীম (আঃ)-এর কনিষ্ঠ পুত্র ইসহাক (আঃ)-এর বংশধরগণ বায়তুল মুক্বাদ্দাস তথা আজকের ফিলিস্তীন এলাকায় বসবাস করেন। ইসহাক-পুত্র ইয়াকূব (আঃ)-এর অপর নাম ছিল ‘ইস্রাঈল’ (إسرائيل বা ‘আল্লাহর দাস’)। সেকারণ তাঁর বংশধরগণ ‘বনু ইস্রাঈল’ নামে পরিচিত।
এভাবে আরব উপদ্বীপের দুই প্রধান এলাকা সহ পৃথিবীর প্রায় সর্বত্র ইবরাহীম (আঃ)-এর বংশধর বনু ইসমাঈল ও বনু ইস্রাঈল কর্তৃক তাওহীদের দাওয়াত প্রসার লাভ করে। সাথে সাথে তাদের সম্মান ও প্রতিপত্তি সর্বত্র বিস্তৃত হয়।
আল্লাহ বলেন, إِنَّ اللهَ اصْطَفَى آدَمَ وَنُوْحاً وَآلَ إِبْرَاهِيْمَ وَآلَ عِمْرَانَ عَلَى الْعَالَمِيْنَ- ذُرِّيَّةً بَعْضُهَا مِنْ بَعْضٍ وَاللهُ سَمِيْعٌ عَلِيْمٌ ‘নিশ্চয়ই আল্লাহ মনোনীত করেছেন আদম ও নূহকে এবং ইবরাহীম পরিবার ও ইমরান পরিবারকে জগদ্বাসীর মধ্য হতে।
তারা একে অপরের সন্তান। আর আল্লাহ সর্বশ্রোতা ও সর্বজ্ঞ’ (আলে ইমরান ৩/৩৩-৩৪; আনকাবূত ২৯/২৭)। ইমরান ছিলেন মূসা (আঃ)-এর পিতা অথবা মারিয়াম-এর পিতা। সকলের মূল পিতা হ’লেন আবুল আম্বিয়া ইবরাহীম (আঃ)।
পৃথকভাবে ‘আলে ইমরান’ বলার মাধ্যমে মূসা ও ঈসা (আঃ)-এর বিশাল সংখ্যক উম্মতকে বুঝানো হয়েছে। আর ইবরাহীম (আঃ)-এর জ্যেষ্ঠ পুত্র ইসমাঈল (আঃ)-এর বংশে শেষনবী ও শ্রেষ্ঠ নবী মুহাম্মাদ (সঃ)-এর আগমন ঘটেছে। যাঁর উম্মত সংখ্যা দুনিয়া ও আখেরাতে সর্বাধিক।
রাজনৈতিক অবস্থাঃ
রাজনৈতিক অবস্থা আরবভূমি মরুবেষ্টিত হওয়ায় তা সর্বদা বহিঃশক্তির আক্রমণ থেকে নিরাপদ ছিল। ফলে এরা জন্মগতভাবে স্বাধীন ছিল। এই সময় আরবের দক্ষিণাংশে ছিল হাবশার সাম্রাজ্য, পূর্বাংশে ছিল পারসিক সাম্রাজ্য এবং উত্তরাংশের ভূখন্ডসমূহ ছিল রোমক সাম্রাজ্যের করতলগত।
সম্রাট শাসিত এইসব অঞ্চলের অধিবাসীরা সবাই ছিল ধর্মের দিক দিয়ে খ্রিষ্টান।
যদিও প্রকৃত ধর্ম বলতে সেখানে কিছুই ছিল না।
মক্কা ও ইয়াছরিব (মদীনা) সহ আরবের বাকী ভূখন্ডের লোকেরা স্বাধীন ছিল। তাদের কোন কেন্দ্রীয় শাসন ব্যবস্থা ছিল না। তবে তারা গোত্রপতি শাসিত ছিল।
ধর্মীয় অবস্থাঃ
ধর্মীয় অবস্থা এ ব্যাপারে জানার জন্য কুরআনই বড় উৎস। সে বর্ণনা অনুযায়ী জাহেলী যুগের আরবরা আল্লাহর নৈকট্য হাছিলের জন্য মনগড়া উপাস্য সমূহ নির্ধারণ করেছিল (ইউনুস ১০/১৮)।
তারা আল্লাহকে স্বীকার করত। সেই সাথে সুফারিশকারী হিসাবে অন্যদের উপাস্য মানত (আন‘আম ৬/১৯)। ঐতিহাসিক বর্ণনা অনুযায়ী তারা মূর্তিগুলিকে তাদের পূজিত ব্যক্তিদের ‘রূহের অবতরণ স্থল সমূহ’ (مَنَازِلُ الْأَرْوَاحِ) বলে মনে করত।
মূর্তিপূজা তাদের আক্বীদা ও সমাজ-সংস্কৃতিতে মিশে গিয়েছিল। যুগ পরম্পরায় তারা এই আক্বীদায় বিশ্বাসী ও রীতি-নীতিতে অভ্যস্ত হয়ে উঠেছিল (যুখরুফ ৪৩/২২)।
তারা কা‘বা গৃহে মূর্তি স্থাপন করেছিল এবং হজ্জের অনুষ্ঠানসমূহে পরিবর্তন এনেছিল। তাওয়াফের জন্য ‘হারামের পোষাক’ (ثِيَابُ الْحَرَمِ) নামে তারা নতুন পোষাক পরিধানের রীতি চালু করেছিল।
নইলে লোকদের নগ্ন হয়ে তাওয়াফ করতে হ’ত। কুরায়েশরা মূর্তিপূজা করত।
সেই সাথে নিজেদেরকে ইবরাহীম (আঃ)-এর একান্ত অনুসারী হিসাবে ‘হানীফ’ (حَنِيْف) ‘একনিষ্ঠ একত্ববাদী’ বলত।
এছাড়া তারা নিজেদেরকে ‘হুম্স’ (حُمْس), ‘ক্বাত্বীনুল্লাহ’ (قَطِيْنُ اللهِ) ‘আহ্লুল্লাহ’ (أَهْلُ اللهِ) এবং ‘আল্লাহর ঘরের বাসিন্দা’ (أَهْلُ بَيْتِ اللهِ) বলে দাবী করত’।
[1] সেকারণ তারা মুযদালিফায় হজ্জ করত, আরাফাতের ময়দানে নয়। কেননা মুযদালিফা ছিল হারামের অন্তর্ভুক্ত এবং আরাফাত ছিল হারাম এলাকার বাইরে। যেখানে বহিরাগত হাজীরা অবস্থান করত। ইসলাম আসার পর এই প্রথা নিষিদ্ধ করা হয় এবং সকলকে আরাফাতের ময়দানে অবস্থান করতে বলা হয় (বাক্বারাহ ২/১৯৯)।
তারা হজ্জের মাস সমূহে ওমরাহ করাকে ‘সবচাইতে নিকৃষ্ট কাজ’ (أَفْجَرُ الْفُجُوْر) বলে ধারণা করত। তারা কা‘বাগৃহে ইবাদতের সময় শিস দিত ও তালি বাজাতো (আনফাল ৮/৩৫)। তারা আল্লাহর নাম ও গুণাবলীতে পরিবর্তন এনেছিল (আ‘রাফ ৭/১৮০)।
তারা জিনদেরকে আল্লাহর শরীক নির্ধারণ করেছিল (আন‘আম ৬/১০০) এবং ফেরেশতাদেরকে আল্লাহর কন্যা বলত (নাহল ১৬/৫৭)। তারা তাকদীরকে এবং কিয়ামতকে অস্বীকার করত (আন‘আম ৬/১৪৮; নাহল ১৬/৩৮)।
তারা ইবাদত করত, কুরবানী করত বা মানত করত আখেরাতে মুক্তি লাভের উদ্দেশ্যে নয়, বরং দুনিয়াবী স্বার্থ হাছিলের জন্য। তারা মৃত্যু ও অন্য বিপদাপদকে আল্লাহর দিকে নয় বরং প্রকৃতির দিকে সম্বন্ধ করত (জাছিয়াহ ৪৫/২৩)।
তারা মূর্তির সম্মানে কুরবানী চালু করেছিল (মায়েদাহ ৫/৩)। লাত ও ‘উযযার নামে কসম করত এবং নক্ষত্রের মাধ্যমে বৃষ্টি প্রার্থনা করত’ (বুখারী হা/৩৮৫০)।
আরবদের বিশ্বাস ছিল যে, প্রতি ১৩ দিন পর একটি নক্ষত্র পশ্চিমে অস্ত যায় এবং একই সাথে পূর্ব দিকে একটি নক্ষত্র উদিত হয়। তাদের বিশ্বাস মতে উক্ত নক্ষত্র অস্ত যাওয়ার সময় অবশ্যই বৃষ্টি হয় অথবা ঠান্ডা হাওয়া প্রবাহিত হয়।
সেকারণ বৃষ্টি হ’লে তারা উক্ত নক্ষত্রের দিকে সম্বন্ধ করে বলত,مُطِرْنَا بِنَوْءٍ كَذَا ‘আমরা উক্ত নক্ষত্রের কারণে বৃষ্টি প্রাপ্ত হয়েছি।
[2] আল্লাহর হুকুমে যে বৃষ্টি হয় এটা তারা বিশ্বাস করত না। এভাবে তারা তাওহীদ বিশ্বাস থেকে বহু দূরে চলে গিয়েছিল। অথচ এটাই ছিল তাদের পিতা ইবরাহীমের মূল দাওয়াত।
তাদের চরিত্রে ও রীতি-নীতিতে এমন বহু কিছু ছিল যা ইসলামকে ধসিয়ে দিত। যেমন বংশগৌরব করা ও অন্য বংশকে তাচ্ছিল্য করা।
রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেন, أَرْبَعٌ فِى أُمَّتِى مِنْ أَمْرِ الْجَاهِلِيَّةِ لاَ يَتْرُكُونَهُنَّ الْفَخْرُ فِى الأَحْسَابِ وَالطَّعْنُ فِى الأَنْسَابِ وَالاِسْتِسْقَاءُ بِالنُّجُوْمِ وَالنِّيَاحَةُ ‘আমার উম্মতের মধ্যে চারটি বস্ত্ত রয়েছে জাহেলিয়াতের অংশ, যা তারা ছাড়েনি।
আভিজাত্য গৌরব, বংশের নামে তাচ্ছিল্য করা, নক্ষত্রের মাধ্যমে বৃষ্টি প্রার্থনা করা এবং শোক করা’।
[3] জাহেলী যুগের অন্যতম রীতি ছিল, পিতা-মাতার কাজের উপর বড়াই করা, মাসজিদুল হারামের তত্ত্বাবধানের দায়িত্বে গর্ব করা (তওবা ৯/১৯, ৫৫)।
ধনশালী ব্যক্তিদের সম্মানিত মনে করা (যুখরুফ ৪৩/৩১) এবং দরিদ্র ও দুর্বল শ্রেণীকে হীন মনে করা (আন‘আম ৬/৫২)। যেকোন কাজে শুভাশুভ নির্ধারণ করা ও ভাগ্য গণনা করা (জিন ৭২/৬) ইত্যাদি।
পক্ষান্তরে অনেক জাহেলী কবির মধ্যে তাওহীদের আক্বীদা ছিল। যেমন মু‘আল্লাক্বা খ্যাত কবি যুহায়ের বিন আবী সুলমা ও কবি লাবীদ বিন রাবী‘আহ প্রমুখ।
[4] কা‘বাগৃহে হজ্জ জারী ছিল। হারামের মাসগুলির পবিত্রতা বজায় ছিল। অদৃষ্টবাদের আধিক্য থাকলেও তাদের মধ্যে ক্বাযা ও ক্বদরের আক্বীদা মওজুদ ছিল। ইবরাহীমী দ্বীনের শিক্ষা ও ইবাদতের কিছু নমুনা মক্কা ও তার আশপাশে জাগরুক ছিল।
তাদের মধ্যে সততা, বিশ্বস্ততা, সাহসিকতা, আতিথেয়তা, প্রতিশ্রুতি রক্ষা প্রভৃতি অনন্য গুণাবলী অক্ষুণ্ণ ছিল।
[1]. তিরমিযী হা/৮৮৪; ইবনু হিশাম ১/৫৭; বায়হাক্বী, দালায়েলুন নবুঅত ২/১২৬; ‘হুম্স’ অর্থ কঠোর ধার্মিক। ‘ক্বাত্বীনুল্লাহ’ ও ‘আহলু বায়তিল্লাহ’ অর্থ আল্লাহ্র ঘরের বাসিন্দা। ‘আহলুল্লাহ’ অর্থ আল্লাহওয়ালা।
[2]. মুসলিম হা/৭১; বুখারী হা/৮৪৬; মিশকাত হা/৪৫৯৬।
[3]. বুখারী, ফৎহসহ হা/৩৮৫০, ৭/১৫৬; মুসলিম হা/৯৩৪।
[4]. কবি যুহায়ের বলেন,فَلاَ تَكْتُمُنَّ اللهَ مَا فِي نُفُوسِكُمْ + لِيَخْفَى وَمَهْمَا يُكْتَمِ اللهُ يَعْلَمِيُؤَخَّرْ فَيُوضَعْ فِي كِتَابٍ فَيُدَّخَرْ + لِيَوْمِ الحِسَابِ أَوْ يُعَجَّلْ فَيُنْقَمِ ‘অতএব (হে পরস্পরে সন্ধিকারী বনু ‘আবাস ও যুবিয়ান!) তোমাদের অন্তরে যা রয়েছে তা আল্লাহ থেকে অবশ্যই গোপন করো না।
কেননা যখনই তোমরা আল্লাহ থেকে গোপন করবে, তখনই তিনি তা জেনে যাবেন’। ‘অতঃপর তিনি সেটাকে পিছিয়ে দিবেন এবং আমলনামায় রেখে বিচার দিবসের জন্য জমা রাখবেন।
অথবা দ্রুত করা হবে এবং প্রতিশোধ নেওয়া হবে’ (মু‘আল্লাক্বা যুহায়ের বিন আবী সুলমা ২৭ ও ২৮ লাইন)। কবি লাবীদ বলেন, أَلاَ كلُّ شَيْء مَا خَلا اللهَ بَاطِلُ + وَكُلُّ نَعِيْمٍ لاَ مُحَالَةَ زَائِلُ ‘মনে রেখ, আল্লাহ ব্যতীত সকল বস্ত্তই বাতিল’ এবং সকল নে‘মত অবশ্যই বিদূরিত হবে।
তবে লাইনের দ্বিতীয় অংশটি লাবীদের নয় বলে অনেকে মত প্রকাশ করেন (দীওয়ানে লাবীদ; সিলসিলা যঈফাহ হা/৬৫০০; প্রথমাংশটি বুখারী হা/৩৮৪১; মুসলিম হা/২২৫৬; মিশকাত হা/৪৭৮৬)।
সামাজিক অবস্থাঃ
(ক) গোত্রীয় সমাজ ব্যবস্থা : আরবদের সামাজিক ব্যবস্থা ছিল গোত্রপ্রধান। যার কারণে বংশীয় ও আত্মীয়তার সম্পর্ককে খুবই গুরুত্বপূর্ণ মনে করা হত।
মারামারি ও হানাহানিতে জর্জরিত উক্ত সমাজে কেবল গোত্রীয় ঐক্যের সুদৃঢ় বন্ধনের উপর নির্ভর করেই তাদের টিকে থাকতে হত। ন্যায়-অন্যায় সবকিছু নির্ণীত হত গোত্রীয় স্বার্থের নিরিখে।
আজকালকের কথিত গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক সমাজব্যবস্থায় যে উৎকট দলতন্ত্র আমরা লক্ষ্য করছি, তা জাহেলী আরবের গোত্রীয় সমাজব্যবস্থার সঙ্গে অনেকটা তুলনীয়।
বরং অনেক ক্ষেত্রে তাদের চাইতে নিম্নতর অবস্থায় পৌঁছে গেছে। গোত্র সমূহের মধ্যে প্রায়ই যুদ্ধ-বিগ্রহ লেগে থাকত। সেকারণ তারা অধিক সংখ্যায় পুত্র সন্তান কামনা করত। অধিক সংখ্যক ভাই ও পুত্র সন্তানের মালিককে সবাই সমীহ করত।
যুদ্ধে পরাজিত হলে অন্যান্য সম্পদের সাথে নারীদের লুট করে নিয়ে যাওয়ার ভয়ে অথবা দরিদ্রতার কারণে অনেকে তাদের কন্যাসন্তানকে শিশুকালেই হত্যা করে ফেলত। তাদের কোন গোত্রীয় আর্থিক রিজার্ভ ছিল না।
যুদ্ধ শুরু হ’লে সবাই প্রয়োজনীয় ফান্ড গোত্রনেতার কাছে জমা দিত ও তা দিয়ে যুদ্ধের খরচ মেটাত। তবে পূর্ব থেকে ধর্মীয় রীতি চলে আসার কারণে তারা বছরে চারটি সম্মানিত মাসে (যুল-ক্বা‘দাহ, যুলহিজ্জাহ, মুহাররম ও রজব) যুদ্ধ-বিগ্রহ বন্ধ রাখতো।
এটা ছিল তাদের জন্য অতীব গুরুত্বপূর্ণ একটি ধর্মীয় রক্ষাকবচ। গোত্রনেতাগণ একত্রে বসে সামাজিক শান্তি ও শৃংখলা রক্ষা করা, কোন গোত্রের সাথে যুদ্ধ শুরু বা শেষ করা কিংবা সন্ধিচুক্তি সম্পাদন করা ইত্যাদি বিষয়ে আলোচনার মাধ্যমে নিষ্পত্তি করতেন।
মক্কার ‘দারুন নাদওয়া’ (دار الندوة) ছিল এজন্য বিখ্যাত।[1] তাদের মধ্যে মদ্যপানের ব্যাপক প্রচলন ছিল। যুদ্ধ ও পেশীশক্তিই ছিল বিজয় লাভের মানদন্ড। আরবের সামাজিক অবস্থাকে এক কথায় বলতে গেলে Might is Right তথা ‘জোর যার মুল্লুক তার’ নীতিতে পরিচালিত হ’ত।
আজকের বিশ্ব ব্যবস্থা তার চাইতে মোটেও উন্নত নয়। পাঁচটি ‘ভেটো’ ক্ষমতাধারী রাষ্ট্রই বলতে গেলে বিশ্ব শাসন করছে।
অর্থনৈতিক অবস্থা :
(খ) অর্থনৈতিক অবস্থা : ব্যবসা ছিল তাদের প্রধান অবলম্বন। ত্বায়েফ, সিরিয়া, ইয়ামন প্রভৃতি উর্বর ও উন্নত এলাকা ছাড়াও সর্বত্র পশু-পালন জনগণের অন্যতম প্রধান অবলম্বন ছিল।
উট ছিল বিশেষ করে দূরপাল্লার সফরের জন্য একমাত্র স্থল পরিবহন। গাধা, খচ্চর মূলতঃ স্থানীয় পরিবহনের কাজে ব্যবহৃত হ’ত। ঘোড়া ছিল যুদ্ধের বাহন। মক্কার ব্যবসায়ীরা শীতকালে ইয়ামনে ও গ্রীষ্মকালে সিরিয়ায় দূরপাল্লার ব্যবসায়িক সফর করত।
আর্থিক লেনদেনে সূদের প্রচলন ছিল। তারা চক্রবৃদ্ধি হারে পরস্পরকে সূদভিত্তিক ঋণ দিত। রাস্তা-ঘাটে প্রায়ই ব্যবসায়ী কাফেলা লুট হত। সেজন্য সশস্ত্র যোদ্ধাদল নিয়ে তারা রওয়ানা হত।
তবে কা‘বাগৃহের খাদেম হওয়ার সুবাদে মক্কার ব্যবসায়ী কাফেলা বিশেষভাবে সম্মানিত ছিল এবং সর্বত্র নিরাপদ থাকত। বছরের আট মাস লুটতরাজের ভয় থাকলেও হারামের চার মাসে তারা নিশ্চিন্তে ব্যবসা করত।
এই সময় ওকায, যুল-মাজায, যুল-মাজান্নাহ প্রভৃতি বড় বড় বাজারে বাণিজ্যমেলা ছাড়াও আরবের বিভিন্ন প্রান্তে আরও অনেকগুলি বড় বড় মেলা বসত। এইসব বাণিজ্য মেলায় প্রচুর বেচাকেনার মাধ্যমে ব্যবসায়ীরা লাভবান হত।
তাদের মধ্যে বস্ত্র, চর্ম ও ধাতব শিল্পের প্রচলন ছিল। ইয়ামন, হীরা, সিরিয়া প্রভৃতি অঞ্চল এইসব শিল্পে সমৃদ্ধ ছিল। তবে গৃহের আঙিনায় বসে সূতা কাটার কাজে অধিকাংশ আরব মহিলা নিয়োজিত থাকতেন। কোন কোন এলাকায় কৃষিকাজ হত।
ছোলা, ভুট্টা, যব ও আঙ্গুরের চাষ হ’ত। মক্কা-মদীনায় গমের আবাদ ছিল না। মু‘আবিয়া (রাঃ)-এর খেলাফতকালে প্রথম সিরিয়া থেকে মদীনায় গম রফতানী হয়। খেজুর বাগান ব্যাপক হারে দেখা যেত। খেজুর ছিল তাদের অন্যতম প্রধান উপজীবিকা।
তাদের কোন গোত্রীয় অর্থনৈতিক ফান্ড ছিল না। সেকারণ সমাজের লোকদের দারিদ্র্য ও রোগ-ব্যধি দূরীকরণে ও স্বাস্থ্যসেবার কোন সমন্বিত কর্মসূচী ও কর্মপরিকল্পনা তাদের ছিল না।
ফলে পারস্পরিক দান ও বদান্যতার উপরেই তাদের নির্ভর করতে হ’ত। নিখাদ পুঁজিবাদী অর্থনীতি চালু ছিল। যার ফলে সমাজে একদল উচ্চবিত্ত থাকলেও অধিকাংশ লোক ছিল বিত্তহীন।
সাধারণ অবস্থা ছিল এই যে, আরবদের সহায়-সম্পদ তাদের জীবনমান উন্নয়নে ব্যয়িত না হয়ে সিংহভাগই ব্যয়িত হ’ত যুদ্ধ-বিগ্রহের পিছনে। ফলে ক্ষুধা ও দারিদ্র্য ছিল তাদের নিত্যসঙ্গী। আরবীয় সমাজে উচ্চবিত্ত লোকদের মধ্যে মদ-জুয়া ইত্যাদির ব্যাপক প্রচলন ছিল।
সেখানে বিত্তহীনরা দাস ও দাসীরূপে বিক্রয় হ’ত ও মানবেতর জীবন যাপনে বাধ্য হত। কুরায়েশরা পরস্পরে ব্যবসায়ে জড়িত ছিল।
হাশেম বিন ‘আব্দে মানাফ গোত্রনেতাদের মধ্যে এই পারস্পরিক ব্যবসায়িক সম্পর্ক গড়ে তোলেন। যা রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর আবির্ভাবকালীন সময় পর্যন্ত অব্যাহত ছিল। যাকে ‘ঈলাফ’ (إيلاف) বলা হয়।
যারা শীতকালে ইয়ামনে ও গ্রীষ্মকালে শামে ব্যবসায়িক সফর করত। একথাটিই কুরআনে এসেছে সূরা কুরায়েশ-এ। তারা সমুদ্র পথে চীন ও হিন্দুস্থানেও ব্যবসা করত।
হাশেম বিন ‘আব্দে মানাফ তৎকালীন দুই বিশ্বশক্তি রোম ও পারস্য সম্রাটদের সাথে চুক্তিক্রমে তাদের দেশেও ব্যবসা পরিচালনা করেন। এভাবে মক্কার অর্থনীতির ভিত গড়ে ওঠে ব্যবসার উপরে।
অস্ত্র শিল্প ও আসবাবপত্র শিল্প ব্যতীত তেমন কোন শিল্প তাদের মধ্যে ছিল না। অর্থনীতির অন্য একটি ভিত্তি ছিল পশু পালন। যা ছিল আপামর জনসাধারণের নাগালের মধ্যে।
ব্যবসায়ী নেতারা সূদের ভিত্তিতে ঋণদান করত। ফলে সেখানে ধনী ও গরীবের মধ্যে পাহাড় প্রমাণ বৈষম্য সৃষ্টি হয়। মুষ্টিমেয় ধনিক শ্রেণী বিলাস-ব্যসনের মধ্যে বসবাস করলেও মক্কায় অধিকাংশ অধিবাসী ছিল নিম্নবিত্ত বা বিত্তহীন।
মক্কার নেতৃবৃন্দ ও ব্যবসায়ীগণ সারা আরবে সম্মানিত ছিলেন। কা‘বাগৃহের কারণে তাদের মর্যাদা সর্বত্র সুপ্রতিষ্ঠিত ছিল। সেই সাথে মক্কা ছিল সর্বদা বহিঃশক্তির হামলা থেকে সুরক্ষিত।
নারীদের অবস্থা
(গ) নারীদের অবস্থা তৎকালীন আরবে বিভিন্ন শ্রেণীর লোকজন বসবাস করত। সেখানকার অভিজাত শ্রেণীর লোকদের অবস্থা তুলনামূলকভাবে খুবই উন্নত ছিল।
পরিবারে পুরুষ ও মহিলাদের পারস্পরিক সম্পর্ক ছিল মর্যাদা ও ন্যায়ভিত্তিক ব্যবস্থার উপরে প্রতিষ্ঠিত। অভিজাত পরিবারের মহিলাদের মান-সম্মান অক্ষুণ্ণ রাখার ব্যাপারে সদা সতর্ক দৃষ্টি রাখা হত।
তাদের মর্যাদা হানিকর কোন অবস্থার উদ্ভব ঘটলে সঙ্গে সঙ্গে তরবারি কোষমুক্ত হয়ে যেত। মহিলাদের মর্যাদা এতই উঁচুতে ছিল যে, বিবদমান গোত্রগুলিকে একত্রিত করে সন্ধিচুক্তি সম্পাদনেও তারা সক্ষম হত।
পক্ষান্তরে তাদের উত্তেজিত বক্তব্যে ও কাব্য-গাথায় যেকোন সময় দুই গোত্রের মধ্যে যুদ্ধ বেঁধে যেতে পারত। ওহোদের যুদ্ধে আবু সুফিয়ানের স্ত্রী হিন্দা তার সাথী মহিলাদের নিয়ে মুসলিম বাহিনীর বিরুদ্ধে একাজটিই করেছিলেন।
তাদের মধ্যে বিবাহ পদ্ধতি ছিল অত্যন্ত উঁচু মানের। উভয় পক্ষের অভিভাবকগণের সম্মতি ও কনের স্বীকৃতি লাভের পর বর কনেকে নির্ধারিত মোহরানার বিনিময়ে বিয়ে করতে পারত।
বিয়েতে ও সন্তানের আকীকাতে সমাজনেতাদের দাওয়াত দিয়ে ধুমধামের সাথে অনুষ্ঠান করা তাদের সামাজিক রেওয়াজ ছিল।
সাধারণ ও দরিদ্র শ্রেণীর আরবদের মধ্যে চার ধরনের বিবাহ চালু ছিল।
এক ধরনের ছিল অভিজাত শ্রেণীর মত পারস্পরিক সম্মতি ও মোহরানার বিনিময়ে বিবাহ পদ্ধতি। কিন্তু বাকী তিনটি পদ্ধতিকে বিবাহ না বলে স্পষ্ট ব্যভিচার বলা উচিত। যা ভারতীয় হিন্দু সমাজে রাক্ষস বিবাহ, গান্ধর্ব্য বিবাহ ইত্যাদি নামে আধুনিক যুগেও চালু আছে বলে জানা যায়।
আরবীয় সমাজে স্বাধীনা ও দাসী দু’ধরনের নারী ছিল। স্বাধীনাগণ ছিলেন সম্মানিত। কিন্তু দাসীরা বাজার-ঘাটে বিক্রয় হ’ত। মনিবের দাসীবৃত্তিই ছিল তাদের প্রধান কাজ।
নৈতিক অবস্থা :
(ঘ) নৈতিক অবস্থা : উদার মরুচারী আরবদের মধ্যে নৈতিকতার ক্ষেত্রে দু’টি ধারা একত্রে পরিলক্ষিত হত। একদিকে যেমন তাদের মধ্যে মদ্যপান, ব্যভিচার, মারামারি ও হানাহানি লেগে থাকত।
অন্যদিকে তেমনি দয়া, উদারতা, সততা, পৌরুষ, সৎসাহস, ব্যক্তিত্ববোধ, সরলতা ও অনাড়ম্বরতা, দানশীলতা, আমানতদারী, মেহমানদারী, প্রতিজ্ঞা পরায়ণতা ইত্যাদি সদগুণাবলীর সমাবেশ দেখা যেত।
তাদের মধ্যে দুঃসাহসিকতা ও বেপরোয়া ভাবটা ছিল তুলনামূলকভাবে বেশী। তাদের মধ্যে যেমন অসংখ্য দোষ-ত্রুটি ছিল, তেমনি ছিল অনন্যসাধারণ গুণাবলী, যা অন্যত্র কদাচিৎ পাওয়া যেত।
তাদের সৎসাহস, আমানতদারী, সত্যবাদিতা, কাব্য প্রতিভা, স্মৃতিশক্তি, অতিথিপরায়ণতা ছিল কিংবদন্তীর মত। তাদের কাব্যপ্রিয়তা এবং উন্নত কাব্যালংকারের কাছে আধুনিক যুগের আরবী কবি-সাহিত্যিকরা বলতে গেলে কিছুই নয়।
তাদের স্মৃতিশক্তি এত প্রখর ছিল যে, একবার শুনলেই হুবহু মুখস্থ বলে দিত। বড় বড় ক্বাছীদা বা দীর্ঘ কবিতাগুলি তাদের মুখে মুখেই চালু ছিল। লেখাকে এজন্য তারা নিজেদের জন্য হীনকর মনে করত।
দুর্বল স্মৃতির কারণে আজকের বিশ্ব লেখাকেই অধিক গুরুত্ব দেয়। অথচ লেখায় ভুল হওয়া স্বাভাবিক। কিন্তু তৎকালীন আরবদের স্মৃতিতে ভুল কদাচিৎ হত। সম্ভবতঃ এই সব সদগুণাবলীর কারণেই বিশ্বনবীকে আল্লাহ মক্কাতে প্রেরণ করেন।
যাদের প্রখর স্মৃতিতে কুরআন ও হাদীছ অবিকৃত অবস্থায় নিরাপদ থাকে এবং পরবর্তীতে তা লিখিত আকারে সারা বিশ্বে প্রচারিত হয়। যদিও কুরআন ও হাদীছ লিখিতভাবেও তখন সংকলিত হয়েছিল।
উপরের আলোচনায় প্রতীয়মান হয় যে, পৃথিবীর কেন্দ্রস্থল আরব ভূখন্ডের মরুচারী মানুষেরা বিভিন্ন দুর্বলতার অধিকারী হ’লেও তাদের মধ্যে উন্নত মানবিক গুণাবলীর বিকাশ ঈর্ষণীয়ভাবে পরিদৃষ্ট হত।
আদি পিতা-মাতা আদম ও হাওয়ার অবতরণস্থল হওয়ার কারণে এই ভূখন্ড থেকেই মানব সভ্যতা ক্রমে পৃথিবীর অন্যান্য ভূখন্ডে বিস্তার লাভ করেছে।
এই ভূখন্ডে আরাফাত-এর না‘মান উপত্যকায় সৃষ্টির সূচনায় আল্লাহ পাক সমস্ত মানবকুলের নিকট হতে তাঁর প্রভুত্বের স্বীকৃতি ও তাঁর প্রতি আনুগত্যের শপথ গ্রহণ করেন।
[2] যা ‘আহ্দে আলাস্ত্ত’ নামে খ্যাত। একই সাথে তিনি সকল নবীর কাছ থেকে শেষনবী মুহাম্মাদ (ছাঃ)-এর উপরে ঈমান আনা ও তাঁকে সর্বতোভাবে সহযোগিতার অঙ্গীকার নেন (আলে ইমরান ৩/৮১)।
এই ভূখন্ডেই হাযার হাযার নবী ও রাসূলের আগমন ঘটেছে। এই ভূখন্ডেই আল্লাহর ঘর কা‘বাগৃহ এবং বায়তুল মুক্বাদ্দাস অবস্থিত। এই ভূখন্ড বাণিজ্যিক কারণে সারা বিশ্বের কেন্দ্রবিন্দু ছিল।
জান্নাতের ভাষা আরবী এই ভূখন্ডের কথিত ও প্রচলিত ভাষা ছিল। সহজ-সরল ও অনাড়ম্বর জীবনযাত্রা।
প্রখর স্মৃতিশক্তি এবং সততা ও আমানতদারীর অনুপম গুণাবলীর প্রেক্ষাপটে আরবভূমির কেন্দ্রবিন্দু মক্কাভূমির অভিজাত বংশ কা‘বাগৃহের তত্ত্বাবধায়ক ও রক্ষণাবেক্ষণকারীদের শ্রেষ্ঠ সন্তান মুহাম্মাদ বিন আব্দুল্লাহ (সঃ)-এর নিকটেই আল্লাহ মানবজাতির কল্যাণে প্রেরিত সর্বশেষ ও শ্রেষ্ঠতম নেয়ামত কুরআন ও সুন্নাহর পবিত্র আমানত সমর্পণ করেন। ফালিল্লা-হিল হাম্দ ওয়াল মিন্নাহ।
[1]. ‘দারুন নাদওয়া’ ছিল হারাম সংলগ্ন কুছাই বিন কেলাবের বাড়ী। বর্তমানে এটি মাসজিদুল হারামের মধ্যে শামিল হয়ে গেছে।
[2]. আ‘রাফ ৭/১৭২-১৭৩; আহমাদ হা/২৪৫৫; মিশকাত হা/১২১ ‘ঈমান’ অধ্যায় ‘তাক্বদীরে বিশ্বাস’ অনুচ্ছেদ।
মক্কা ও ইসমাঈল বংশ
মক্কায় প্রথম অধিবাসী ছিলেন মা হাজেরা ও তাঁর সন্তান ইসমাঈল। পরে সেখানে আসেন ইয়ামন থেকে ব্যবসায়ী কাফেলা বনু জুরহুম। তারা হাজেরার অনুমতিক্রমে যমযম কূপের পাশে বসতি স্থাপন করেন।
পরবর্তীতে ইসমাঈল তাদের বংশে বিয়ে করেন। অতঃপর ইবরাহীম ও ইসমাঈলের হাতে কা‘বাগৃহ নির্মিত হয়। অতঃপর ইসমাঈলের বংশধরগণই মক্কাভূমি ও পার্শ্ববর্তী এলাকাসমূহ আবাদ করেন। তাদের মাধ্যমেই সর্বত্র তাওহীদের দাওয়াত ছড়িয়ে পড়ে।
ইসমাঈল (আঃ) আজীবন স্বীয় বংশের নবী ও শাসক ছিলেন। তাঁর পরে তাঁর পুত্র ও বংশধরগণই মক্কা ও পার্শ্ববর্তী এলাকা শাসন করেন এবং কা‘বাগৃহের তত্ত্বাবধানের পবিত্র দায়িত্ব পালন করেন।
ইসমাঈল-পুত্র নাবেত (نَابِت)-এর বংশধরগণ উত্তর হেজায শাসন করেন। তাদের বংশধর ছিলেন ইয়াছরিবের আউস ও খাযরাজ গোত্র।
ইসমাঈলের অন্য পুত্র ক্বায়দার (قيدار)-এর বংশধরগণ মক্কায় বসবাস করেন এবং পরবর্তীতে তাদেরই অন্যতম বিখ্যাত নেতা ছিলেন ‘আদনান (عَدنان)। যিনি ছিলেন রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর ২১তম ঊর্ধ্বতন পুরুষ।
[1]. ইবনু হিশাম ১/১-২; ছফিউর রহমান মুবারকপুরী (১৩৬২-১৪২৭ হিঃ/১৯৪২-২০০৬ খৃঃ), আর-রাহীকুল মাখতূম (কুয়েত : ২য় সংস্করণ ১৪১৬/১৯৯৬ খৃঃ) পৃঃ ৪৮।
মক্কার অবস্থান
মক্কার অবস্থান মক্কাকে পৃথিবীর নাভিস্থল (وَسَطُ الْأَرْضِ) বলা হয়। কুরআনে একে ‘উম্মুল ক্বোরা’ (أُمُّ الْقُرَى) বা ‘আদি জনপদ’ বলা হয়েছে (আন‘আম ৬/৯২; শূরা ৪২/৭)। مَكَّة অর্থ ধ্বংসকারী। مَكَّ يَمُكُّ مَكًّا অর্থ ধ্বংস করা।
মক্কাকে মক্কা বলার কারণ দু’টি। এক- জাহেলী যুগে এখানে কোন যুলুম ও অনাচার টিকতে পারতনা। যেই-ই কোন যুলুম করত, সেই-ই ধ্বংস হয়ে যেত। এজন্য এর অন্য একটি নাম ছিল ‘না-সসাহ’ (النَّاسَّةَ) অর্থ বিতাড়নকারী, বিশুদ্ধকারী।
কোন রাজা-বাদশা যখনই একে ধ্বংস করতে গিয়েছে, সেই-ই ধ্বংস হয়েছে। এর অন্য একটি নাম হ’ল বাক্কা (بَكَّةٌ)। যার দু’টি অর্থ রয়েছে।
এক- بَكَّ يَبُكُّ بَكًّا اى كَسَرَ ভেঙ্গে দেওয়া। সেকারণেই বলা হয়, لِأَنَّهَا تَبُكُّ أَعْنَاقَ الْجَبَابِرَةِ إذَا أَحْدَثُوا فِيْهَا شَيْئًا ‘এটি প্রতাপশালী অহংকারীদের ঘাড় মটকিয়ে দেয়, যখন তারা এখানে কিছু অঘটন ঘটাতে চায়’।
দুই- এর অর্থ اِزْدَحَمَ ভিড় করা ও কান্নাকাটি করা। কেননা মানুষ এখানে এসে জমা হয় এবং আল্লাহর নিকট কান্নাকাটি করে’ (ইবনু হিশাম ১/১১৪)।
জাহেলী যুগে হামলাকারী কাফের নেতা ইয়ামনের খ্রিষ্টান গভর্ণর আবরাহাকে আল্লাহ সঙ্গে সঙ্গে ধ্বংস করেছেন। কিন্তু ইসলামী যুগে মুসলিম যালেমদের আল্লাহ সাথে সাথে ধ্বংস করেননি তাদের ঈমানের কারণে।
তাদের কঠিন শাস্তি পরকালে হবে, যদি নাকি তারা তওবা না করে মৃত্যুবরণ করে। আজও যদি কোন কাফের শক্তি কা‘বা ধ্বংস করতে চায়, সে আল্লাহর গযবে সাথে সাথেই ধ্বংস হয়ে যাবে ইনশাআল্লাহ।
যেমন আল্লাহ বলেন, أَوَلَمْ يَرَوْا أَنَّا جَعَلْنَا حَرَمًا آمِنًا وَيُتَخَطَّفُ النَّاسُ مِنْ حَوْلِهِمْ ‘তারা কি দেখেনা যে, আমরা হারামকে নিরাপদ করেছি। অথচ তাদের চতুষ্পার্শ্বে যারা আছে তারা উৎখাত হয়’ (আনকাবূত ২৯/৬৭)।
তিনি আরও বলেন, وَمَنْ يُرِدْ فِيْهِ بِإِلْحَادٍ بِظُلْمٍ نُذِقْهُ مِنْ عَذَابٍ أَلِيْمٍ ‘যে ব্যক্তি এখানে (হারামে) সীমালংঘনের মাধ্যমে পাপকার্যের সংকল্প করে, আমরা তাকে যন্ত্রণাদায়ক শাস্তির স্বাদ আস্বাদন করাবো’ (হজ্জ ২২/২৫)।
চারপাশে পাহাড় ঘেরা উপত্যকায় অবস্থিত মক্কা নগরী। পূর্ব দিকে আবু কুবাইস (أبو قُبَيس) পাহাড় এবং পশ্চিম দিকে কু‘আইক্বা‘আন (قُعَيْقَعان) পাহাড় নতুন চাঁদের মত মক্কাকে বেষ্টন করে রেখেছে। এর নিম্নভূমিতে কা‘বাগৃহ অবস্থিত।
যার চারপাশে কুরায়েশদের জনবসতি। নবচন্দ্রের দুই কিনারায় গরীব বেদুঈনদের আবাসভূমি। যারা যুদ্ধ-বিগ্রহে পটু ছিল।
কুরায়েশ বংশ কিনানাহর দিকে সম্পর্কিত।
যারা মক্কার অনতিদূরে বসবাস করত। এভাবে এখানকার অধিবাসীরা পরস্পরে সম্প্রীতির বন্ধনে আবদ্ধ থাকায় মক্কা একটি সুরক্ষিত দুর্গের শহরে পরিণত হয়। সেকারণ মক্কায় আগত কাফেলা সমূহ সর্বদা নিরাপদ থাকত।
এ বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা দ্রষ্টব্য : লেখক প্রণীত তাফসীরুল কুরআন ৩০তম পারা, সূরা ফীল, শিরোনাম : ‘সংশয় নিরসন’ পৃঃ ৪৮৯-৯০।
মক্কার সামাজিক অবস্থাঃ
খ্রিষ্টীয় পঞ্চম শতাব্দীর প্রথমভাগে কুছাই বিন কিলাব কুরায়েশ গোত্রনেতাদের জমা করে সমাজ ব্যবস্থাপনার একটা ভিত্তি দান করেন।
অতঃপর হারামের আশ-পাশের গাছ-গাছালি কেটে সেখানে পাথর দিয়ে বাড়ী-ঘর তৈরীর সূচনা করেন। যা মক্কাকে একটি নগরীর রূপ দান করে। ইতিপূর্বে এখানকার বৃক্ষ সমূহকে অতি পবিত্র মনে করা হ’ত এবং তা কখনোই কাটা হ’ত না।
কুছাই ছিলেন প্রথম নেতা, যিনি এখানকার বৃক্ষ কর্তন শুরু করেন। অতঃপর তিনি তার সন্তানদের নগরীর ব্যবস্থাপনায় বিভিন্ন দায়িত্ব প্রদান করেন। যেমন হিজাবাহ (الْحِجَابَةُ) অর্থ কা‘বা গৃহের তত্ত্বাবধান।
সিক্বায়াহ (السِّقَايَةُ) অর্থ হাজীদের জন্য পানি ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব পালন। রিফাদাহ (الرِّفَادَةُ) অর্থ হাজীদের আপ্যায়ন ও মেহমানদারী। এজন্য সকল গোত্রের নিকট থেকে নির্দিষ্টহারে চাঁদা নেওয়া হত।
যা দিয়ে অভাবগ্রস্ত হাজীদের আপ্যায়ন করা হ’ত। লেওয়া (اللِّوَاءُ) অর্থ যুদ্ধের পতাকা বহন করা। নাদওয়া (النَّدْوَةُ) অর্থ পরামর্শ সভা। যেখানে বসে পারস্পরিক পরামর্শের ভিত্তিতে সমাজের সমস্যাবলীর সুষ্ঠু সমাধান করা হত এবং সামাজিক ঐক্য বজায় রাখা হত।
কুছাই নিজেই এর দায়িত্বে ছিলেন এবং তিনি এর দরজাটি কা‘বামুখী করেন। বস্ত্ততঃপক্ষে দারুন নাদওয়া ছিল মক্কা নগররাষ্ট্রের পার্লামেন্ট স্বরূপ। কুছাই বিন কিলাব ছিলেন যার প্রেসিডেন্ট এবং প্রত্যেক গোত্রনেতা ছিলেন যার মন্ত্রীসভার সদস্য।
বহিরাগত যেসব ব্যবসায়ী মক্কায় ব্যবসার জন্য আসতেন, কুছাই তাদের কাছ থেকে দশ শতাংশ হারে চাঁদা নির্ধারণ করেন। যা মক্কা নগরীর সমৃদ্ধির অন্যতম উৎসে পরিণত হয়।
এভাবে কুছাই মক্কা নগরীকে একটি সুসংবদ্ধ সামাজিক ও অর্থনৈতিক ভাবে সমৃদ্ধ নগরীতে পরিণত করেন। পরবর্তীতেও যা অব্যাহত ছিল।
রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর আবির্ভাবকালে মক্কার নেতা ছিলেন তাঁর দাদা আব্দুল মুত্ত্বালিব বিন হাশেম এবং তাঁর মৃত্যুর পরে ছিলেন চাচা আবু ত্বালেব।
যমযম কূয়া ও মক্কার নেতৃত্ব
মক্কার প্রধান আকর্ষণ হ’ল যমযম কূয়া ও কা‘বাগৃহ। দু’টিই আল্লাহর অপূর্ব কুদরতের জ্বলন্ত নিদর্শন।
যমযম ও কা‘বাগৃহের সেবা ও তত্ত্বাবধান কার্যের মধ্যে যেমন তাদের উচ্চ মর্যাদা নিহিত ছিল, তেমনি উক্ত মর্যাদা লাভের প্রতিযোগিতাই ছিল তাদের মধ্যকার পারস্পরিক রেষারেষি ও হানাহানির অন্যতম প্রধান কারণ।
তৃষিত হাজেরা ও তার দুগ্ধপোষ্য সন্তান ইসমাঈলের স্বার্থে আল্লাহর হুকুমে সেখানে যমযম কূয়ার সৃষ্টি হয় (বুখারী হা/৩৩৬৪)।
পরবর্তীতে এই পানিকে কেন্দ্র করেই ইয়ামন থেকে আগত ব্যবসায়ী কাফেলা বনু জুরহুমের মাধ্যমে মক্কায় জনবসতি গড়ে উঠে। এরপর ইবরাহীম ও ইসমাঈলের মাধ্যমে আল্লাহর হুকুমে সেখানে কা‘বাগৃহ নির্মিত হয় (বাক্বারাহ ২/১২৫)।
ইসমাঈল তাদের মধ্যে বিবাহ করেন। অতঃপর তাঁর সন্তানেরা বংশ পরম্পরায় যমযম ও কা‘বার মর্যাদাপূর্ণ দায়িত্বে আসীন ছিলেন। কিন্তু পরবর্তীতে বনু জুরহুম সেখানে বিপর্যয় সৃষ্টি করে এবং কিছু হারামকে হালাল করে।
তারা বহিরাগতদের উপর যুলুম করে। এমনকি কা‘বার উদ্দেশ্যে প্রদত্ত উপঢৌকনাদি ভক্ষণ করে। ফলে আল্লাহ তাদের হাত থেকে দায়িত্ব ছিনিয়ে নেন এবং বনু বকর বিন ‘আবদে মানাত (عبد مناة) বিন কিনানাহ ও গুবশান বিন খোযা‘আহর মাধ্যমে তাদেরকে হটিয়ে দেন।
বনু জুরহুম মক্কা থেকে বিতাড়িত হয়ে ইয়ামনে ফিরে যাওয়ার সময় যমযম কূয়া বন্ধ করে দিয়ে যায়।
পরবর্তীতে বনু বকরকে হটিয়ে বনু খোয়া‘আহ মক্কার একক ক্ষমতায় আসে এবং তারা কয়েক যুগ ধরে উক্ত মর্যাদায় আসীন থাকে।
এ সময় কুরায়েশ বংশ বিচ্ছিন্ন ও বিভক্ত ছিল। পরে তারা কুছাই বিন কিলাবের নেতৃত্বে ঐক্যবদ্ধ হয় এবং মক্কার ক্ষমতায় আসে। কুছাই ছিলেন রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর পরদাদা হাশেমের দাদা।
কুছাই খোযা‘আহ গোত্রের শেষ নেতা হুলাইল বিন হুবশিইয়াহ (حُلَيْلُ بْنُ حُبْشِيَّةَ) এর কন্যা হুববা (حُبَّى)-কে বিবাহ করেন বিধায় তারা পরবর্তীতে সর্বদা বনু হাশেমের মিত্র ছিল এবং তারা রাসূল (সঃ)-কে তাদের ‘ভাগিনার সন্তান’ বলত।
তাছাড়া বনু খোযা‘আহ ধারণা করত যে, তাদের নেতা হুলাইল তার জামাতা কুছাইকে পরবর্তী নেতা হিসাবে অছিয়ত করে গেছেন (ইবনু হিশাম ১/১১৩-১৮)।
এভাবে মক্কার নেতৃত্বে ছিলেন প্রথমে বনু জুরহুম। অতঃপর বনু খুযা‘আহ। অতঃপর বনু কুরায়েশ। রাসূল (সঃ)-এর আবির্ভাবকালে কুরায়েশ বংশ মক্কার নেতৃত্বে ছিল।
অনুমান করা হয়ে থাকে যে, বনু জুরহুম ২১০০ বছর, বনু খুযা‘আহ ৩০০ বছর মক্কা শাসন করেন। তাদের পর থেকে কুরায়েশ বংশ মক্কা শাসন করে (আর-রাহীক্ব ২৮-২৯)।
পক্ষান্তরে বনু খোযা‘আহর হাতে ইতিপূর্বে বিতাড়িত বনু বকর সর্বদা রাসূল (সঃ)-এর বিরোধী জোটের মিত্র ছিল।
সেকারণ পরবর্তীতে বনু খোযা‘আহর উপর বনু বকরের হামলা ও হত্যাকান্ডের ফলেই হোদায়বিয়ার সন্ধি ভেঙ্গে যায় এবং মক্কা বিজয় ত্বরান্বিত হয়। কুরায়েশ বংশ ছিল বনু ইসমাঈলের শ্রেষ্ঠ শাখা এবং কুরায়েশ বংশের শ্রেষ্ঠ শাখা ছিল বনু হাশেম গোত্র।
আব্দুল মুত্ত্বালিবের স্বপ্নঃ
কুছাইয়ের পর পর্যায়ক্রমে যখন রাসূল (সঃ)-এর দাদা আব্দুল মুত্ত্বালিব মক্কার নেতা হন।
তিনি পরপর চার রাত্রি স্বপ্নে দেখেন যে, এক ব্যক্তি এসে তাঁকে কূয়া খনন করতে বলছে। চতুর্থ রাত্রিতে তাঁকে কূয়ার নাম ‘যমযম’ ও তার স্থান নির্দেশ করে দেওয়া হয়।
তখন আব্দুল মুত্ত্বালিব তাঁর একমাত্র পুত্র হারেছকে সাথে নিয়ে স্থানটি খনন করেন। এ সময় তার অন্যকোন পুত্র সন্তান জন্মলাভ করেনি। কুরায়েশদের সকল গোত্র এই মহান কাজে তাঁর সাথে শরীক হ’তে চায়।
তারা বলে যে, এটি পিতা ইসমাঈল-এর কূয়া। অতএব এতে আমাদের সবার অধিকার আছে। আব্দুল মুত্ত্বালিব বললেন, স্বপ্নে এটি কেবল আমাকেই খাছভাবে করতে বলা হয়েছে।
অতএব আমি তোমাদের দাবী মেনে নিতে পারি না’। তখন ঝগড়া মিটানোর জন্য তারা এক গণৎকার মহিলার কাছে বিচার দেওয়ার প্রস্তাব দেয়।
কিন্তু হেজায ও শামের মধ্যবর্তী উক্ত দূরবর্তী স্থানে পৌঁছার আগেই যখন গোত্রনেতারা পানির সংকটে পড়ে যায় এবং তৃষ্ণায় মৃত্যুর আশংকায় পতিত হয়ে নিজেরা নিজেদের কবর খুঁড়তে শুরু করে,
তখন আল্লাহর রহমতে আব্দুল মুত্ত্বালিবের উটের পায়ের তলার মাটি দিয়ে মিষ্ট পানি উথলে ওঠে। যা কওমের সকলে পান করে বেঁচে যায়।
এতে তারা কূয়ার উপরে আব্দুল মুত্ত্বালিবের মালিকানা সম্পর্কে নিশ্চিত হয়ে যায় এবং তারা সকলে মিলে তার নিকটেই এটি সোপর্দ করে। ঘটনাটি খুবই প্রসিদ্ধ ছিল যা হযরত আলী (রাঃ) হ’তে ‘হাসান’ সনদে ইবনু ইসহাক বর্ণনা করেছেন।
এভাবে পানির মালিকানার সাথে সাথে বনু হাশিমের উচ্চ মর্যাদা ও নেতৃত্ব সকলের অন্তরে দৃঢ় আসন লাভ করে।
তারা সবাই আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করেন এবং গণৎকার মহিলার কাছে না গিয়েই ফিরে আসেন। যমযম কূপের মালিকানা নিয়ে আর কখনোই ঝগড়া করবেন না বলে তারা প্রতিজ্ঞা করেন।
এরপর থেকে হাজীদের পানি পান করানো (সিক্বায়াহ) ও তাদের খাওয়ানো সহ আপ্যায়ন (রিফাদাহ) করার মর্যাদাপূর্ণ দায়িত্ব স্থায়ীভাবে বনু হাশেম-এর উপর ন্যস্ত হয়।
উল্লেখ্য যে, ইতিপূর্বে কুরায়েশগণ কা‘বা থেকে দূরে বিভিন্ন কূপ খনন করে পানির চাহিদা মিটাতেন (ইবনু হিশাম ১/১৪২-৪৭)।
বনু জুরহুম মক্কা ছেড়ে চলে যাওয়ার সময় যমযম কূয়ায় দু’টি সোনার হরিণ, বর্ম, তরবারি ইত্যাদি ফেলে যায়।
অতঃপর উক্ত তরবারি উঠিয়ে আব্দুল মুত্ত্বালিব কা‘বাগৃহের দরজা ঢালাই করেন এবং হরিণ দু’টিকে দরজার সামনে রেখে দেন বলে যে সব কথা চালু আছে, তা বিশুদ্ধভাবে প্রমাণিত নয়।
[1]. ইবনু হিশাম ১/১৪২-৪৫, সনদ জাইয়িদ খবর ছহীহ, তাহকীক ইবনু হিশাম ক্রমিক ১৪০।
[2]. ইবনু হিশাম ১/১৪৭; বর্ণনাটি যঈফ, তাহকীক ইবনু হিশাম ক্রমিক ১৪৪; সীরাহ ছহীহাহ ১/৯২; আর-রাহীক্ব ২৮ পৃঃ।
আব্দুল মুত্ত্বালিবের মানতঃ
আল্লাহর হুকুমে যমযম কূয়া খনন ও তার তত্ত্বাবধায়কের উচ্চ মর্যাদা লাভের পর কৃতজ্ঞতা স্বরূপ আব্দুল মুত্ত্বালিব আল্লাহর নামে মানত করেন যে,
যদি আল্লাহ তাঁকে দশটি পুত্রসন্তান দান করেন এবং তারা সবাই বড় হয়ে নিজেদের রক্ষা করার মত বয়স পায়, তাহ’লে তিনি তাদের একজনকে আল্লাহর সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে যবহ করবেন। অতঃপর লটারীতে বারবার আব্দুল্লাহর নাম উঠতে থাকে।
অথচ সেই-ই ছিল তাঁর সবচেয়ে প্রিয় সন্তান। তখন তিনি বললেন, হে আল্লাহ! সে অথবা একশ’ উট। এরপর লটারীতে পরপর তিনবার একশ’ উট উঠে আসে। তখন তিনি তা দিয়ে মানত পূর্ণ করেন।
[1] হাকীম বিন হেযাম (রাঃ) বর্ণিত যঈফ হাদীছে এসেছে যে, এটি ছিল রাসূল (ছাঃ) জন্মের পাঁচ বছর পূর্বের ঘটনা’ (হাকেম হা/৬০৪৩, ৩/৫৪৯ পৃঃ)।
উক্ত ঘটনাটি প্রমানিত নয়। তবুও যদি সত্য হয়, তাহ’লে এতে ইঙ্গিত রয়েছে যে, আল্লাহ আব্দুল মুত্ত্বালিবের মানত পরিবর্তনের মাধ্যমে আব্দুল্লাহর ঔরসে তাঁর শেষনবীর জন্মকে নিরাপদ করেছেন।
ফালিল্লাহিল হাম্দ। নিঃসন্দেহে আল্লাহর কৌশল বুঝা বান্দার পক্ষে আদৌ সম্ভব নয়।
উল্লেখ্য যে, الذَّبِيْحَيْنِ أَنَا اِبْنُ ‘আমি দুই যবীহ-এর সন্তান’ অর্থাৎ যবীহ ইসমাঈল ও যবীহ আব্দুল্লাহর সন্তান’ বলে যে হাদীছ প্রচলিত আছে, তার কোন ভিত্তি নেই (لاَ أَصْلَ لَهُ)।[2]
[1]. ইবনু হিশাম ১/১৫১-৫৫; বর্ণনাটি যঈফ, তাহকীক ইবনু হিশাম ক্রমিক ১৪৮। ড. আকরাম যিয়া ঘটনাটিকে ইবনু আববাস থেকে ‘ছহীহ’ বলেছেন (সীরাহ ছহীহাহ ১/৯২-৯৩)। কিন্তু সেটি প্রমাণিত হয়নি।
কেননা ‘আব্দুল মুত্ত্বালিবের মানত’ শিরোনামে ইবনু ইসহাক বলেন, فِيمَا يَزْعُمُونَ وَاَللهُ أَعْلَمُ ‘যেমন তারা ধারণা করেন। আল্লাহ সর্বাধিক অবগত’ (ইবনু হিশাম ১/১৫১)। এতেই বুঝা যায়, ঘটনাটি ভিত্তিহীন।
[2]. হাকেম হা/৪০৪৮, ২/৫৫৯; সিলসিলা যঈফাহ হা/৩৩১।
মক্কার ধর্মীয় অবস্থাঃ
কা‘বাগৃহের কারণে মক্কা ছিল সমগ্র আরব ভূখন্ডের ধর্মীয় কেন্দ্রবিন্দু এবং সম্মান ও মর্যাদায় শীর্ষস্থানীয়। সেকারণ খ্রিষ্টান রাজারা এর উপরে দখল কায়েম করার জন্য বারবার চেষ্টা করত।
এক সময় ইয়ামনের খ্রিষ্টান নরপতি আবরাহা নিজ রাজধানী ছান‘আতে স্বর্ণ-রৌপ্য দিয়ে কা‘বাগৃহের আদলে একটি সুন্দর গৃহ নির্মাণ করেন এবং সবাইকে সেখানে হজ্জ করার নির্দেশ জারী করেন। কিন্তু জনগণ তাতে সাড়া দেয়নি। বরং কে একজন গিয়ে তার ঐ নকল কা‘বাগৃহে।
পায়খানা করে আসে। এতে ক্ষিপ্ত হয়ে তিনি প্রায় ৬০ হাযার সৈন্য ও হস্তীবাহিনী নিয়ে মক্কায় অভিযান করেন কা‘বাগৃহকে ধ্বংস করার জন্য।
অবশেষে আল্লাহর গযবে তিনি নিজে তার সৈন্য-সামন্ত সহ ধ্বংস হয়ে যান। এতে মক্কার সম্মান ও মর্যাদা আরও বৃদ্ধি পায় এবং এ ঘটনা বণিকদের মাধ্যমে সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ে।
শেষনবী হযরত মুহাম্মাদ (সঃ)-এর জন্মের মাত্র ৫০ বা ৫৫ দিন পূর্বে এই অলৌকিক ঘটনা ঘটে। বস্ত্ততঃ এটা ছিল শেষনবীর আগমনের আগাম শুভ কেত (الْإِرْهَاصُ) মাত্র।
ইবনু আববাস (রাঃ) বলেন, উক্ত ঘটনার পরে মক্কাবাসীগণ দশ বছর যাবৎ পূর্ণ তাওহীদবাদী ছিল এবং মূর্তিপূজার শিরক পরিত্যাগ করেছিল’।
[1] সমগ্র আরব উপদ্বীপে মক্কা ছিল বৃহত্তম নগরী এবং মক্কার অধিবাসী ও ব্যবসায়ীদের মর্যাদা ছিল সবার উপরে। হারাম শরীফের উচ্চ মর্যাদার কারণে তাদের মর্যাদা আপামর জনগণের মধ্যে এমনভাবে প্রতিষ্ঠিত ছিল যে, চোর-ডাকাতেরাও তাদেরকে সমীহ করত।
এটাই যেখানে বাস্তবতা, সেখানে এই যুগটিকে ‘জাহেলী যুগ’ (الْأَيَّامُ الْجَاهِلِيَّةُ) কেন বলা হয় ?
এর কারণ সম্ভবতঃ এটাই ছিল যে, তারা ইবরাহীম (আঃ)-এর অনুসারী এবং তাওহীদপন্থী হওয়া সত্ত্বেও শিরকে লিপ্ত হয়েছিল।
তারা আল্লাহর বিধান সমূহকে অগ্রাহ্য করেছিল এবং খোদ আল্লাহর ঘরেই মূর্তিপূজার মত নিকৃষ্টতম শিরকের প্রবর্তন করেছিল। তারা শেষনবী মুহাম্মাদ (সঃ)-কে চিনতে পেরেও তাঁকে অস্বীকার করেছিল।
নিঃসন্দেহে এটা ছিল তাদের সবচেয়ে বড় জাহেলিয়াত ও সবচেয়ে বড় মূর্খতা। আর একারণেই ‘জ্ঞানের পিতা’ আবুল হাকাম-কে ‘মূর্খতার পিতা’ আবু জাহল লকব দেওয়া হ’ল।
[2] বস্তুতঃ ইসলামের বিরোধী যা কিছু, সবই জাহেলিয়াত। আল্লাহ বলেন, أَفَحُكْمَ الْجَاهِلِيَّةِ يَبْغُونَ وَمَنْ أَحْسَنُ مِنَ اللهِ حُكْمًا لِقَوْمٍ يُوقِنُونَ ‘তবে কি তারা জাহেলিয়াতের বিচার-ফায়ছালা কামনা করে ?
অথচ দৃঢ় বিশ্বাসীদের নিকট আল্লাহর চাইতে উত্তম ফায়ছালাকারী আর কে আছেম?
(মায়েদাহ ৫/৫০)। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, مَنْ دَعَا بِدَعْوَى الْجَاهِلِيَّةِ فَهُوَ مِنْ جُثَاءِ جَهَنَّمَ ‘যে ব্যক্তি জাহেলিয়াতের দিকে মানুষকে আহবান করে, সে ব্যক্তি জাহান্নামীদের দলভুক্ত’।
উল্লেখ্য যে, জাহেলী আরবী সাহিত্যের ইতিহাস ইসলাম আগমনের পূর্বে দেড়শ’ বছরের বেশী নয় (সীরাহ ছহীহাহ ১/৭৯)। এক্ষণে আমরা মক্কায় জাহেলিয়াত প্রসারের ইতিবৃত্ত সংক্ষেপে বর্ণনা করব।-
[1]. হাকেম হা/৩৯৭৫; সিলসিলা ছহীহাহ হা/১৯৪৪।
[2]. বুখারী, ফৎহসহ হা/৩৯৫০-এর আলোচনা, ‘মাগাযী’ অধ্যায় ২ অনুচ্ছেদ ৭/৩৩১ পৃঃ।
[3]. আহমাদ হা/১৭২০৯; তিরমিযী হা/২৮৬৩; মিশকাত হা/৩৬৯৪; সনদ ছহীহ।
শিরকের প্রচলনঃ
মক্কার বাসিন্দারা মূলতঃ হযরত ইসমাঈল (আঃ)-এর বংশধর ছিল এবং তারা জন্মগতভাবেই তাওহীদ, রিসালাত ও আখেরাতে বিশ্বাসী ছিল।
তারা কা‘বাগৃহকে যথার্থভাবেই আল্লাহর গৃহ বা বায়তুল্লাহ বলে বিশ্বাস করত এবং তার রক্ষণাবেক্ষণ ও তত্ত্বাবধান করত।
তারা এখানে নিয়মিতভাবে ত্বাওয়াফ, সাঈ তথা হজ্জ ও ওমরাহ করত এবং বহিরাগত হাজীদের নিরাপত্তা ও পানি সরবরাহের দায়িত্ব পালন করত।
কিন্তু দীর্ঘদিন যাবৎ কোন নবী না আসায় শয়তানী প্ররোচনায় তাদের সমাজনেতা ও ধনিক শ্রেণীর অনেকে পথভ্রষ্ট হয়ে যায় এবং এক সময় তাদের মাধ্যমেই মূর্তিপূজার শিরকের প্রচলন হয়, যেভাবে ইতিপূর্বে নূহ (আঃ)-এর কওমের মধ্যে হয়েছিল।
(১) কুরায়েশ বংশের বনু খোযা‘আহ গোত্রের সরদার ‘আমর বিন লুহাই (عَمرو بن لُحَى بن عامر الْخُزاعى) অত্যন্ত ধার্মিক, দানশীল ও দরবেশ স্বভাবের লোক ছিলেন।
লোকেরা তাকে গভীরভাবে শ্রদ্ধা করত এবং তার প্রতি অন্ধভক্তি পোষণ করত। তাকে আরবের শ্রেষ্ঠ আলেম ও অলি-আউলিয়াদের মধ্যে গণ্য করা হ’ত।
অতএব শয়তান তাকেই বেছে নিল তার কার্যসিদ্ধির জন্য। একবার তিনি শামের ‘বালক্বা’ (الْبَلْقَاء) অঞ্চলের ‘মাআব’ (مَآب) নগরীতে গিয়ে দেখেন যে, সেখানকার লোকেরা জমকালো আয়োজনের মাধ্যমে ‘হুবাল’ (هُبَل) মূর্তির পূজা করে।
তিনি তাদেরকে এর কারণ জিজ্ঞেস করলে তারা বলে যে, আমরা এই মূর্তির অসীলায় বৃষ্টি প্রার্থনা করলে বৃষ্টি হয় এবং সাহায্য প্রার্থনা করলে সাহায্য পাই’। এরা ছিল আমালেক্বা গোত্রের লোক এবং ইমলীক্ব বিন লাবেয বিন সাম বিন নূহ-এর বংশধর।
আমর ভাবলেন অসংখ্য নবী-রাসূলের জন্মভূমি ও কর্মভূমি এই শামের ধার্মিক লোকেরা যখন ‘হোবল’ মূর্তির অসীলায় বৃষ্টি প্রার্থনা করে, তখন আমরাও এটা করলে উপকৃত হব।
ফলে বহু মূল্যের বিনিময়ে আমর একটা হোবল মূর্তি খরীদ করে নিয়ে গেলেন এবং মক্কার নেতাদের রাযী করিয়ে কা‘বাগৃহে স্থাপন করলেন। কথিত আছে যে, একটা জিন আমরের অনুগত ছিল।
সেই-ই তাকে খবর দেয় যে, নূহ (আঃ)-এর সময়কার বিখ্যাত অদ, সুওয়া‘, ইয়াগূছ, ইয়া‘ঊক্ব, নাসর (নূহ ৭১/২৩) প্রতিমাগুলি জেদ্দার অমুক স্থানে মাটির নীচে প্রোথিত আছে। আমর সেখানে গিয়ে সেগুলো উঠিয়ে এনে তেহামায় রেখে দিলেন।
অতঃপর হজ্জ-এর মওসুমে সেগুলিকে বিভিন্ন গোত্রের হাতে সমর্পণ করলেন। এভাবে আমর ছিলেন প্রথম ব্যক্তি, যিনি ইসমাঈল (আঃ)-এর দ্বীনে পরিবর্তন আনেন এবং তাওহীদের বদলে শিরকের প্রবর্তন করেন (আর-রাহীক্ব ৩৫ পৃঃ)।
অতঃপর বনু ইসমাঈলের মধ্যে মূর্তিপূজার ব্যাপক প্রসার ঘটে। নূহ (আঃ)- এর কওমের রেখে যাওয়া অদ, সুওয়া‘, ইয়াগূছ, ইয়া‘ঊক্ব, নাস্র (নূহ ৭১/২৩) প্রভৃতি মূর্তিগুলি এখন ইবরাহীমের বংশধরগণের দ্বারা পূজিত হ’তে থাকে।
যেমন- বনু হুযায়েল কর্তৃক সুওয়া‘ (سُوَاع), ইয়ামনের বনু জুরাশ কর্তৃক ইয়াগূছ (يَغُوث), বনু খায়ওয়ান কর্তৃক ইয়া‘ঊক্ব (يَعُوق), যুল-কুলা‘ কর্তৃক নাসর (نَسْر), কুরায়েশ ও বনু কেনানাহ কর্তৃক হুবাল (هُبَل) ও উযযা (العُزَّى), ত্বায়েফের বনু ছাক্বীফ কর্তৃক লাত (اللاَّت),
মদীনার আউস ও খাযরাজ কর্তৃক মানাত (مَنَاة), বনু ত্বাঈ কর্তৃক ফিল্স (فِلْسُ), ইয়ামনের হিমইয়ার গোত্র কর্তৃক রিয়াম (رِيَام), দাউস ও খাছ‘আম গোত্র কর্তৃক যুল-কাফফায়েন (ذُو الْكَفَّيْن) ও যুল-খালাছাহ (ذُو الْخَلَصَة) প্রভৃতি মূর্তি সমূহ পূজিত হ’তে থাকে (ইবনু হিশাম ১/৭৭-৮৭)।
এভাবে ক্রমে আরবের ঘরে ঘরে মূর্তিপূজার প্রসার ঘটে। ফলে মক্কা বিজয়ের দিন রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) কা‘বাগৃহের ভিতরে ও চারপাশে ৩৬০টি মূর্তি দেখতে পান। তিনি সবগুলোকে ভেঙ্গে গুঁড়িয়ে দেন ও কা‘বাগৃহ পানি দিয়ে ধুয়ে ছাফ করে ফেলেন।
রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেন, ‘আমার সম্মুখে (স্বপ্নে) জাহান্নামকে পেশ করা হ’ল, ... অতঃপর আমাকে দেখানো হ’ল ‘আমর বিন ‘আমের আল-খুযাঈকে। জাহান্নামে সে তার নাড়ী-ভুঁড়ি টেনে বেড়াচ্ছে।
এ ব্যক্তিই প্রথম তাদের উপাস্যদের নামে উট ছেড়ে দেওয়ার রেওয়াজ চালু করেছিল (যা লোকেরা রোগ আরোগ্যের পর কিংবা সফর থেকে আসার পর তাদের মূর্তির নামে ছেড়ে দিত)। ঐসব উট সর্বত্র চরে বেড়াত। কারু ফসল নষ্ট করলেও কিছু বলা যেত না বা তাদের মারা যেত না’।
(২) তারা মূর্তির পাশে বসে তাকে উচ্চকণ্ঠে আহবান করত ও তাদের অভাব মোচনের জন্য অনুনয়-বিনয় করে প্রার্থনা জানাতো।
তারা ধারণা করত যে, এই মূর্তি তাদেরকে আল্লাহর নৈকট্যশীল করবে (যুমার ৩৯/৩) এবং তাদের জন্য আল্লাহর নিকটে সুফারিশ করবে (ইউনুস ১০/১৮)।
(৩) তারা মূর্তির উদ্দেশ্যে হজ্জ করত, ত্বাওয়াফ করত, তার সামনে নত হ’ত ও সিজদা করত। ত্বাওয়াফের সময় তারা শিরকী তালবিয়াহ পাঠ করত।
لَبَّيْكَ لاَ شَرِيكَ لَكَ إِلاَّ شَرِيكًا هُوَ لَكَ تَمْلِكُهُ وَمَا مَلَكَ ‘হে আল্লাহ! আমি হাযির। তোমার কোন শরীক নেই, কেবল ঐ শরীক যা তোমার জন্য রয়েছে। তুমি যার মালিক এবং সে যা কিছুর মালিক)।
মুশরিকরা ‘লাববাইকা লা শারীকা লাকা’ বলার পর রাসূল (সঃ) তাদের উদ্দেশ্যে ক্বাদ ক্বাদ (থামো থামো) বলতেন।
এজন্যেই আল্লাহ বলেছেন, وَمَا يُؤْمِنُ أَكْثَرُهُمْ بِاللهِ إِلاَّ وَهُمْ مُشْرِكُونَ ‘তাদের অধিকাংশ আল্লাহকে বিশ্বাস করে।
অথচ সেই সাথে শিরক করে’ (ইউসুফ ১২/১০৬)।
(৪) তারা মূর্তির জন্য নযর-নেয়ায নিয়ে আসত এবং মূর্তির নামে কুরবানী করত (মায়েদাহ ৫/৩)।
(৫) তারা মূর্তিকে খুশী করার জন্য গবাদিপশু ও চারণক্ষেত্র মানত করত। যাদেরকে কেউ ব্যবহার করতে পারত না (আন‘আম ৬/১৩৮-১৪০)।
(৬) তারা তাদের বিভিন্ন কাজের ভাল-মন্দ ফলাফল ও শুভাশুভ নির্ণয়ের জন্য বিভিন্ন প্রকারের তীর ব্যবহার করত (মায়েদাহ ৫/৯০-৯১)। যাতে হ্যাঁ, না, ভাল, মন্দ ইত্যাদি লেখা থাকত। হোবল দেবতার খাদেম সেগুলো একটি পাত্রের মধ্যে ফেলে তাতে ঝাঁকুনি দিয়ে তীরগুলি ঘুলিয়ে ফেলত।
অতঃপর যে তীরটা বেরিয়ে আসত, সেটাকেই তারা ভাগ্য মনে করত এবং সে অনুযায়ী কাজ করত।
(৭) এতদ্ব্যতীত তারা জ্যোতিষীদের কথা বিশ্বাস করত এবং বিশেষ বিশেষ নক্ষত্রকে মঙ্গলামঙ্গলের কারণ মনে করত।
(৮) তারা পাখি উড়িয়ে দিয়ে বা রেখা টেনে কাজের শুভাশুভ ও ভাল-মন্দ নির্ধারণ করত এবং পাখি ডাইনে গেলে শুভ ও বামে গেলে অশুভ ধারণা করত।
[5] তারা ফেরেশতাদেরকে ‘আল্লাহর কন্যা’ বলত এবং জিনদের সাথে আল্লাহর আত্মীয়তা সাব্যস্ত করত (ছাফফাত ৩৭/১৫০-৫২, ১৫৮-৫৯)। তারা নিজেদের জন্য পুত্রসন্তান ও আল্লাহর জন্য কন্যাসন্তান নির্ধারণ করত (নাজম ৫৩/২১-২২)।
[1]. ইবনু হিশাম ১/৭৭। ভাষ্যকার সুহায়লী বলেন, বলা হয়ে থাকে যে, আমরই প্রথম কা‘বাগৃহে মূর্তি পূজার সূচনা করেন।
এটি তখনকার ঘটনা, যখন বনু জুরহুমকে বিতাড়িত করে বনু খুযা‘আহ মক্কার উপরে দখল কায়েম করে। আমর বিন লুহাই এ সময় আরবদের নিকট রব-এর মর্যাদা লাভ করেন।
তিনি ধর্মীয় বিধান হিসাবে যেটাই করতেন, লোকেরা সেটাকেই গ্রহণ করত। তিনি হজ্জের মৌসুমে লোকদের খানা-পিনা করাতেন ও বস্ত্র প্রদান করতেন।
কখনো কখনো এ মৌসুমে দশ হাযার উট যবেহ করতেন ও দশ হাযার জোড়া বস্ত্র দান করতেন। সেখানে একটি পাথর ছিল। ত্বায়েফের ছাক্বীফ গোত্রের জনৈক ব্যক্তি তার উপরে হাজীদের জন্য ছাতু মাখাতেন।
সেকারণ উক্ত পাথরটির নাম হয় ‘ছাতু মাখানোর পাথর’ (صَخْرَةُ اللاَّت)। পরে ঐ লোকটি মারা গেলে আমর বিন লুহাই বলেন, লোকটি মরেনি।
বরং পাথরের মধ্যে প্রবেশ করেছে। অতঃপর তিনি লোকদের পাথরটিকে পূজা করতে বলেন। লোকেরা তার উপরে একটি ঘর তৈরী করে এর নাম দেয় ‘লাত’ (ইবনু হিশাম ১/৭৭ টীকা-২)।
এভাবেই ‘লাত’ প্রতিমার পূজা চালু হয়। যা পরে ত্বায়েফে স্থানান্তরিত হয় এবং ছাক্বীফ গোত্র মুসলমান হওয়ার পরে যা গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়’ (দ্রঃ ‘ছাক্বীফ প্রতিনিধি দল’) ।
[2]. বুখারী হা/৩৫২১; মুসলিম হা/৯০৪, ২৮৫৬; মিরক্বাত শরহ মিশকাত হা/৫৩৪১; সীরাহ ছহীহাহ ১/৮৩। ইনিই ছিলেন ‘আমর বিন লুহাই বিন ‘আমের, যিনি সর্বপ্রথম কা‘বাগৃহে ‘হোবল’ মূর্তির পূজা শুরু করেন (ইবনু হিশাম ১/৭৬)।
[3]. মুসলিম হা/১১৮৫, আব্দুল্লাহ ইবনু আববাস (রাঃ) হ’তে; মিশকাত হা/২৫৫৪ ‘ইহরাম ও তালবিয়াহ’ অনুচ্ছেদ।
পক্ষান্তরে ইসলামী তালবিয়াহ হ’ল, لَبَّيْكَ اللَّهُمَّ لَبَّيْكَ لَبَّيْكَ لاَ شَرِيكَ لَكَ لَبَّيْكَ إِنَّ الْحَمْدَ وَالنِّعْمَةَ لَكَ وَالْمُلْكَ لاَ شَرِيكَ لَكَ ‘আমি হাযির হে আল্লাহ আমি হাযির। আমি হাযির। তোমার কোন শরীক নেই, আমি হাযির।
নিশ্চয়ই যাবতীয় প্রশংসা, অনুগ্রহ ও সাম্রাজ্য সবই তোমার; তোমার কোন শরীক নেই’ (বুখারী হা/৫৯১৫; মুসলিম হা/২৮৬৮)। দ্রঃ ‘হজ্জ ও ওমরাহ’ বই ৫৪ পৃঃ। বর্তমান যুগে বহু মুসলমান কবরে সিজদা করে ও কবরবাসীর নিকটে পানাহ চায়।
অতঃপর মসজিদে গিয়ে ছালাত আদায় করে। একই সঙ্গে কবরপূজা ও আল্লাহ্র ইবাদত। যা স্পষ্ট শিরক এবং যা জাহেলী আরবের মুশরিকদের অনুকরণ মাত্র।
[4]. বুখারী হা/৮৪৬; মুসলিম হা/৭৩; মিশকাত হা/৪৫৯৬-৯৭।
[5]. মুসলিম হা/৫৩৭; মিশকাত হা/৪৫৯২।
বিদ‘আতের প্রচলনঃ
মূর্তিপূজা সত্ত্বেও তারা ধারণা করত যে, তারা দ্বীনে ইবরাহীমের উপরে সঠিকভাবে কায়েম আছে।
কেননা ‘আমর বিন লুহাই তাদের বুঝিয়েছিলেন যে, এগুলি ইবরাহীমী দ্বীনের বিকৃতি নয়, বরং ভাল কিছুর সংযোজন বা ‘বিদ‘আতে হাসানাহ’ মাত্র। এজন্য তিনি বেশকিছু ধর্মীয় রীতি-নীতি চালু করেছিলেন।
যেমন-(১) তারা হজ্জের মওসুমে ‘মুযদালিফায়’ অবস্থান করত, যা ছিল হারাম এলাকার অভ্যন্তরে।
হারামের বাইরে হওয়ার কারণে তারা আরাফাতের ময়দানে যেত না বা সেখান থেকে মক্কায় ফিরে আসা অর্থাৎ ত্বাওয়াফে এফাযাহ করত না। যা ছিল হজ্জের সবচেয়ে বড় রুকন। তারা মুযদালেফায় অবস্থান করত ও সেখান থেকে মক্কায় ফিরে আসত।
সেজন্য আল্লাহ নির্দেশ দেন, ثُمَّ أَفِيْضُواْ مِنْ حَيْثُ أَفَاضَ النَّاسُ ‘অতঃপর তোমরা ঐ স্থান থেকে ফিরে এসো ত্বাওয়াফের জন্য, যেখান থেকে লোকেরা ফিরে আসে (অর্থাৎ আরাফাত থেকে) (বাক্বারাহ ২/১৯৯)
(২) তারা নিজেরা ধর্মীয় বিধান রচনা করেছিল যে, বহিরাগত হাজীগণ মক্কায় এসে প্রথম ত্বাওয়াফের সময় তাদের পরিবেশিত ধর্মীয় পোষাক (ثِيَابُ الْحُمْس) পরিধান করবে। সম্ভবতঃ এটা তাদের অর্থনৈতিক স্বার্থদুষ্ট বিদ‘আত ছিল।
যদি কেউ (আর্থিক কারণে বা অন্য কারণে) তা সংগ্রহে ব্যর্থ হয়, তবে পুরুষেরা সম্পূর্ণ উলঙ্গ হয়ে এবং মেয়েরা সব কাপড় খুলে রেখে কেবল ছোট্ট একটা কাপড় পরে ত্বাওয়াফ করবে। এতে তাদের দেহ একপ্রকার নগ্নই থাকত।
ইবনু আববাস (রাঃ) বলেন, পুরুষেরা দিনের বেলায় ও মেয়েরা রাতের বেলায় ত্বাওয়াফ করত। তাদের এ অন্যায় প্রথা বন্ধ করার জন্য আল্লাহ আয়াত নাযিল করেন, يَا بَنِيْ آدَمَ خُذُوْا زِيْنَتَكُمْ عِنْدَ كُلِّ مَسْجِدٍ ‘হে আদম সন্তান! প্রতি ছালাতের সময় তোমরা সুন্দর পোষাক পরিধান কর’।
[2] তাদের কাছ থেকে ‘হুম্স’ পোষাক কিনতে বাধ্য করার জন্য তারা এ বিধানও করেছিল যে, যদি বহিরাগত কেউ উত্তম পোষাকে এসে ত্বাওয়াফ করে, তাহ’লে ত্বাওয়াফ শেষে তাদের ঐ পোষাক খুলে রেখে যেতে হবে। যার দ্বারা কেউ উপকৃত হ’ত না’ (ইবনু হিশাম ১/২০২)।
(৩) তাদের বানানো আরেকটা বিদ‘আতী রীতি ছিল এই যে, তারা এহরাম পরিহিত অবস্থায় স্ব স্ব বাড়ীর সম্মুখ দরজা দিয়ে প্রবেশ করবে।
কিন্তু বাকী আরবরা সকলে স্ব স্ব বাড়ীর পিছন দিক দিয়ে গৃহে প্রবেশ করবে। সম্মুখ দরজা দিয়ে নয়। এভাবে তারা তাদের ধার্মিকতার গৌরব সারা আরবের ঘরে ঘরে ছড়িয়ে দিয়েছিল।
এ প্রসঙ্গে আল্লাহ বলেন, وَلَيْسَ الْبِرُّ بِأَنْ تَأْتُوْا الْبُيُوْتَ مِنْ ظُهُوْرِهَا وَلَـكِنَّ الْبِرَّ مَنِ اتَّقَى وَأْتُواْ الْبُيُوْتَ مِنْ أَبْوَابِهَا ‘পিছনের দরজা দিয়ে গৃহে প্রবেশ করার মধ্যে কোন কল্যাণ নেই। বরং কল্যাণ রয়েছে তার জন্য যে আল্লাহকে ভয় করে। অতএব তোমরা গৃহে প্রবেশ কর সম্মুখ দরজা দিয়ে’ (বাক্বারাহ ২/১৮৯)।
উপরোক্ত আলোচনায় তৎকালীন আরবের ও বিশেষ করে মক্কাবাসীদের মধ্যে প্রচলিত শিরক ও বিদ‘আত সমূহের একটা চিত্র পাওয়া গেল।
যা তারা ইবরাহীম (আঃ)-এর একত্ববাদী দ্বীনে হানীফের মধ্যে ধর্মের নামে চালু করেছিল। আর এটাই ছিল বড় জাহেলিয়াত এবং এজন্যেই এ যুগটিকে ‘জাহেলী যুগ’ বা الْأَيَّامُ الْجَاهِلِيَّةُ বলা হয়েছে।
আল্লাহ বলেন, اللهُ وَلِيُّ الَّذِينَ آمَنُوا يُخْرِجُهُمْ مِنَ الظُّلُمَاتِ إِلَى النُّورِ وَالَّذِينَ كَفَرُوا أَوْلِيَاؤُهُمُ الطَّاغُوتُ يُخْرِجُونَهُمْ مِنَ النُّورِ إِلَى الظُّلُمَاتِ أُولَئِكَ أَصْحَابُ النَّارِ هُمْ فِيهَا خَالِدُونَ ‘যারা বিশ্বাস স্থাপন করেছে, আল্লাহ তাদের অভিভাবক। তিনি তাদেরকে অন্ধকার হ’তে আলোর দিকে বের করে আনেন।
আর যারা অবিশ্বাস করেছে, শয়তান তাদের অভিভাবক। তারা তাদেরকে আলো থেকে বের করে অন্ধকারের দিকে নিয়ে যায়। ওরা হ’ল জাহান্নামের অধিবাসী। সেখানে তারা চিরকাল থাকবে’ (বাক্বারাহ ২/২৫৭)।
[1]. বুখারী হা/১৬৬৫; মুসলিম হা/১২১৯-২০।
[2]. আ‘রাফ ৭/৩১; ইবনু কাছীর, তাফসীর উক্ত আয়াত।
[3]. বুখারী হা/১৮০৩; কুরতুবী, ইবনু কাছীর, তাফসীর বাক্বারাহ ১৮৯ আয়াত।
ইয়াছরিবে ইহূদী-নাছারাদের অবস্থা
ইয়াছরিবে ইহূদী-নাছারাদের অবস্থাঃ ইতিপূর্বে বলা হয়েছে যে, ইয়াছরিবের অধিবাসী আউস ও খাযরাজগণ ইসমাঈল-পুত্র নাবেত-এর বংশধর ছিলেন।
কিন্তু তারা পরে মূর্তিপূজারী হয়ে যায়। সিরিয়া ও ইরাকের পথে ব্যবসায়িক স্বার্থ এবং মিষ্ট পানি ও উর্বর অঞ্চল বিবেচনায় ইহূদীরা এখানে আগেই আগমন করে।
তারা অত্যাচারী রাজা বুখতানছর কর্তৃক কেন‘আন (ফিলিস্তীন) থেকে উৎখাত হওয়ার পরে ইয়াছরিবে এসে বসবাস শুরু করেছিল এই উদ্দেশ্যে যে, তারা বায়তুল মুক্বাদ্দাস হারিয়েছে।
অতএব তারা এখন বায়তুল্লাহর নিকটবর্তী থাকবে এবং নিয়মিত হজ্জ-ওমরাহর মাধ্যমে পরকালীন পাথেয় হাছিল করবে।
দ্বিতীয় উদ্দেশ্য ছিল এই যে, আখেরী নবীর আবির্ভাব যেহেতু মক্কায় হবে এবং তাঁর আবির্ভাবের সময় আসন্ন, অতএব তারা দ্রুত তাঁর দ্বীন কবুল করবে এবং তাঁর নেতৃত্বে আবার বায়তুল মুক্বাদ্দাস দখল করবে।
তবে তাদের ধারণা ছিল যে, আখেরী নবী অবশ্যই তাদের নবী ইসহাক-এর বংশে হবেন। কিন্তু তা না হ’য়ে ইসমাঈল-এর বংশে হওয়াতেই ঘটল যত বিপত্তি।
মদীনায় ইহূদীদের আধিক্য ছিল এবং নাছারা ছিল খুবই কম। তাদের মূল অবস্থান ছিল মদীনা থেকে নাজরান এলাকায়। যা ছিল ৭৩টি পল্লী সমৃদ্ধ খ্রিষ্টানদের একটি বিরাট নগরীর নাম।
বর্তমানে সড়কপথে এটি মদীনা থেকে ১২০৫ কি.মি. দক্ষিণে ইয়ামন সীমান্তে অবস্থিত।
ইহূদী ও নাছারাদের মধ্যে তাওরাত-ইনজীলের কোন শিক্ষা অবশিষ্ট ছিল না।
তাদের ধর্ম ও মাজনেতারা (الْأَحْبَارُ وَالرُّهْبَانُ) ভক্তদের কাছে ‘রব’-এর আসন দখল করেছিল। ইহূদীরা ওযায়েরকে ‘আল্লাহর বেটা’ বানিয়েছিল এবং নাছারারা মসীহ ঈসাকে একইভাবে ‘বেটা’ দাবী করেছিল (তওবাহ ৯/৩০-৩১)।
বরং তারা মারিয়াম, ঈসা ও আল্লাহকে নিয়ে তিন উপাস্যের সমন্বয়ে ত্রিত্ববাদে বিশ্বাসী হয়ে পড়েছিল (মায়েদাহ ৫/৭৩)। তাদের পীর-দরবেশরা ধর্মের নামে বাতিল পন্থায় মানুষের অর্থ-সম্পদ লুণ্ঠন করত এবং তাদেরকে আল্লাহর পথ থেকে ফিরিয়ে রাখতো (তওবাহ ৯/৩৪)।
আল্লাহ যা হারাম করেছেন, তারা তা হারাম করত না (তওবাহ ৯/২৯)। এক কথায় তাওরাত-ইনজীলের বাহক হবার দাবীদার হ’লেও তারা ছিল পুরা স্বেচ্ছাচারী ও প্রবৃত্তিপূজারী দুনিয়াদার।
ঠিক আজকের মুসলিম ধর্মনেতা ও সমাজনেতাদের অধিকাংশের অবস্থা যেমনটি হয়েছে। এ যুগের মুসলমানদের অবস্থা বর্ণনা করে ভারতের উর্দূ কবি হালী বলেন,
كرے غير گر بت كى پوجا تو كافر + جو ٹهراے بيٹا خدا كا تو كافر
كہے آگ كو قبلہ اپنا تو كافر + كو اكب ميں مانے كرشمہ تو كافر
مگر مومنوں پر كشاوه ہيں راہيں + پرستش كريں شوق سے جسكى چاہيں
نبى كو جو چاہيں خدا كر د كهائيں + اماموں كا رتبہ نبى سے بڑهائيں
مزاروں پہ دن رات نذريں چڑهائيں + شہيدوں سے جا جا كے مانگيں دعائيں
نہ توحيد ميں كچھ خلل اس سے آئے + نہ اسلام بگڑے نہ ايمان جاے
(১) অন্যেরা যদি মূর্তিপূজা করে, সে হয় কাফের। যে আল্লাহ্র বেটা আছে বলে, সে হয় কাফের।
(২) আগুনকে ক্বিবলা বললে, সে হয় কাফের। তারকারাজির মধ্যে যে ক্ষমতা আছে বলে, সে কাফের। (৩) কিন্তু মুমিনদের জন্য রাস্তা রয়েছে খোলা। খুশীমনে সে করে পূজা যাকে সে চায়।
(৪) নবীকে যে চায় আল্লাহ বলে দেখায়। ইমামদের সম্মান নবীদের উপর উঠায়। (৫) মাযারগুলিতে দিন-রাত নযর-নিয়ায চড়ায়। শহীদদের কাছে গিয়ে গিয়ে কেবলই দো‘আ চায়।
(৬) এতে তাদের তাওহীদে না কোন ত্রুটি আসে। না ইসলাম বিকৃত হয়, না ঈমান যায়’ (আলতাফ হোসায়েন হালী (১২৫৩-১৩৩২ হিঃ/১৮৩৭-১৯১৪ খৃঃ), মুসাদ্দাসে হালী-উর্দূ ষষ্ঠপদী (লাক্ষ্ণৌ, ভারত : ১৩২০/১৯০২) ৪৮ পৃঃ)।
শৈশব থেকে নবুঅতঃ
নবী জীবনকে আমরা প্রধান দু’টি ভাগে ভাগ করে নেব- মাক্কী জীবন ও মাদানী জীবন। মক্কায় তাঁর জন্ম, বৃদ্ধি ও নবুঅত লাভ এবং মদীনায় তাঁর হিজরত, ইসলামের বাস্তবায়ন ও ওফাত লাভ।
আরবের মরুদুলাল শেষনবী মুহাম্মাদ (সঃ) হেজাযের মক্কা নগরীতে জন্মগ্রহণ করেন ও সেখানে জীবনের ৫৩টি বছর কাটান। যার মধ্যে ১৩ বছর ছিল নবুঅতী জীবন। অতঃপর তিনি মদীনায় হিজরত করেন ও সেখানে জীবনের বাকী ১০ বছর কাটান।
অতঃপর সেখানেই ৬৩ বছর বয়সে মৃত্যুবরণ করেন। এখন আমরা তাঁর বংশ পরিচয় ও জীবন বৃত্তান্ত পেশ করব।
বুখারী হা/৩৯০২; মুসলিম হা/২৩৫১; মিশকাত হা/৫৮৩৭ ‘অহীর সূচনা’ অনুচ্ছেদ।
পূর্বপুরুষঃ
ইবরাহীম (আঃ)-এর দুই পুত্র ছিলেন ইসমাঈল ও ইসহাক্ব। ইসমাঈলের মা ছিলেন বিবি হাজেরা এবং ইসহাকের মা ছিলেন বিবি সারা।
দুই ছেলেই ‘নবী’ হয়েছিলেন। ছোট ছেলে ইসহাক্বের পুত্র ইয়াকূবও ‘নবী’ হন। তাঁর অপর নাম ছিল ‘ইস্রাঈল’ অর্থ ‘আল্লাহর দাস’। সে মতে তাঁর বংশ ‘বনু ইস্রাঈল’ নামে পরিচিত হয়।
তাঁর বারো জন পুত্রের বংশধরগণের মধ্যে যুগ যুগ ধরে হাযার হাযার নবীর জন্ম হয়। ইউসুফ, মূসা, হারূণ, দাঊদ, সুলায়মান ও ঈসা (‘আলাইহিমুস সালাম) ছিলেন এই বংশের সেরা নবী ও রাসূল।
বলা চলে যে, আদম (‘আলাইহিস সালাম) হ’তে ইবরাহীম (‘আলাইহিস সালাম) পর্যন্ত হযরত নূহ ও ইদরীস (আঃ) সহ ৮/৯ জন নবী ব্যতীত বাকী এক লক্ষ চবিবশ হাযার নবী-রাসূলের।
[1] প্রায় সকলেই ছিলেন ইবরাহীম (আঃ)-এর কনিষ্ঠ পুত্র ইসহাক (আঃ)-এর বংশধর অর্থাৎ বনু ইস্রাঈল। যাদের সর্বশেষ নবী ও রাসূল ছিলেন হযরত ঈসা (আঃ)।
অন্যদিকে হযরত ইবরাহীম (আঃ)-এর জ্যেষ্ঠ পুত্র ইসমাঈল (আঃ)-এর বংশে একজন মাত্র নবীর জন্ম হয় এবং তিনিই হ’লেন সর্বশেষ ও সর্বশ্রেষ্ঠ নবী ও রাসূল হযরত মুহাম্মাদ (সঃ)।
ফলে আদম (আঃ) যেমন ছিলেন মানবজাতির আদি পিতা, নূহ (আঃ) ছিলেন মানব জাতির দ্বিতীয় পিতা, তেমনি ইবরাহীম (আঃ) ছিলেন তাঁর পরবর্তী সকল নবীর পিতা এবং তাঁদের অনুসারী উম্মতে মুসলিমাহর পিতা (হজ্জ ২২/৭৮)।
ইবরাহীম (আঃ) আল্লাহর হুকুমে দ্বিতীয়া স্ত্রী হাজেরা ও তার পুত্র ইসমাঈলকে মক্কায় রেখে আসেন ও মাঝে-মধ্যে গিয়ে তাদের খোঁজ-খবর নিতেন। তাঁরা সেখানেই আমৃত্যু বসবাস করেন।
অন্যদিকে তাঁর প্রথমা স্ত্রী সারা ও তার পুত্র ইসহাক ও অন্যদের নিয়ে তিনি কেন‘আনে (ফিলিস্তীনে) বসবাস করতেন এবং এখানেই তিনি মৃত্যুবরণ করেন। এভাবে ইবরাহীম (আঃ)-এর দুই পুত্রের মাধ্যমে মক্কা ও শাম (ফিলিস্তীন) দুই অঞ্চলে তাওহীদের প্রচার ও প্রসার ঘটে।
কুরআনে বর্ণিত পঁচিশ জন নবীর মধ্যে আদম, নূহ, ইদরীস ও মুহাম্মাদ (ছাঃ) বাদে বাকী ২১ জন নবী ছিলেন বনু ইস্রাঈল এবং একমাত্র মুহাম্মাদ (সঃ) হ’লেন বনু ইসমাঈল।
বলা চলে যে, এই বৈমাত্রেয় পার্থক্য উম্মতে মুহাম্মাদীর বিরুদ্ধে ইহূদী-নাছারাদের স্থায়ী বিদ্বেষের অন্যতম প্রধান কারণ ছিল।
সেজন্য তারা চিনতে পেরেও এবং তাদের কিতাবে শেষনবীর নাম, পরিচয় ও তাঁর আগমনের কথা লিখিত থাকা সত্ত্বেও তারা তাঁকে মানেনি।[2]
[1]. আহমাদ হা/২২৩৪২; ত্বাবারাণী, মিশকাত হা/৫৭৩৭ ‘ক্বিয়ামতের অবস্থা’ অধ্যায় ‘সৃষ্টির সূচনা ও নবীগণের আলোচনা’ অনুচ্ছেদ; সিলসিলা ছহীহাহ হা/২৬৬৮।
[2]. বাক্বারাহ ২/১৪৬; আন‘আম ৬/২০; আ‘রাফ ৭/১৫৭।
জন্ম ও মৃত্যুঃ
মুহাম্মাদ বিন আব্দুল্লাহ রাসূলুল্লাহ (সঃ) ১ম হস্তীবর্ষের ৯ই রবীউল আউয়াল।
[১] সোমবার ছুবহে ছাদিকের পর মক্কায় নিজ পিতৃগৃহে জন্মগ্রহণ করেন এবং ১১ হিজরী সনের ১লা রবীউল আউয়াল সোমবার সকাল ১০টার দিকে মদীনায় মৃত্যুবরণ করেন।
রাসূল (সঃ)-এর জন্ম ও মৃত্যু দু’টিই সোমবারে হয়েছিল’।
[2] বিদায় হজ্জ হয়েছিল ৯ই যিলহজ্জ শুক্রবার।
তিনি বিদায় হজ্জের পরে ৮০ বা ৮১ দিন বেঁচে ছিলেন। কেউ বলেছেন ৯০ বা ৯১ দিন (এটা ভুল)। আবু মিখনাফ ও কালবী ওফাতের তারিখ ২রা রবীউল আউয়াল বলেছেন। ইবনু হিশামের ভাষ্যকার সুহায়লী সেটাকেই অগ্রাধিকার দিয়েছেন।
ইবনু হাজার বলেন,
فَالْمُعْتَمَدُ مَا قَالَ أَبُو مِخْنَفٍ وَكَأَنَّ سَبَبَ غَلَطِ غَيْرِهِ أَنَّهُمْ قَالُوا مَاتَ فِي ثَانِي شَهْرِ رَبِيعٍ الْأَوَّلِ فَتَغَيَّرَتْ فَصَارَتْ ثَانِي عَشَرَ وَاسْتَمَرَّ الْوَهْمُ بِذَلِكَ يَتْبَعُ بَعْضُهُمْ بَعْضًا مِنْ غَيْرِ تَأَمُّلٍ
‘আবু মিখনাফ যেটি বলেছেন, সেটিই নির্ভরযোগ্য। অন্যদের ভুলের কারণ সম্ভবতঃ এটাই যে, তারা বলেছিলেন, রাসূল (ছাঃ) ২রা রবীউল আউয়াল মৃত্যুবরণ করেছেন।
কিন্তু পরে সেটি পরিবর্তিত হয়ে ১২ই রবীউল আউয়াল হয়ে গেছে। পরবর্তীতে লোকেরা কোনরূপ চিন্তা-ভাবনা না করেই উক্ত ভুলের অনুসরণ করে গেছেন’।[3] অর্থাৎ ثَانِي شَهْرِ رَبِيعٍ الْأَوَّل পরে ثَانِي عَشَرَ হয়ে গেছে’।
তবে এটি মক্কার চাঁদের হিসাবে হ’তে পারে। কেননা মক্কার চাঁদ মদীনার একদিন আগে ওঠে (আল-বিদায়াহ ৫/২২৪-২৫)। অতএব মদীনার হিসাবে ১লা রবীউল আউয়াল ওফাতের দিন হবে। আল্লাহ সর্বাধিক অবগত।
সুলায়মান মানছূরপুরীর হিসাব মতে সৌরবর্ষ হিসাবে রাসূল (ছাঃ)-এর জন্ম ৫৭১ খ্রিষ্টাব্দের ২২শে এপ্রিল সোমবার এবং মৃত্যু ৬৩২ খ্রিষ্টাব্দের ৬ই জুন সোমবার।
চান্দ্রবর্ষ হিসাবে তাঁর বয়স হয়েছিল ৬৩ বছর ৪দিন এবং সৌরবর্ষ হিসাবে ৬১ বছর ১ মাস ১৪ দিন। তাঁর জন্ম হয়েছিল আবরাহা কর্তৃক কা‘বা আক্রমণের ৫০ দিন পরে (ইবনু হিশাম ১/১৫৮-টীকা ৪)।
এটা ছিল ইবরাহীম (আঃ) থেকে ২৫৮৫ বছর ৭ মাস ২০ দিন পরে এবং নূহ (আঃ)-এর প্লাবনের ৩৬৭৫ বছর পরের ঘটনা।
রাসূল (সঃ) দুনিয়াতে বেঁচে ছিলেন মোট ২২,৩৩০ দিন ৬ ঘণ্টা। তন্মধ্যে তাঁর নবুঅতকাল ছিল ৮১৫৬ দিন।[4] সঠিক হিসাব আল্লাহ জানেন।
[1]. ছহীহ হাদীছসমূহের বর্ণনা অনুযায়ী রাসূল (সঃ)-এর জন্ম সোমবারে হয়েছে। কোন তারিখ সেটা বলা নেই।
অতএব সোমবার ঠিক রাখতে গেলে আধুনিক জ্যোতির্বিজ্ঞানের হিসাব মতে ৯ই রবীউল আউয়ালই সঠিক জন্ম তারিখ হয়, ১২ই রবীউল আউয়াল নয়, যা প্রসিদ্ধ আছে (সুলায়মান বিন সালমান মানছূরপুরী, (মৃ. ১৯৩০ খ্রিঃ) রহমাতুল্লিল ‘আলামীন (উর্দূ), দিল্লী : ১৯৮০ খ্রিঃ ১/৪০; আর-রাহীক্ব পৃঃ ৫৪; মা শা-‘আ ৫-৯ পৃঃ)।
তাঁর জন্মের কাহিনীতে প্রসিদ্ধ আছে যে, (১) রাসূলুল্লাহ (সঃ) খাৎনাকৃত ও নাড়ী কাটা অবস্থায় ভূমিষ্ট হন। (২) কেউ তার লজ্জাস্থান দেখেনি। (৩) শৈশবে বক্ষবিদারণের দিন জিব্রীল তাঁর খাৎনা করেন (যঈফাহ হা/৬২৭০)।
(৪) জান্নাত থেকে আসিয়া ও মারিয়াম নেমে এসে ধাত্রীর কাজ করেন। (৫) আবু লাহাব মৃত্যুর পরে তার পরিবারের কোন একজনকে (বলা হয়ে থাকে, আববাসকে) স্বপ্ন দেখান। তাকে বলা হয় আপনার অবস্থা কি?
তিনি বলেন, আমি জাহান্নামে।
তবে প্রতি সোমবার আমার আযাব হালকা করা হয় এবং আমার এই দুই আঙ্গুল থেকে পানি চুষে পান করি।
আর এটা এ কারণে যে, নবী (সঃ)-এর জন্মের সুসংবাদ দানের ফলে আমি আমার দাসী ছুয়াইবাহকে মুক্ত করে দেই এবং সে নবীকে দুধ পান করায়।
উল্লেখ্য যে, আবু লাহাব ২য় হিজরীতে সংঘটিত বদর যুদ্ধের সপ্তাহকাল পরে মারা যান। আববাস তখন কাফের ছিলেন এবং ৮ম হিজরীতে মক্কা বিজয়ের দিন মুসলমান হন।
(৬) রাসূল এর প্রসবের সময় তার মা বলছেন যে, আমার গুপ্তাঙ্গ দিয়ে ‘নূর’ অর্থাৎ জ্যোতি বিকশিত হয়। যা শামে প্রাসাদ সমূহকে আলোকিত করেছিল।
উম্মাহাতুল মুমিনীন যা স্বচক্ষে দেখেছিলেন। এটি ছিল ভবিষ্যতে শাম এলাকা ইসলামের আলোকে আলোকিত হওয়ার আগাম সুসংবাদ।
(৭) পারস্যের কিসরা রাজপ্রাসাদ কেঁপে উঠেছিল এবং তার ১৪টি চূড়া ভেঙ্গে পড়েছিল। আর এটি ছিল তাঁর ভবিষ্যৎ নবী হওয়ার অগ্রিম সুসংবাদ (৮) এ সময় মজূসীদের পূজার আগুন নিভে গিয়েছিল।
(৯) ইরাকের সাওয়া হ্রদের পানি শুকিয়ে গিয়েছিল এবং তার পার্শ্ববর্তী গীর্জাসমূহ ধ্বসে পড়েছিল ইত্যাদি (আব্দুল্লাহ বিন মুহাম্মাদ বিন আব্দুল ওয়াহহাব নাজদী, মুখতাছার সীরাতুর রাসূল (ছাঃ) (রিয়াদ: ১ম সংস্করণ ১৪১৪/১৯৯৪ খৃঃ ১৮-২০ পৃঃ; মুবারকপুরী, আর-রাহীকুল মাখতূম, কুয়েত : ২য় সংস্করণ ১৪১৬/১৯৯৬ খৃঃ ৫৪ পৃঃ)।
উল্লেখ্য যে, আর-রাহীক্বের বাংলা অনুবাদক ও সম্পাদকগণ তাঁদের অগণিত ভুল অনুবাদের মধ্যে ঐ সাথে এটাও যোগ করেছেন যে, (১০) ঐ সময় কা‘বাগৃহের ৩৬০টি মূর্তি ভূলুণ্ঠিত হয়ে পড়ে’ (বঙ্গানুবাদ, আগস্ট ১৯৯৫, ১০১ পৃঃ; সেপ্টেম্বর ২০০৯, ৭৬ পৃঃ)।
যেকথা মূল আরবী, পৃঃ ৫৪ এবং লেখক কর্তৃক অনূদিত উর্দূ সংস্করণ, লাহোর : নভেম্বর ১৯৮৮, পৃঃ ১০১-এ নেই)। বলা বাহুল্য, উপরে বর্ণিত সকল বর্ণনাই ভিত্তিহীন কল্পকথা মাত্র।
[2]. মুসলিম হা/১১৬২; মিশকাত হা/২০৪৫; বুখারী হা/১৩৮৭।
[3]. বিস্তারিত দ্রঃ ফাৎহুল বারী হা/৪৪২৬-এর পরে ‘রাসূল (ছাঃ)-এর অসুখ ও মৃত্যু’ অনুচ্ছেদ; আল-বিদায়াহ ওয়ান নিহায়াহ ৫/২২৪-২৫; মোস্তফা চরিত ৮৬৭-৬৮ পৃঃ।
[4]. কাযী সুলায়মান বিন সালমান মানছূরপুরী (মৃ. ১৩৪৯/১৯৩০ খৃ:), রহমাতুল্লিল ‘আলামীন (দিল্লী : ১ম সংস্করণ ১৯৮০ খৃঃ) ২/১৬, ৩৬৮ পৃঃ; ১/৪০, ২৫১ পৃঃ।
বংশের শাখাঃ
তিনি মক্কার কুরায়েশ বংশের শ্রেষ্ঠ শাখা হাশেমী গোত্রে জন্ম গ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম ছিল আব্দুল্লাহ, মাতার নাম আমেনা। দাদার নাম ছিল আব্দুল মুত্ত্বালিব, দাদীর নাম ফাতেমা।
নানার নাম ছিল ওয়াহাব, নানীর নাম বাররাহ। নানার বংশসূত্র রাসূল (সঃ)-এর ঊর্ধ্বতন দাদা কিলাব-এর সাথে এবং নানীর বংশসূত্র কুছাই বিন কিলাব-এর সাথে যুক্ত হয়েছে।
দাদা আব্দুল মুত্ত্বালিব ছিলেন বনু হাশেম গোত্রের সরদার এবং নানা ওয়াহাব ছিলেন বনু যোহরা গোত্রের সরদার। দাদার হাশেমী গোত্র ও নানার যোহরা গোত্র কুরায়েশ বংশের দুই বৃহৎ ও সম্ভ্রান্ত গোত্র হিসাবে প্রসিদ্ধ ছিল।
রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেন, بُعِثْتُ مِنْ خَيْرِ قُرُونِ بَنِى آدَمَ قَرْنًا فَقَرْنًا، حَتَّى كُنْتُ مِنَ الْقَرْنِ الَّذِى كُنْتُ فِيهِ ‘আমি যুগ পরম্পরায় বনু আদমের শ্রেষ্ঠ যুগে প্রেরিত হয়েছি। অবশেষে আমি সেই যুগে এসেছি, যে যুগে আমি রয়েছি’ (বুখারী হা/৩৫৫৭)।
(২) রোম সম্রাট হিরাক্লিয়াস আবু সুফিয়ানকে হোদায়বিয়া সন্ধির পরে তার কুফরী অবস্থায় প্রশ্ন করেছিলেন, তোমাদের মধ্যে নবী দাবীকারী ব্যক্তির বংশ কেমন ?
উত্তরে আবু সুফিয়ান বলেছিলেন, هُوَ فِينَا ذُو حَسَبٍ ‘তিনি আমাদের মধ্যে উচ্চ বংশীয়’। হেরাক্লিয়াস বলেছিলেন, كَذَلِكَ الرُّسُلُ تُبْعَثُ فِى أَحْسَابِ قَوْمِهَا ‘এভাবেই নবী-রাসূলগণ তার সম্প্রদায়ের সেরা বংশে জন্ম গ্রহণ করে থাকেন’।
(৩) রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন,إِنَّ اللهَ اصْطَفَى مِنْ وَلَدِ إِبْرَاهِيْمَ إِسْمَاعِيْلَ وَاصْطَفَى مِنْ وَلَدِ إِسْمَاعِيْلَ بَنِي كِنَانَةَ وَاصْطَفَى مِنْ بَنِي كِنَانَةَ قُرَيْشًا وَاصْطَفَى مِنْ قُرَيْشٍ بَنِي هَاشِمٍ وَاصْطَفَانِى مِنْ بَنِي هَاشِمٍ-
‘আল্লাহ ইবরাহীমের সন্তানগণের মধ্য থেকে ইসমাঈলকে বেছে নিয়েছেন। অতঃপর ইসমাঈলের সন্তানগণের মধ্য থেকে বনু কেনানাহকে বেছে নিয়েছেন।
অতঃপর বনু কেনানাহ থেকে কুরায়েশ বংশকে বেছে নিয়েছেন। অতঃপর কুরায়েশ থেকে বনু হাশেমকে এবং বনু হাশেম থেকে আমাকে বেছে নিয়েছেন।
[2] এভাবে আল্লাহর অনুগ্রহে শেষনবী (ছাঃ) বনু আদমের সেরা বংশের সেরা গোত্রে সেরা সন্তান হিসাবে জন্মগ্রহণ করেন।
(৪) তিনি বলতেন, أَنَا دَعْوَةُ أَبِي إِبْرَاهِيْمَ، وَبُشْرَى عِيْسَى عَلَيْهِمَا السَّلاَم ‘আমি আমার পিতা ইবরাহীমের দো‘আ ও ঈসার সুসংবাদ’।
কেননা ইবরাহীম ও ইসমাঈল বায়তুল্লাহ নির্মাণের সময় দো‘আ করেছিলেন, যা কুরআনে বর্ণিত হয়েছে নিম্নোক্ত ভাষায়-
رَبَّنَا وَابْعَثْ فِيْهِمْ رَسُوْلاً مِّنْهُمْ يَتْلُو عَلَيْهِمْ آيَاتِكَ وَيُعَلِّمُهُمُ الْكِتَابَ وَالْحِكْمَةَ وَيُزَكِّيْهِمْ إِنَّكَ أَنْتَ الْعَزِيْزُ الْحَكِيْمُ- (بقرة ১২৯)-
‘হে আমাদের পালনকর্তা! তুমি তাদের মধ্য হ’তে একজনকে তাদের প্রতি রাসূল হিসাবে প্রেরণ কর, যিনি তাদের নিকটে তোমার আয়াতসমূহ পাঠ করে শুনাবেন এবং তাদেরকে কিতাব ও হিকমত (সুন্নাহ) শিক্ষা দিবেন ও তাদেরকে পরিশুদ্ধ করবেন’ (বাক্বারাহ ২/১২৯)।
পিতা-পুত্রের এই মিলিত দো‘আ দুই হাযারের অধিক বছর পরে শেষনবী মুহাম্মাদ (ছাঃ)-এর আগমনের মাধ্যমে বাস্তবে রূপ লাভ করে। ফালিল্লাহিল হাম্দ।
উল্লেখ্য যে, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর বংশের উচ্চ মর্যাদা ও পবিত্রতা বর্ণনায় ছহীহ হাদীছসমূহ থাকা সত্ত্বেও অনেক বানোয়াট হাদীছ তৈরী করা হয়েছে।
যেমন,
(১) আমি পিতা-মাতার মাধ্যমে দুনিয়াতে এসেছি। আদম থেকে শুরু করে জাহেলী যুগের কোনরূপ ব্যভিচারের মাধ্যমে কখনো দুই পিতা আমাকে স্পর্শ করেনি’ (বায়হাক্বী, দালায়েল ১/১৭৪ পৃঃ)।
(২) ‘যদি আল্লাহ জানতেন যে, আমার বংশের চাইতে উত্তম কোন বংশ আছে, তাহ’লে আমাকে সেখান থেকেই ভূমিষ্ট করাতেন’।
(৩) ‘জিব্রীল আমার উপরে অবতীর্ণ হ’য়ে বললেন, আল্লাহ জাহান্নামকে হারাম করেছেন ঐ ব্যক্তির জন্য, যার ঔরসে আপনাকে পাঠান হয়েছে এবং ঐ গর্ভকে, যা আপনাকে ধারণ করেছে এবং ঐ ক্রোড়কে, যা আপনাকে প্রতিপালন করেছে’ (ইবনুল জাওযী, মাওযূ‘আত ১/২৮১-৮৩)। এগুলি সবই ‘জাল’ এবং অতিশয়োক্তি ছাড়া কিছুই নয়।
[1]. বুখারী হা/৪৫৫৩; মুসলিম হা/১৭৭৩; মিশকাত হা/৫৮৬১।
[2]. মুসলিম হা/২২৭৬; ওয়াছেলাহ ইবনুল আসক্বা‘ হ’তে; মিশকাত হা/৫৭৪০ ‘ফাযায়েল ও শামায়েল অধ্যায়।
[3]. আহমাদ, ছহীহ ইবনু হিববান, আবু উমামাহ হ’তে; সিলসিলা ছহীহাহ হা/১৫৪৫।
নবীর বংশধারাঃ
তাঁর বংশধারাকে তিনভাগে ভাগ করা যায়।
১ম ভাগেঃ মুহাম্মাদ (ছাঃ) থেকে ঊর্ধ্বতন পুরুষ ‘আদনান পর্যন্ত ২২টি স্তর। যে ব্যাপারে কারু কোন দ্বিমত নেই।
এর উপরে
২য় ভাগেঃ ‘আদনান থেকে ইবরাহীম (আঃ) পর্যন্ত ৪১টি স্তর এবং তার উপরে ৩য় ভাগেঃ ইবরাহীম (আঃ) থেকে আদম (আঃ) পর্যন্ত ১৯টি স্তর।
সর্বমোট ৮২টি স্তর।
যেখানে নাম ও স্তরের ব্যাপারে বিদ্বানগণের মধ্যে মতভেদ রয়েছে। আমরা নিম্নে ‘আদনান পর্যন্ত বংশধারা উল্লেখ করলাম। যেখানে কোন মতভেদ নেই এবং এতেও কোন মতভেদ নেই যে, ‘আদনান নবী ইসমাঈল (আঃ)-এর বংশধর ছিলেন’।
(১) মুহাম্মাদ বিন :
(২) আব্দুল্লাহ বিন :
(৩) আব্দুল মুত্ত্বালিব বিন :
(৪) হাশেম বিন :
(৫) ‘আবদে মানাফ বিন :
(৬) কুছাই বিন :
(৭) কিলাব বিন :
(৮) মুররাহ বিন :
(৯) কা‘ব বিন :
(১০) লুওয়াই বিন :
(১১) গালিব বিন :
(১২) ফিহর (লকব কুরায়েশ) বিন :
(১৩) মালেক বিন :
(১৪) নাযার বিন :
(১৫) কিনানাহ বিন :
(১৬) খুযায়মা বিন :
(১৭) মুদরেকাহ বিন :
(১৮) ইলিয়াস বিন :
(১৯) মুযার বিন :
(২০) নিযার বিন :
(২১) মা‘দ বিন :
(২২) ‘আদনান।
এর মধ্যে পরদাদা হাশেম-এর নামে হাশেমী গোত্র এবং দ্বাদশতম পুরুষ ফিহর যার উপাধি ছিল কুরায়েশ, তাঁর নামানুসারে ‘কুরায়েশ’ বংশ প্রসিদ্ধি লাভ করে। কুরায়েশ অর্থ তিমি মাছ। যা হ’ল সাগরের বৃহত্তম ও অপরাজেয় প্রাণী (বায়হাক্বী, দালায়েল ১/১৮১ পৃঃ)।
ইয়ামনের বাদশাহ হাসসান মক্কা আক্রমণ করে কা‘বা উঠিয়ে নিজ দেশে নিয়ে যেতে চেয়েছিলেন। ফিহর তাকে যুদ্ধে হারিয়ে তিন বছর বন্দী করে রাখেন। অতঃপর মুক্তি দেন। হাসসান ইয়ামনে ফেরার পথে রাস্তায় মারা যান।
এই ঘটনার পর থেকে ফিহর ‘আরবের কুরায়েশ’ (قُرَيْشُ الْعَرَبِ) বলে খ্যাতি লাভ করেন’।
ইবনু কাছীর বলেন, আরবদের সকল গোত্র ‘আদনানে এসে জমা হয়েছে।
যেকারণে আল্লাহ স্বীয় নবীকে বলেন, قُلْ لاَ أَسْأَلُكُمْ عَلَيْهِ أَجْرًا إِلاَّ الْمَوَدَّةَ فِي الْقُرْبَى ‘তুমি বল, আমি আমার দাওয়াতের জন্য তোমাদের কাছে কোন বিনিময় চাইনা, কেবল আত্মীয়তাসূলভ ভালবাসা ব্যতীত’... (শূরা ৪২/২৩)।
উক্ত আয়াত নাযিলের কারণ হিসাবে ইবনু আববাস (রাঃ) বলেন, لَمْ يَكُنْ بَطْنٌ مِنْ قُرَيْشٍ إِلاَّ وَلَهُ فِيهِ قَرَابَةٌ، فَنَزَلَتْ عَلَيْهِ إِلاَّ أَنْ تَصِلُوا قَرَابَةً بَيْنِى وَبَيْنَكُمْ ‘কুরায়েশদের এমন কোন গোত্র ছিল না, যার সাথে রাসূল (ছাঃ)-এর আত্মীয়তার সম্পর্ক ছিল না। অতএব নাযিল হয়, তোমরা কেবল আত্মীয়তার সম্পর্ক ঠিক রাখ’।
[1]. ছফিউর রহমান মুবারকপুরী, আর-রাহীকুল মাখতূম ৪৮-৪৯ পৃঃ; সুলায়মান মানছূরপুরী, রহমাতুল্লিল ‘আলামীন ২৫-৩১ পৃঃ; ইবনু হিশাম ১/১-৪; ইবনুল ক্বাইয়িম, যাদুল মা‘আদ ১/৭০ পৃঃ।-
الْجُزْءُ الْأَوَّلُ : هُوَ مُحَمّدُ بْنُ عَبْدِ اللهِ بْنِ عَبْدِ الْمُطّلِبِ- اسْمُه شَيْبَةُ- بْنِ هَاشِمٍ- اسْمُه عَمْرُو- بْنِ عَبْدِ مَنَافِ- اسْمُه الْمُغِيرَةُ- بْنِ قُصَيٍّ- اسْمُه زَيْدُ- بْنِ كِلاَبِ بْنِ مُرَّةَ بْنِ كَعْبِ بْنِ لُؤَيِّ بْنِ غَالِبِ بْنِ فِهْرِ- الْمُلَقَّبُ بِقُرَيْشٍ- بْنِ مَالِكِ بْنِ النَّضْرِ- اسْمُه قَيْسٌ- بْنِ كِنَانَةَ بْنِ خُزَيْمَة َ بْنَ مُدْرِكَةَ- اسْمُه عَامِرُ- بْنِ إلْيَاسَ بْنِ مُضَرَبْنِ نِزَارِ بْنِ مَعْدِ بْنِ عَدْنَانَ- (زاد المعاد لابن القيم ১/৭০، سيرة ابن هشام ১/১-২، الرحيق المختوم ص ৪৮)-
الْجُزْءُ الثَّانِيُ : ما فوق عدنان، هو بْنُ أُدٍّ- او أُدَدُ- بن هَمَيْسَع بن سلامان بن عوص بن بوز بن قموال بن أُبَيّ بن عَوَّام بن ناشد بن حزا بن بلداس بن يدلاف بن طابخ بن جاحم بن ناحش بن ماخي بن عيض بن عبقر بن عبيد بن الدعا بن حمدان بن سَنْبَر بن يثربي بن يحزن بن يلحن بن أرعويِ بن عيض بن ديشان بن عِيْصَر بن أَفْنَاد بن أيهام بن مقصر بن ناحث بن زارح بن سمي بن مَزِّي بن عوضة بن عَرَّام بن قَيْدَار بن إِسْمَاعِيْلُ بن إِبْرَاهِيْمُ عليهما السلام- (قد جمع العلامة محمد سليمان المنصور فوري هذا الجزء من النسب برواية الكلبي وابن سعد بعد تحقيق دقيق. انظر رحمة للعالمين ২/ ১৪، ১৫، ১৬، ১৭ وفيه اختلاف كبير بين المصادر الةاريخية. (الرحيق ৪৮)-
الْجُزْءُ الثَّالِثُ : ما فوق إبراهيم عليه السلام، وهو ابن تارح- واسمه آزر- بن ناحور بن ساروع- أو ساروغ- بن راعو بن فَالَخ بن عابر بن شالخ بن أَرْفَخْشَد بن سام بن نوح- عليه السلام- بن لامك بن مَتَوَشْلَخ بن أخنوخ- يقال هو إدريس عليه السلام- ابن يَرْد بن مَهْلائيل بن قَيْنَان بن يَانِشَ بن شِيْث بن آدم عليهما السلام- (ابن هشام ১/ ২، ৩، ৪، تلقيح فهوم أهل الأثر ص ৬، خلاصة السير للطبري ص ৬، ورحمة للعالمين ২/ ১৮ واختلفت هذه المصادر في تلفظ بعض هذه الأسماء، وكذا سقط من بعض المصادر بعض الأسماء- (الرحيق ৪৯ حاشية-১)
[2]. যাদুল মা‘আদ ১/৭০; ইবনু কাছীর, সীরাতুর রাসূল (ছাঃ) ১৩ পৃঃ।
[3]. বুখারী, ‘আনছারদের মর্যাদা’ অধ্যায়, ২৮ অনুচ্ছেদ ‘নবী (ছাঃ)-এর আগমন’।
প্রসিদ্ধ আছে যে, রাসূল (ছাঃ) স্বীয় বংশধারা বর্ণনার ক্ষেত্রে ‘আদনান পর্যন্ত উল্লেখ করার পর উপরের স্তরসমূহের ব্যাপারে চুপ থাকতেন এবং বলতেন, كَذَبَ النَّسَّابُونَ ‘বংশবিদরা মিথ্যা বলেছে’ (আর-রাহীক্ব ২০ পৃঃ)। বর্ণনাটি ‘মওযূ’ বা জাল (আলবানী, সিলসিলা যঈফাহ হা/১১১)।
[4]. মানছূরপুরী, রহমাতুল্লিল ‘আলামীন ২/৫৯ পৃঃ।
[5]. বুখারী হা/৩৪৯৭; ইবনু কাছীর, সীরাতুর রাসূল (ছাঃ) ১৩ পৃঃ।
আব্দুল্লাহ্`র মৃত্যুঃ
পিতা আব্দুল্লাহ ব্যবসায়ের উদ্দেশ্যে তদীয় পিতা আব্দুল মুত্ত্বালিবের হুকুমে ইয়াছরিব (মদীনা) গেলে সেখানে অসুস্থ হয়ে পড়েন এবং মাত্র ২৫ বছর বয়সে মৃত্যুবরণ করেন। সেখানে তিনি নাবেগা জা‘দীর গোত্রে সমাধিস্থ হন।
এভাবে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর জন্মের পূর্বে তাঁর পিতার মৃত্যু হয়ে যায়। উল্লেখ্য যে, মদীনার বনু নাজ্জার গোত্রে আব্দুল মুত্ত্বালিবের পিতা হাশেম বিবাহ করেন। ফলে তারা ছিলেন আব্দুল মুত্ত্বালিবের নানার গোষ্ঠী।
মৃত্যুকালে আব্দুল্লাহ যেসব সহায়-সম্পদ রেখে গিয়েছিলেন তা ছিল যথাক্রমে পাঁচটি উট, এক পাল ছাগল এবং একটি নাবালিকা হাবশী দাসী বারাকাহ ওরফে উম্মে আয়মান। যিনি রাসূল (ছাঃ)-কে শিশুকালে লালন-পালন করেন।
ইনি পরে যায়েদ বিন হারেছার সাথে বিবাহিতা হন এবং উসামা বিন যায়েদ তাঁর পুত্র ছিলেন। তিনি রাসূল (ছাঃ)-এর মৃত্যুর পাঁচ মাস পরে মৃত্যুবরণ করেন’।
[1]. আর-রাহীক্ব ৫৩ পৃঃ; আল-ইস্তী‘আব; মুসলিম হা/১৭৭১।
হাশেম ও হাশেমী বংশঃ
নবী (ছাঃ)-এর বংশ হাশেমী বংশ হিসাবে পরিচিত।যা তাঁর দাদা হাশেম বিন ‘আব্দে মানাফের দিকে সম্পর্কিত। হাশেম পূর্ব থেকেই ‘সিক্বায়াহ’ ও ‘রিফাদাহ’ অর্থাৎ হাজীদের পানি পান করানো ও মেহমানদারীর দায়িত্বে ছিলেন।
হাশেম ছিলেন ধনী ও উচ্চ মর্যাদা সম্পন্ন ব্যক্তি। তিনিই প্রথম কুরায়েশদের জন্য শীতকালে ইয়ামানে ও গ্রীষ্মকালে শামে দু’টি ব্যবসায়িক সফরের নিয়ম চালু করেন।
তিনি এক ব্যবসায়িক সফরে শাম যাওয়ার পথে মদীনায় যাত্রা বিরতি করেন এবং সেখানে বনু ‘আদী বিন নাজ্জার গোত্রে সালমা বিনতে আমরকে বিবাহ করেন।
অতঃপর সেখানে অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রীকে রেখে ফিলিস্তীনের গাযায় চলে যান এবং সেখানে মৃত্যুবরণ করেন।
এদিকে তার স্ত্রী একটি পুত্র সন্তান প্রসব করেন ৪৯৭ খ্রিষ্টাব্দে (আর-রাহীক্ব ৪৯ পৃঃ)। সাদা চুল নিয়ে ভূমিষ্ট হওয়ার কারণে মা তার নাম রাখেন শায়বাহ (شَيْبَةٌ)। এভাবে তিনি ইয়াছরিবে মায়ের কাছে প্রতিপালিত হন।
মক্কায় তার পরিবারের লোকেরা যা জানতে পারেনি। যৌবনে পদার্পণের কাছাকাছি বয়সে উপনীত হ’লে তার জন্মের খবর জানতে পেরে চাচা কুরায়েশ নেতা মুত্ত্বালিব বিন ‘আব্দে মানাফ তাকে মক্কায় নিয়ে আসেন।
লোকেরা তাকে মুত্ত্বালিবের ক্রীতদাস মনে করে তাকে ‘আব্দুল মুত্ত্বালিব’ বলেছিল। সেই থেকে তিনি উক্ত নামে পরিচিত হন। যদিও তাঁর আসল নাম ছিল ‘শায়বাহ’ অর্থ ‘সাদা চুল ওয়ালা’ (ইবনু হিশাম ১/১৩৭-৩৮)।
মুত্ত্বালিব ও আব্দুল মুত্ত্বালিবঃ
ইয়ামনের ‘বিরাদমান’ (بِرَدْمَانَ) এলাকায় চাচা গোত্রনেতা মুত্ত্বালিব পরলোক গমন করলে ভাতিজা আব্দুল মুত্ত্বালিব তাঁর স্থলাভিষিক্ত হন (ইবনু হিশাম ১/১৩৮, ১৪২)।
কালক্রমে আব্দুল মুত্ত্বালিব নিজ সম্প্রদায়ের মধ্যে এত উঁচু মর্যাদা লাভ করেন যে, তাঁর পিতা বা পিতামহ কেউই উক্ত মর্যাদায় পৌঁছতে পারেননি। সম্প্রদায়ের লোকেরা সবাই তাঁকে আন্তরিকভাবে ভালোবাসত ও সমীহ করে চলত’ (ইবনু হিশাম ১/১৪২)।
আব্দুল মুত্ত্বালিবের উচ্চ মর্যাদা লাভের অন্যতম কারণ ছিল আল্লাহর পক্ষ হ’তে স্বপ্নযোগে তাঁকে ‘যমযম’ কূয়া খননের দায়িত্ব প্রদান করা এবং তাঁর নেতৃত্বকালে আল্লাহর বিশেষ রহমতে ইয়ামনের খ্রিষ্টান গবর্ণর ‘আবরাহা’ কর্তৃক কা‘বা আক্রমণ ব্যর্থ হওয়া।
এই মর্যাদা তাঁর বংশের পরবর্তী নেতা আবু ত্বালিব-এর যুগেও অব্যাহত ছিল। যা রাসূল (ছাঃ)-এর আগমনে আরও বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হয়ে বিশ্ব মর্যাদায় উন্নীত হয়।
আব্দু মানাফ, হাশেম ও আব্দুল মুত্ত্বালিবঃ
আব্দু মানাফ, হাশেম ও আব্দুল মুত্ত্বালিবঃ কুছাই-পুত্র আব্দু মানাফের প্রকৃত নাম ছিল মুগীরাহ। তাঁর ৪টি পুত্র সন্তান ছিল : হাশেম, প্রকৃত নাম আমর। আব্দু শাম্স, মুত্ত্বালিব ও নওফাল।
হাশেম ও মুত্ত্বালিবকে সৌন্দর্যের কারণে ‘দুই পূর্ণচন্দ্র’ (الْبَدْرَان) বলা হ’ত (ইবনুল আছীর)।
হাশেমের ৪ পুত্র ছিল : আব্দুল মুত্ত্বালিব, আসাদ, আবু ছায়ফী ও নাযলাহ।
আব্দুল মুত্ত্বালিবের ছিল ১০টি পুত্র ও ৬টি কন্যা।
পুত্রগণের মধ্যে আববাস, হামযাহ, আব্দুল্লাহ, আবু ত্বালিব, যুবায়ের, হারেছ, হাজলা, মুক্বাউভিম, যেরার ও আবু লাহাব।
কন্যাদের মধ্যে ছাফিয়া, বায়যা, আতেকাহ, উমাইমাহ, আরওয়া ও বার্রাহ’। ভাষ্যকার সুহায়লী বলেন, যুবায়ের ছিলেন রাসূল (ছাঃ)-এর বড় চাচা।
তাঁর ছেলে আব্দুল্লাহ ছাহাবী ছিলেন। তাঁর সমর্থনেই নবুঅত লাভের ২০ বছর পূর্বে ‘হিলফুল ফুযূল’ প্রতিষ্ঠা লাভ করে’ (ইবনু হিশাম ১/১০৬-০৮, ১/১৩৩ টীকা-১)।
তবে ইবনু ইসহাক বলেন, স্বপ্নে আদেশ প্রাপ্ত হয়ে যমযম কূপ খননের সময় আব্দুল মুত্ত্বালিবের সাথে তাঁর পুত্র হারেছ ছিলেন।
কারণ তিনি ব্যতীত তখন তাঁর অন্য কোন পুত্র সন্তান ছিল না’ (ইবনু হিশাম ১/১৪৩)। এতে বুঝা যায় যে, হারেছ-ই আব্দুল মুত্ত্বালিবের প্রথম পুত্র ছিলেন।
আবু ত্বালিবঃ আবু ত্বালিবের নাম ছিল আব্দু মানাফ। কিন্তু তিনি আবু ত্বালিব নামেই প্রসিদ্ধি লাভ করেন। তাঁর ৪ পুত্র ও ২ কন্যা ছিল : ত্বালিব, ‘আক্বীল, জা‘ফর ও আলী। ত্বালিব ‘আক্বীলের চাইতে দশ বছরের বড় ছিলেন।
[1] তাঁর মৃত্যুর অবস্থা জানা যায় না। বাকী সকলেই ছাহাবী ছিলেন। দুই কন্যা উম্মে হানী ও জুমানাহ দু’জনেই ইসলাম কবুল করেন’ (রহমাতুল্লিল ‘আলামীন ২/৭৫-৮৩ পৃঃ)।
আব্দুল মুত্ত্বালিবের পরে আবু ত্বালিব বনু হাশিমের নেতা হন। তিনি আমৃত্যু রাসূল (ছাঃ)-এর অকৃত্রিম অভিভাবক ছিলেন।
তাঁর আহবানে সাড়া দিয়ে বয়কটকালের তিন বছরসহ সর্বদা বনু মুত্ত্বালিব ও বনু হাশিম রাসূল (ছাঃ)-এর সহযোগী ছিলেন। যদিও আবু ত্বালিব ও অন্য অনেকে ইসলাম কবুল করেন নি। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর আপন চাচাদের মধ্যে তিন ধরনের মানুষ ছিলেন।
১. যারা তাঁর উপরে ঈমান এনেছিলেন ও তাঁর সাথে জিহাদ করেছিলেন। যেমন হামযাহ ও আববাস (রাঃ)।
২. যারা তাঁকে সাহায্য করেছিলেন। কিন্তু জাহেলিয়াতের উপর মৃত্যুবরণ করেন। যেমন আবু ত্বালিব।
৩. যারা শুরু থেকে মৃত্যু অবধি শত্রুতা করেন। যেমন আবু লাহাব।
উল্লেখ্য যে, আবু সুফিয়ান ছিলেন বনু ‘আব্দে শামস গোত্রের, আবু জাহল ছিলেন বনু মাখযূম গোত্রের এবং উমাইয়া বিন খালাফ ছিলেন বনু জুমাহ গোত্রের। যদিও সকলেই ছিলেন কুরায়েশ বংশের অন্তর্ভুক্ত এবং সবাই ছিলেন রাসূল (ছাঃ)-এর সম্পর্কীয় চাচা।
[1]. ইবনু সা‘দ ১/৯৭। উল্লেখ্য যে, আলী (রাঃ)-এর বড় ভাই ত্বালিব বিন আবু ত্বালিব বদর যুদ্ধে অংশগ্রহণ করলেও জনৈক কুরায়েশ নেতার সাথে বাদানুবাদের প্রেক্ষিতে প্রত্যাবর্তনকারীদের সাথে মক্কায় ফিরে যান (ইবনু হিশাম ১/৬১৯)।
তিনি বদরের যুদ্ধে বিজয় লাভে রাসূল (ছাঃ)-এর প্রশংসা করে এবং নিহত নেতাদের স্মরণে শোক প্রকাশ করে কবিতা বলেন’ (ইবনু হিশাম ২/২৬)।
ইবনু সা‘দ বলেন, অন্যান্যদের সাথে তিনিও বদর যুদ্ধে যেতে বাধ্য হয়েছিলেন। অতঃপর যখন কুরায়েশরা পরাজিত হয়, তখন তাঁকে নিহত বা বন্দীদের মধ্যে পাওয়া যায়নি।
তিনি মক্কায়ও ফিরে যাননি। তাঁর কোন সন্ধান পাওয়া যায়নি। তাঁর কোন সন্তানাদিও ছিল না’ (ইবনু সা‘দ ১/৯৭)। অতএব তিনি ঈমান এনে মৃত্যুবরণ করেছিলেন কি না, তা নিশ্চিতভাবে বলা যায় না।
খাৎনা ও নামকরণঃ
প্রচলিত নিয়ম অনুযায়ী সপ্তম দিনে নবজাতকের খাৎনা ও নামকরণ করা হয়।
[1] পিতৃহীন নবজাতককে কোলে নিয়ে স্নেহশীল দাদা আব্দুল মুত্ত্বালিব কা‘বাগৃহে প্রবেশ করেন।
তিনি সেখানে আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করেন ও প্রাণভরে দো‘আ করেন।
আকীকার দিন সমস্ত কুরায়েশ বংশের লোককে দাওয়াত করে খাওয়ান। সকলে জিজ্ঞেস করলে তিনি বাচ্চার নাম বলেন, ‘মুহাম্মাদ’।
এই অপ্রচলিত নাম শুনে লোকেরা বিস্ময়ভরে এর কারণ জিজ্ঞেস করলে তিনি বলেন, আমি চাই যে, আমার বাচ্চা সারা দুনিয়ায় ‘প্রশংসিত’ হৌক (রহমাতুল্লিল ‘আলামীন ১/৪১)।
ওদিকে স্বপ্নের মাধ্যমে ফেরেশতার দেওয়া প্রস্তাব অনুযায়ী মা আমেনা তার নাম রাখেন ‘আহমাদ’ (রহমাতুল্লিল ‘আলামীন ১/৩৯)। উভয় নামের অর্থ প্রায় একই। অর্থাৎ ‘প্রশংসিত’ এবং ‘সর্বাধিক প্রশংসিত’।
[1]. যাদুল মা‘আদ ১/৮০-৮১। খাৎনা ও আক্বীক্বা করার বিষয়টি যে আরবদের মাঝে পূর্ব থেকেই প্রচলিত ছিল, তা ছহীহ হাদীছ দ্বারা প্রমাণিত (বুখারী হা/৭, আবুদাঊদ হা/২৮৪৩)।
তবে রাসূল (সঃ)-এর খাৎনা যে সপ্তম দিনেই হয়েছিল (আর-রাহীক্ব ৫৪ পৃঃ) একথার কোন প্রমাণ নেই (ঐ, তা‘লীক্ব ৩৯-৪৪ পৃঃ)। ইবনুল ক্বাইয়িম (রহঃ) বলেন, রাসূল (ছাঃ)-এর খাৎনা সম্পর্কে তিনটি কথা চালু আছে।
১. তিনি খাৎনা ও নাড়ি কাটা অবস্থায় ভূমিষ্ট হয়েছিলেন। ইবনুল জাওযী এটাকে মওযূ‘ বা জাল বলেছেন। ২. হালীমার গৃহে থাকার সময় প্রথম বক্ষবিদারণকালে ফেরেশতা জিব্রীল তাঁর খাৎনা করেন।
৩. দাদা আব্দুল মুত্ত্বালিব তাঁকে সপ্তম দিনে খাৎনা করান ও নাম রাখেন এবং লোকজনকে দাওয়াত করে খাওয়ান। এগুলি সম্পর্কে যেসব বর্ণনা এসেছে, তার কোনটিই ছহীহ নয়।
এ বিষয়ে বিপরীতমুখী দু’জন মুহাক্কিকের একজন কামালুদ্দীন বিন ‘আদীম বলেন, আরবদের রীতি অনুযায়ী তাঁকে খাৎনা করা হয়েছিল। এটি এমন একটি রীতি, যা প্রমাণের জন্য কোন নির্দিষ্ট বর্ণনার প্রয়োজন নেই’ (যাদুল মা‘আদ ১/৮০-৮১)।
[2]. উভয় নামই কুরআনে এসেছে। যেমন ‘মুহাম্মাদ’ নাম এসেছে চার জায়গায়। যথাক্রমে- সূরা আলে ইমরান ৩/১৪৪, আহযাব ৩৩/৪০; মুহাম্মাদ ৪৭/২ এবং ফাৎহ ৪৮/২৯।
তাছাড়া ‘মুহাম্মাদ’ নামেই একটি সূরা নাযিল হয়েছে সূরা মুহাম্মাদ (৪৭ নং সূরা)।
অনুরূপভাবে ‘আহমাদ’ নাম এসেছে এক জায়গায় (ছফ ৬১/৬)।
সীরাতে ইবনু হিশামের ভাষ্যকার সুহায়লী (মৃ. ৫৮১ হি.) বলেন, ঐ সময় সারা আরবে মাত্র তিনজন ব্যতীত অন্য কারু নাম ‘মুহাম্মাদ’ ছিল বলে জানা যায় না। যাদের প্রত্যেকের পিতা তার পুত্র আখেরী নবী হবেন বলে ভবিষ্যদ্বাণী করে যান।
যাদের একজন হ’লেন বিখ্যাত উমাইয়া কবি ফারাযদাক্ব (৩৮-১১০ হি.)-এর প্রপিতামহ মুহাম্মাদ বিন সুফিয়ান বিন মুজাশি‘। অন্যজন হলেন মুহাম্মাদ বিন উহাইহাহ বিন জুলাহ। আরেকজন হলেন মুহাম্মাদ বিন হুমরান বিন রাবী‘আহ।
এদের পিতারা বিভিন্ন সম্রাটের দরবারে গিয়ে জানতে পারেন যে, আখেরী নবী হেজাযে জন্মগ্রহণ করবেন। ফলে তারা মানত করে যান যে, তাদের পুত্র সন্তান হ’লে যেন তার নাম ‘মুহাম্মাদ’ রাখা হয় (ইবনু হিশাম ১/১৫৮ -টীকা-১)।
রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর নাম সমূহঃ
জুবাইর বিন মুত্ব‘ইম (রাঃ) হ’তে বর্ণিত রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) এরশাদ করেন, إِنَّ لِى أَسْمَاءً أَنَا مُحَمَّدٌ وَأَنَا أَحْمَدُ وَأَنَا الْمَاحِى الَّذِى يَمْحُو اللهُ بِىَ الْكُفْرَ وَأَنَا الْحَاشِرُ الَّذِى يُحْشَرُ النَّاسُ عَلَى قَدَمَىَّ وَأَنَا الْعَاقِبُ الَّذِى لَيْسَ بَعْدَهُ أَحَدٌ- ‘আমার অনেকগুলি নাম রয়েছে।
আমি মুহাম্মাদ (প্রশংসিত), আমি আহমাদ (সর্বাধিক প্রশংসিত), আমি ‘মাহী’ (বিদূরিতকারী)। আমার মাধ্যমে আল্লাহ কুফরীকে বিদূরিত করেছেন। আমি ‘হাশের’ (জমাকারী)।
কেননা সমস্ত লোক ক্বিয়ামতের দিন আমার কাছে জমা হবে (এবং শাফা‘আতের জন্য অনুরোধ করবে)। আমি ‘আক্বেব’ (সর্বশেষে আগমনকারী)। আমার পরে আর কোন নবী নেই’।
[1] সুলায়মান মানছূরপুরী বলেন, উক্ত নাম সমূহের মধ্যে মুহাম্মাদ ও আহমাদ হ’ল তাঁর মূল নাম এবং বাকীগুলো হ’ল তাঁর গুণবাচক নাম। সেজন্য তিনি সেগুলির ব্যাখ্যা করেছেন। এই গুণবাচক নামের সংখ্যা মানছূরপুরী গণনা করেছেন ৫৪টি। তিনি ৯২টি করার আশাবাদ ব্যক্ত করেছিলেন।
[2] ‘মুহাম্মাদ’ নামের প্রশংসায় চাচা আবু তালিব বলতেন, وَشَقَّ لَهُ مِنَ اسْمِهِ لِيُجِلَّهُ + فَذُو الْعَرْشِ مَحْمُودٌ وَهَذَا مُحَمَّدُ ‘তাঁর মর্যাদা বৃদ্ধির জন্য আল্লাহ নিজের নাম থেকে তার নাম বের করে এনেছেন। তাই আরশের মালিক হ’লেন মাহমূদ এবং ইনি হ’লেন মুহাম্মাদ’।
[1]. বুখারী হা/৪৮৯৬; মুসলিম হা/২৩৫৪; মিশকাত হা/৫৭৭৬-৭৭, ‘ফাযায়েল’ অধ্যায় ‘রাসূল (ছাঃ)-এর নাম সমূহ’ অনুচ্ছেদ।
[2]. মানছূরপুরী, রহমাতুল্লিল ‘আলামীন ৩/১৯৮ পৃঃ।
[3]. বুখারী, তারীখুল আওসাত্ব ১/১৩ (ক্রমিক ৩১); যাহাবী, সিয়ারু আ‘লামিন নুবালা ১/১৫৩। উল্লেখ্য যে, উক্ত কবিতাটি হাসসান বিন ছাবিত আনছারী (রাঃ)ও তার দীওয়ানের মধ্যে যুক্ত করেছেন (দীওয়ানে হাসসান পৃঃ ৪৭)।
লালন-পালনঃ
জন্মের পর শিশু মুহাম্মাদ কিছুদিন চাচা আবু লাহাবের দাসী ছুওয়াইবার দুধ পান করেন। তাঁর পূর্বে চাচা হামযা বিন আব্দুল মুত্ত্বালিব এবং তাঁর পরে আবু সালামাহ তার দুধ পান করেন।
[1] ফলে তাঁরা সকলে পরস্পরে দুধভাই ছিলেন। এ সময় পিতা আব্দুল্লাহ্র রেখে যাওয়া একমাত্র মুক্তদাসী উম্মে আয়মন রাসূল (ছাঃ)-কে শৈশবে লালন-পালন করেন। এরপর ধাত্রী হালীমা সা‘দিয়াহ তাঁকে প্রতিপালন করেন।
অতঃপর হালীমার গৃহ থেকে আসার পর মা আমেনা তাকে সাথে নিয়ে মদীনায় স্বামীর কবর যিয়ারত করতে যান এবং ফেরার পথে মৃত্যুবরণ করলে কিশোরী উম্মে আয়মন শিশু মুহাম্মাদকে সাথে নিয়ে মক্কায় ফেরেন।
পরে খাদীজা (রাঃ)-এর মুক্তদাস যায়েদ বিন হারেছাহ্র সাথে তার বিয়ে হয়।
অতঃপর তার গর্ভে উসামা বিন যায়েদের জন্ম হয়। রাসূল (ছাঃ) উম্মে আয়মানকে ‘মা’ (يَا أُمَّهْ) বলে সম্বোধন করতেন এবং নিজ পরিবারভুক্ত (بَقِيَّةُ أَهْلِ بَيْتِي) বলতেন। তিনি তাকে ‘মায়ের পরে মা’ (أُمِّي بَعْدَ أُمِّي) বলে সম্মানিত করতেন।
[2] সে সময়ে শহরবাসী আরবদের মধ্যে এই ধারণা প্রচলিত ছিল যে, শহরের জনাকীর্ণ পংকিল পরিবেশ থেকে দূরে গ্রামের নিরিবিলি উন্মুক্ত পরিবেশে শিশুদের লালন-পালন করলে তারা বিভিন্ন রোগ-ব্যাধি হ’তে মুক্ত থাকে এবং তাদের স্বাস্থ্য সুঠাম ও সবল হয়। সর্বোপরি তারা বিশুদ্ধ আরবী ভাষায় কথা বলতে অভ্যস্ত হয়।
সে হিসাবে দাদা আব্দুল মুত্ত্বালিব সবচেয়ে সম্ভ্রান্ত ধাত্রী হিসাবে পরিচিত বনু সা‘দ গোত্রের হালীমা সা‘দিয়াহকে নির্বাচন করেন এবং তার হাতেই প্রাণাধিক পৌত্রকে সমর্পণ করেন।
হালীমার গৃহে দু’বছর দুগ্ধপানকালীন সময়ে তাদের পরিবারে সচ্ছলতা ফিরে আসে। তাদের ছাগপালে এবং অন্যান্য সকল বিষয়ে আল্লাহর তরফ থেকে বরকত নেমে আসে।
নিয়মানুযায়ী দু’বছর পরে বাচ্চাকে ফেরত দেওয়ার জন্য তাঁকে মা আমেনার কাছে আনা হয়। কিন্তু হালীমা তাকে ছাড়তে চাচ্ছিলেন না। তিনি আমেনাকে বারবার অনুরোধ করেন আরও কিছুদিন বাচ্চাকে তার কাছে রাখার জন্য। ঐ সময় মক্কায় মহামারী দেখা দিয়েছিল।
ফলে মা রাযী হয়ে যান এবং বাচ্চাকে পুনরায় হালীমার কাছে অর্পণ করেন (আর-রাহীক্ব ৫৬ পৃঃ)।
[1]. আল-ইছাবাহ, ছুওয়াইবাহ ক্রমিক ১০৯৬৪; ইবনু হিশাম ২/৯৬।
[2]. আল-ইছাবাহ, উম্মে আয়মন ক্রমিক সংখ্যা ১১৮৯৮; ঐ, আল-ইস্তী‘আবসহ (কায়রো ছাপা : ক্রমিক সংখ্যা ১১৪১, ১৩/১৭৭-৮০ পৃঃ, ১৩৯৭/১৯৭৭ খ্রিঃ)।
প্রসিদ্ধ আছে যে, যায়েদ বিন হারেছাহ তেহামার বনু ফাযারাহ কর্তৃক বন্দী হয়ে ওকায বাজারে বিক্রয়ের জন্য নীত হন।
সেখান থেকে হাকীম বিন হিযাম তার ফুফু খাদীজা বিনতে খুওয়াইলিদ-এর জন্য তাকে খরীদ করেন। রাসূল (সঃ) নবী হওয়ার পূর্বে তার সম্পর্কে স্বপ্ন দেখেন।
অতঃপর খাদীজার সাথে বিবাহের পর তিনি তাকে তাঁর উদ্দেশ্যে হেবা করে দেন।... সেখানে এ কথাও আছে যে, যায়েদের পিতা হারেছাহ এবং তার চাচাসহ পরিবারের কিছু লোক তাকে নেওয়ার জন্য আসেন।
তখন আল্লাহর নবী যায়েদকে তার পিতার সঙ্গে যাওয়ার এখতিয়ার দেন’ (ইবনু সা‘দ ৩/৪২)। ইবনু হাজার বলেন, বর্ণনাটি ‘খুবই অপরিচিত’ (منكر جدا)। (মা শা-‘আ ২৩ পৃঃ)।
উল্লেখ্য যে, যায়েদ বিন হারেছাহ তার পিতার ৩ সন্তান জাবালাহ, আসমা ও যায়েদ-এর মধ্যে তৃতীয় ও কনিষ্ঠ ছিলেন। এক সময় যায়েদ হারিয়ে যান। পিতা তার জন্য কেঁদে আকুল হন।
পরে রাসূল (ছাঃ) তাকে লালন-পালন করেন এবং তিনি ‘মুহাম্মাদের পুত্র’ (زَيْدُ ابْنُ مُحَمَّدٍ) হিসাবে পরিচিত হন (বুখারী হা/৪৭৮২)। পরবর্তীতে সন্ধান পেয়ে তার বড় ভাই জাবালাহ রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর নিকট আসেন এবং বলেন, হে আল্লাহর রাসূল !
যায়েদকে আমার সাথে পাঠিয়ে দিন। তিনি বললেন, এই তো যায়েদ। তুমি ওকে নিয়ে যাও। আমি মানা করব না। তখন যায়েদ বলল, হে আল্লাহর রাসূল !
আমি আপনার উপর কাউকে প্রাধান্য দিব না। জাবালাহ বলেন, (পরবর্তীতে) আমি দেখলাম আমার ভাইয়ের সিদ্ধান্ত আমার চাইতে উত্তম ছিল’ (হাকেম হা/৪৯৪৭-৪৮; তিরমিযী হা/৩৮১৫; মিশকাত হা/৬১৬৫)।
রাসূল সাঃ এর বক্ষ বিদারণ
বক্ষ বিদারণঃ দ্বিতীয় দফায় হালীমার নিকটে আসার পর জন্মের চতুর্থ কিংবা পঞ্চম বছরে শিশু মুহাম্মাদের সীনা চাক বা বক্ষ বিদারণের বিস্ময়কর ঘটনা ঘটে।
ব্যাপারটি ছিল এই যে, মুহাম্মাদ তার সাথীদের সাথে খেলছিলেন। এমন সময় জিবরাঈল ফেরেশতা এসে তাকে কিছু দূরে নিয়ে বুক চিরে ফেলেন।
অতঃপর কলীজা বের করে যমযমের পানি দিয়ে ধুয়ে কিছু জমাট রক্ত ফেলে দেন এবং বলেন, هَذَا حَظُّ الشَّيْطَانِ مِنْكَ ‘এটি তোমার মধ্যেকার শয়তানের অংশ’। অতঃপর বুক পূর্বের ন্যায় জোড়া লাগিয়ে দিয়ে তিনি অদৃশ্য হয়ে যান।
পুরা ব্যাপারটি খুব দ্রুত সম্পন্ন হয়। সাথী বাচ্চারা ছুটে গিয়ে হালীমাকে খবর দিল যে, মুহাম্মাদ নিহত হয়েছে। তিনি ছুটে এসে দেখেন যে, মুহাম্মাদ মলিন মুখে দাঁড়িয়ে আছে’।
হালীমা তাকে বুকে তুলে বাড়ীতে এনে সেবা-যত্ন করতে থাকেন। এই অলৌকিক ঘটনায় হালীমা ভীত হয়ে পড়েন এবং একদিন তাঁকে তার মায়ের কাছে ফেরত দিয়ে যান। তখন তার বয়স ছিল ছয় বছর। তাঁর দ্বিতীয়বার বক্ষবিদারণ হয় মি‘রাজে গমনের পূর্বে মক্কায়।
[1]. মুসলিম হা/১৬২, আনাস (রাঃ) হ’তে; মিশকাত হা/৫৮৫২ ‘নবুঅতের নিদর্শন সমূহ’ অনুচ্ছেদ।
[2]. বুখারী হা/৩৮৮৭, ৩৪৯; মুসলিম হা/১৬৪, ১৬৩; মিশকাত হা/৫৮৬২, ৫৮৬৪, ‘মি‘রাজ’ অনুচ্ছেদ।
বক্ষবিদারণ পর্যালোচনাঃ
রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর বক্ষবিদারণ সম্পর্কে শী‘আগণ ও অন্যান্য আপত্তিকারীগণ মূলতঃ তিনটি প্রশ্ন উত্থাপন করে থাকেন।
(১) বক্ষবিদারণের ঘটনাটি মানব প্রকৃতির বিরোধী (২) এটি জ্ঞান ও যুক্তি বিরোধী (৩) এটি আল্লাহর সৃষ্টিবিধান পরিবর্তনের শামিল।
এর জবাবে বলা যায় :
(১) শৈশবে বক্ষবিদারণের বিষয়টি ভবিষ্যত নবুঅতের আগাম নিদর্শন।
(২) শৈশবে ও মি‘রাজ গমনের পূর্বে বক্ষবিদারণের ঘটনা অন্ততঃ ২৫ জন ছাহাবী কর্তৃক অবিরত ধারায় বর্ণিত ছহীহ হাদীছসমূহ দ্বারা প্রমাণিত (ইবনু কাছীর, তাফসীর ইসরা ১ আয়াত)। অতএব এতে সন্দেহের কোন অবকাশ নেই।
(৩) যাবতীয় মানবীয় কলুষ থেকে পরিচ্ছন্ন করা। যাকে ‘শয়তানের অংশ’ বলা হয়েছে। এটা তাঁর জন্য খাছ এবং পৃথক একটি বৈশিষ্ট্য।
(৪) প্রত্যেক নবীরই কিছু মু‘জেযা থাকে। সে হিসাবে এটি শেষনবী (সঃ)-এর বিশেষ মু‘জেযা সমূহের অন্তর্ভুক্ত। এর মধ্যে মানবীয় জ্ঞানের কোন প্রবেশাধিকার নেই।
(৫) শেষনবী ও শ্রেষ্ঠনবী হিসাবে রাসূলুল্লাহ (সঃ) জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত আল্লাহর সার্বক্ষণিক তত্ত্বাবধানে ও বিশেষ ব্যবস্থাধীনে পরিচালিত ছিলেন। অতএব বক্ষবিদারণের ঘটনা সাধারণ মানবীয় রীতির বিরোধী হ’লেও তা আল্লাহর অনন্য সৃষ্টি কৌশলের অধীন।
যেমন শিশুকালে মূসা (আঃ) সাগরে ভেসে গিয়ে ফেরাঊনের গৃহে লালিত-পালিত হন’ (ত্বোয়াহা ২০/৩৮-৩৯)। ঈসা (আঃ) মাতৃক্রোড়ে স্বীয় সম্প্রদায়ের সাথে বাক্যালাপ করেন’ (মারিয়াম ১৯/৩০-৩৩) ইত্যাদি।
দুঃখের বিষয় স্কটিশ প্রাচ্যবিদ উইলিয়াম মূর (১৮১৯-১৯০৫) তাঁর লিখিত নবীজীবনী Life of Mahomet (1857 & 1861) গ্রন্থে বক্ষবিদারণের এ ঘটনাটিকে মূর্ছা (Epilepsy) রোগের ফল বলেছেন।
শৈশব থেকেই এ রোগগ্রস্ত হওয়ার কারণে তিনি মাঝে-মধ্যে অজ্ঞান হয়ে পড়তেন। অতঃপর সেই বিকারের মধ্যে তিনি মনে করতেন যে, আল্লাহর নিকট থেকে তিনি বাণী প্রাপ্ত হয়েছেন (নাঊযুবিল্লাহ)।
জার্মান প্রাচ্যবিদ ড. স্প্রেঙ্গার (১৮১৩-১৮৯৩) আরেকটি অদ্ভুত তথ্য পেশ করেছেন যে, অন্তঃসত্ত্বা অবস্থায় বিবি আমেনার কণ্ঠদেশে ও বাহুতে এক এক খন্ড লোহা ঝুলানো ছিল’। এর দ্বারা তিনি সিদ্ধান্ত নিয়েছেন যে, তিনি মৃগীরোগী ছিলেন’ (ঐ, ২৪০ পৃঃ)।
উইলিয়াম মূর মুহাম্মাদকে চঞ্চলমতি প্রমাণ করার জন্য একটি ঘটনা বর্ণনা করেছেন যে, ‘পাঁচ বছর বয়সে মায়ের নিকট রেখে যাওয়ার জন্য হালীমা তাকে নিয়ে মক্কায় আসছিলেন।
কাছাকাছি আসার পর বালকটি হঠাৎ হালীমার সঙ্গছাড়া হয়ে উধাও হয়ে যায়। তখন আব্দুল মুত্ত্বালিব তার কোন ছেলেকে পাঠিয়ে দেখেন যে, বালকটি এদিক-ওদিক ঘুরে বেড়াচ্ছে। তারপর তিনি তাঁকে তার মায়ের কাছে নিয়ে যান’।
কেবল মূর নন বৃটিশ প্রাচ্যবিদ স্যামুয়েল মার্গোলিয়থ (১৮৫৮-১৯৪০) লিখেছেন, পিতৃহীন এই বালকের অবস্থা মোটেও প্রীতিকর ছিল না। মুহাম্মাদের শেষ বয়সে তাঁর চাচা হামযা (মাতাল অবস্থায়) তাকে নিজ পিতার দাস বলে বিদ্রুপ করেছিলেন’ (ঐ, ২৫৮-৫৯ পৃঃ)।
মাওলানা আকরম খাঁ (১৮৬৮-১৯৬৮) বলেন, এই শ্রেণীর বিদ্বেষ-বিষ জর্জরিত অসাধু লোকদিগের কথার প্রতিবাদ করিয়া শ্রম ও সময়ের অপব্যয় করা উচিৎ নহে’ (ঐ, ২৪০ পৃঃ)।
[1]. মোহাম্মদ আকরম খাঁ, মোস্তফা চরিত (ঢাকা : ঝিনুক পুস্তিকা ১৯৭৫), ২৫০ পৃঃ।
আমেনার ইয়াছরিব গমন ও মৃত্যুবরণঃ
প্রাণাধিক সন্তানকে কাছে পেয়ে আমেনা তার প্রাণপ্রিয় স্বামীর কবর যেয়ারত করার মনস্থ করেন।
শ্বশুর আব্দুল মুত্ত্বালিব সব ব্যবস্থা করে দেন। সেমতে পুত্র মুহাম্মাদ ও পরিচারিকা উম্মে আয়মনকে সাথে নিয়ে তিনি মক্কা থেকে প্রায় ৪৬০ কিঃ মিঃ উত্তরে মদীনার উদ্দেশ্যে রওয়ানা হন।
অতঃপর যথাসময়ে মদীনায় পৌঁছে নাবেগা আল-জা‘দীর পারিবারিক গোরস্থানে স্বামীর কবর যেয়ারত করেন। অতঃপর সেখানে এক মাস বিশ্রাম নেন।
এরপর পুনরায় মক্কার উদ্দেশ্যে রওয়ানা হন।
কিন্তু কিছু দূর এসেই তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েন এবং ‘আবওয়া’ (الأَبْوَاء) নামক স্থানে মৃত্যুবরণ করেন।
যা বর্তমানে মদীনা থেকে মক্কার পথে ২৫০ কিঃ মিঃ দূরে অবস্থিত একটি শহরের নাম। উম্মে আয়মন শিশু মুহাম্মাদকে মক্কায় নিয়ে আসেন। এভাবে জন্ম থেকে পিতৃহারা ইয়াতীম মুহাম্মাদ মাত্র ৬ বছর বয়সে মাতৃহারা হ’লেন (ইবনু হিশাম ১/১৬৮)।
দাদার স্নেহনীড়ে হযরত মুহাম্মাদ (স:):
মুহাম্মাদঃ পিতৃ-মাতৃহীন ইয়াতীম মুহাম্মাদ এবার এলেন প্রায় ৮০ বছরের বৃদ্ধ দাদা আব্দুল মুত্ত্বালিবের স্নেহনীড়ে।
আব্দুল মুত্ত্বালিব নিজেও ছিলেন জন্ম থেকে ইয়াতীম। সেই শিশুকালের ইয়াতীম আব্দুল মুত্ত্বালিব আজ বৃদ্ধ বয়সে নিজ ইয়াতীম পৌত্রের অভিভাবক হন। কিন্তু এ স্নেহনীড় বেশী দিন স্থায়ী হয়নি।
মাত্র দু’বছর পরে শিশু মুহাম্মাদের বয়স যখন ৮ বছর, তখন তার দাদা আব্দুল মুত্ত্বালিব ৮২ বছর বয়সে মক্কায় ইন্তেকাল করেন।
ফলে তাঁর অছিয়ত অনুযায়ী আপন চাচা আবু ত্বালিব তার দায়িত্বভার গ্রহণ করেন এবং আমৃত্যু প্রায় চল্লিশ বছর যাবৎ তিনি ভাতীজার যোগ্য অভিভাবক হিসাবে জীবনপাত করেন।[1]
[1]. ইবনু হিশাম ১/২২৩, ২৩৫, ত্বাবাক্বাত ইবনে সা‘দ ১/১১৭-১৮। বর্ণনাটির সনদ ‘যঈফ’ (তাহকীক ইবনু হিশাম ক্রমিক ১৭০)।
আরো পড়ুন: আল্লাহ তা‘আলার ওপর ঈমান
ভূমিকা : লিখতে গিয়ে যদি ভূল হয়ে থাকে তাহলে ক্ষমা সুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন।
এবং কোন সাজেশন এর প্রয়োজন হলে আমাকে ইমেইল এর মধ্যেমে জানিয়ে দিবেন !
প্রতিদিন এই ওয়েবসাইট ভিজিট করুন ।
ভালো লাগলে দয়াকরে শেয়ার করবেন । ধন্যবাদ
সাথে থাকার জন্য ধন্যবাদ ।